ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

জনগণের তথ্য ও গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ॥ জয়

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৩ অক্টোবর ২০১৮

জনগণের তথ্য ও গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ॥ জয়

প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা ও পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় বলেছেন, যে সব সাংবাদিক ও সম্পাদকের মিথ্যা সংবাদ ছাপানোর উদ্দেশ্য নেই, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ নিয়ে তাদের ভয়ের কিছু নেই। কারণ, আইনটি জনগণের তথ্য ও গোপনীয়তা সুরক্ষার জন্য প্রণীত হয়েছে। খবর বাসসর। প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা তার নিজস্ব ফেসবুক এ্যাকাউন্টে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কিছু ধারার সমালোচনার ব্যাপারে তার মতামত তুলে ধরেন। এতে তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া দেখার তার সুযোগের কথাও উল্লেখ করেন। সজীব ওয়াজেদ জয় আইনটির সমালোচনার জবাবে বলেন, ‘সরকারী অফিসের কম্পিউটারে হ্যাকিং এবং গোপনে নজরদারি রোধ করার ক্ষেত্রে আইনের দরকার জনগণের তথ্য ও গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থেই। এই আইনের আগে হ্যাকিং ও তথ্য চুরির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কোন আইনী ভিত্তি দেশে ছিল না। তাহলে এই আইনের সাহায্য ছাড়া কিভাবে হ্যাকিং ও তথ্য চুরির বিচার হবে? সরকারী কম্পিউটারে জনগণের জাতীয় পরিচয়পত্রসহ নাগরিকদের অনেক রকম তথ্য সংগৃহীত থাকে। ব্যাংক হিসাব, স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য, জমির রেকর্ড সবকিছুই আজকাল ডিজিটাইজ করে সংগ্রহ করা হচ্ছে। এগুলো যদি হ্যাক করা হয়, তার দায়ভার কে নেবেন? দায় কিন্তু তখন সরকারের ওপরই আসবে। তাই হ্যাকিং ঠেকানোর জন্য তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা হিসেবে আমি এই আইন প্রণয়নের সুপারিশ করি।’ আইসিটি উপদেষ্টা বলেন, শুধু তাই নয়, ‘সরকারী অফিসে ডিজিটাল নজরদারির মাধ্যমে জনগণের তথ্য সংবলিত বিভিন্ন দলিল বা নথির ছবি বা ভিডিও তোলাও সম্ভব। গোপনে অডিও রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমেও নাগরিকদের অনেক সংবেদনশীল তথ্যের আলোচনা শুনে ফেলা সম্ভব, এমনকি ওয়াই-ফাই পাসওয়ার্ডও। এর মাধ্যমে হয়ত একজন সাংবাদিকের কাজ কঠিন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু কার দুর্নীতি ফাঁস করার জন্য একজন সাংবাদিকের কি সরকারী অফিসের কম্পিউটার হ্যাক করে নাগরিকদের সংবেদনশীল তথ্য চুরির অধিকার থাকা উচিত? পৃথিবীর কোন দেশই কিন্তু বেআইনিভাবে সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহ করার সুযোগ দেয় না, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও না। সরকারী অফিসে গোপনে নজরদারি করা সব দেশেই আইনবহির্ভূত, সাংবাদিকদের জন্যও। সাংবাদিকদের তাদের তথ্য অন্যান্য সূত্র থেকে জোগাড় করতে হয়।’ জয় বলেন, ‘যেসব কূটনৈতিক মিশন এই আইনটি নিয়ে আপত্তি তুলেছে তাদের আমি একটি প্রশ্ন করতে চাই : সাংবাদিকরা কি আপনাদের দূতাবাসের ভেতরে গোপনে নজরদারি করার যন্ত্রপাতি নিয়ে আসতে পারবেন?’ তিনি বলেন, ‘আরেকটি আপত্তির জায়গা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিকরণ নিয়ে যে ধারাটি, সেটি নিয়ে। আমরা দেখেছি কিভাবে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর পর বিএনপি-জামায়াত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের ঘটনাবলীকে বিকৃত করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে। এই বিকৃতিকরণের পেছনে কারণ ছিল যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানানো ও বঙ্গবন্ধুর খুনীদের প্রতিষ্ঠিত করা। এসবের বিরুদ্ধে কি কোন আইন থাকা উচিত নয়? আমরা কি ভবিষ্যতে আবারও এই অপরাজনীতির পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই? আইনটির এই ধারার বিরুদ্ধে যারা বলছেন তারা আসলে বাঙালী নন। তারা গোপনে জামায়াত সমর্থক রাজাকার।’ জনাব ওয়াজেদ বলেন, ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের হলোকস্ট ডিনায়াল আইনের ওপর ভিত্তি করেই এই ধারাটি প্রণয়ন করা হয়েছে। ১৬টি ইউরোপিয়ান দেশে হলোকস্টের ‘স্বীকৃত সংখ্যা’ থেকে কম মানুষ মারা গেছে এই কথা বললেও কারাদ- দেয়া হয়। এর মধ্যে অনেক দেশ আছে যাদের দূতাবাসগুলো বাংলাদেশে আমাদের এই আইন নিয়ে আপত্তি তুলেছে। যেসব ইউরোপীয় দূতাবাস আমাদের এই আইন নিয়ে আপত্তি তুলেছে, তাদের প্রতি আমার প্রশ্ন : আপনাদের হলোকস্ট ডিনায়াল আইন থাকতে পারলে আমাদের কেন একই রকম আইন থাকতে পারবে না? আমাদের আইন যদি জাতিসংঘসহ অন্যান্য মানবাধিকারের মানদ-ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়, তাহলে আপনাদেরগুলো কিভাবে হয়? এই ধারাটিতে কোন ধরনের সংশোধন সম্ভব না।’ তিনি বলেন, ‘এই আইনের কিছু অংশ অনলাইনে মিথ্যা বা গুজবের মাধ্যমে সহিংসতা বা ধর্মীয় উন্মাদনা উস্কে দেয়ার বিরুদ্ধে। আপনাদের মনে আছে, রামুতে, ফেসবুকে পবিত্র কোরান পুড়িয়ে দেয়ার মিথ্যা পোস্টের মাধ্যমে পুরো একটি বৌদ্ধ অধ্যুষিত গ্রামে আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছিল। এই ধরনের ঘটনা আমাদের দেশে একাধিকবার ঘটেছে। অতিসম্প্রতি ছাত্রদের আন্দোলনের সময়ও আমরা দেখেছি কিভাবে অনলাইনে গুজব রটানোর মাধ্যমে সহিংসতা উস্কে দেয়া হচ্ছিল। এই আইন ছাড়া আমরা এই ধরনের সহিংসতা উস্কে দেয়ার ঘটনাগুলো কিভাবে প্রতিহত করব?’ প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের প্রচলিত ফৌজদারি আইনে এই বিষয়ে কিছুটা বিধান আছে। সেই আইনের আওতায় আপনি যদি এমন কিছু বলেন বা লিখেন যার কারণে কেউ অন্য কাউকে শারীরিকভাবে ক্ষতি করে, তখন আপনার বিরুদ্ধে সেই আইনে ব্যবস্থা নেয়া যায়। এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন না থাকলে আপনাকে আসলেই কেউ হতাহত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের কি হতাহতের ঘটনা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত? নাকি এই ধরনের ঘটনা যাতে ঘটতেই না পারে সেই দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত? এই ধরনের আইন পৃথিবীর সব দেশেই বিদ্যমান, যুক্তরাষ্ট্রেও আছে। অনেক ইউরোপীয় দেশে বিদ্বেষ ছড়ানো ও সহিংসতা উস্কে দেয়ার বিরুদ্ধে আইন আছে, আমাদের এই আইনও সেই রকমই।’ তিনি বলেন, ‘আরেকটি আপত্তির বিষয় যা শোনা যাচ্ছে তাহলো এই আইনের আওতায় অপরাধমূলক কর্মকা-ের জন্য যে কাউকে ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেফতার করা যাবে ও তল্লাশি চালানো যাবে। ওয়ারেন্টের প্রয়োজন তখনই পড়ে যখন অপরাধ ইতোমধ্যে ঘটে গেছে। কোন অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সময় ঘটনাস্থল থেকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতার ও তল্লাশি চালানো যায়। এটা ফৌজদারি আইনের মৌলিক বিষয় আমাদের দেশসহ সব দেশেই। আপনি যদি কোন চুরির বিষয়ে অভিযোগ করতে পুলিশকে ফোন করেন, পুলিশ কি তখন ওয়ারেন্টের জন্য বসে থাকে নাকি তাৎক্ষণিকভাবে চোরকে গ্রেফতার করে চুরির মালামালের খোঁজে তল্লাশি চালাবে? ঠিক সেভাবেই পুলিশ যদি অনলাইন হ্যাকিং সম্পর্কে তথ্য পায় ও হ্যাকারের অবস্থান খুঁজে পায়, তাহলে ওয়ারেন্টের জন্য অপেক্ষা করা উচিত নাকি তাৎক্ষণিক তাকে থামানো উচিত?’ জয় বলেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশিরভাগ দেশেই পুলিশ যদি কাউকে অপরাধমূলক কর্মকা-ের সময় অনলাইনে ট্র্যাক করতে পারে, তাহলে তাকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেফতার করতে ও তল্লাশি চালাতে পারে। শুধু অপরাধ সংঘটিত হয়ে যাওয়ার পর যদি গ্রেফতার বা তল্লাশি চালাতে হয়, তখন ওয়ারেন্টের প্রয়োজন পড়ে। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সময় ধরা পড়লে কখনই ওয়ারেন্টের প্রয়োজন পড়ে না। তিনি বলেন, ‘সর্বশেষ, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করা নিয়ে যে ধারা সেটা নিয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে। আমি একমত, এখানে আসলে আদালতকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সত্য আর মিথ্যা নির্ণয় করার। কিন্তু, এই ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাস। প্রেসক্লাব, সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিকদের কোন সংগঠনই কিন্তু তাদের নিজেদের নৈতিকতার সনদ বা আচরণবিধি প্রয়োগ করতে পারেনি। সম্পাদক পরিষদের বর্তমান প্রধান মাহফুজ আনাম, যিনি টেলিভিশনের পর্দায় স্বীকার করেছেন ১/১১-এর সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক সংবাদ প্রচারের কথা। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নে হলে তাকে বাধ্য করা হতো সাংবাদিকতা পেশা থেকে পদত্যাগ করতে। শুধু তাই নয়, তাকে আর কোনদিন সম্পাদক বা সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হতো না। বাংলাদেশে কিন্তু সম্পাদক পরিষদ উল্টো তার পক্ষ নিয়েই তাকে তাদের জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত করেছে। বিষয়টি আমাকে অবাক করে। যেহেতু, ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র মিশন এই আইন নিয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেছে, আমি আশা করব তারা মাহফুজ আনামের স্বীকারোক্তির পরেও একটি প্রথম সারির পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত থাকা নিয়েও তাদের মতামত জানাবেন। তা না হলে, তাদের কার্যকলাপ হবে একপেশে ও আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। এই বিষয়টিকে থেকে আমরা সম্পাদক পরিষদের নৈতিকতা সম্পর্কে কি ধারণা পাই? পরিষ্কারভাবেই, তাদের নৈতিকতা বলে কিছু নেই। বস্তুত, সম্পাদক পরিষদ বলতে চায়, তাদের সরকারের বিরুদ্ধে নোংরা, মিথ্যা প্রচারণা চালাতে দিতে হবে এবং সত্য অবলম্বন না করেই তাদের অপছন্দের রাজনীতিকদের সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে দিতে হবে। তারা যদি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এমন পরিকল্পনা করেন, তাহলে দেশের ভবিষ্যত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়?’ আইসিটি উপদেষ্টা বলেন, যেহেতু গণমাধ্যমের সম্পাদকরা তাদের নিজেদের তৈরি নৈতিক নির্দেশনাই মানতে রাজি নন, তাহলে আমরা সত্য-মিথ্যা নির্ধারণের ভার আদালতের হাতেই তুলে দেই। গ্রেফতার মানেই জেল নয়। সরকারের প্রমাণ করতে হবে যে আসামি জেনেশুনে মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করেছেন। প্রমাণের দায়ভার সরকারের। যে সব সাংবাদিকের মিথ্যা সংবাদ ছাপানোর উদ্দেশ্য নেই, তাদের ভয়েরও কিছু নেই। সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, সম্পাদক পরিষদ যদি এসব ধারার সংশোধন চান, তাহলে তাদের নিজেদের নৈতিকতার নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে হবে। যে সম্পাদক বা সংবাদকর্মী মিথ্যা সংবাদ ছেপেছেন, তাকে অবশ্যই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে হবে এবং ভবিষ্যতে যাতে আর কোনদিন সংবাদ তৈরি বা প্রচারের কাজ করতে না পারেন সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
×