ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে পূর্বাভাস

জিডিপি ৭ শতাংশ হতে পারে ॥ চলতি অর্থ বছর

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৩ অক্টোবর ২০১৮

জিডিপি ৭ শতাংশ হতে পারে ॥ চলতি অর্থ বছর

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চলতি অর্থবছরে (২০১৮-১৯) বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে জানিয়েছে বিশ^ ব্যাংক। একই সঙ্গে এই প্রবৃদ্ধির সুফল কারা পাচ্ছে তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। এছাড়াও, দেশের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া নিয়েও উদ্বেগ জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। মঙ্গলবার সকালে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ প্রতিবেদনে এই ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেয়া হয়। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি, বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং রফতানি ও রেমিটেন্সের ইতিবাচক ধারা এই ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনে অবদান রাখবে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ভাল প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। আগামীতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আমরা মনে করছি। তবে এজন্য আর্থিক খাতে বেশ কিছু সংস্কার করতে হবে। এর মধ্যে ব্যাংক খাতের বিশাল অঙ্কের খেলাপি ঋণ আদায়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং মেগা প্রকল্পের কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করার কথা বলেন তিনি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার ৭ দশমিক ৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে। যা গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এই হার ছিল ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। সেপ্টেম্বরের শেষে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ এবার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পেতে পারে। বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ নিয়ে বিশ্বব্যাংক জানায়, বেসরকারী খাতে বিপুল বিনিয়োগ দরকার। বড় অবকাঠামোতে আরও সরকারী-বেসরকারী বিনিয়োগ করতে হবে। প্রবাসী আয় ও রফতানিতে আয় বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। রাজস্ব আদায় বৃদ্ধিতে নতুন ভ্যাট আইনটি বাস্তবায়ন করা জরুরী। বিদ্যুতের লোড ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে কার্যকর করতে পারলে বছরে ১৬৫ কোটি ডলারের সমপরিমাণ তেলের দাম সাশ্রয় করা সম্ভব। প্রধান প্রধান রফতানি বাজারে সীমিত হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় দাতাদের অর্থায়নের ওপর জোর দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আর্থিক খাতে সুশাসন বিশেষ করে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আরও উন্নতি করার তাগিদ দিয়েছে এই সংস্থাটি। এদিকে, প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বিশ্বব্যাংক আরও বলছে, খেলাপি ঋণ পুনর্তফসিল অব্যাহত থাকলে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি বেড়ে যাবে। এতে করে বাজেটে চাপ বাড়বে। এজন্য আর্থিক খাতে সংস্কার আনতে হবে। খেলাপি ঋণের দিকে নজর দিতে হবে। এই মুহূর্তে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৪ শতাংশে। ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মোট ঋণের ৪৮ শতাংশই খেলাপি ঋণ। এছাড়া, ৪০টি বেসরকারী ব্যাংকের বড় অংশই খেলাপি ঋণ। ব্যাংক খাতের এই বিশাল ঋণ আদায়ে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, রফতানি খাত ও রেমিট্যান্স প্রবাহে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়ালেও ব্যাংকিং খাতের বোঝা অব্যাহত রয়েছে। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এতে বলা হয়, যাদের জন্য বিভিন্ন সেক্টরে সরকার ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে তারা পাচ্ছেন কি না তা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বব্যাংক বলছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিদ্যুত খাতে জোর দিতে হবে। এক হিসেবে বিশ্বব্যাংক জানায়, ২০১১-২০১৭ সাল পর্যন্ত ৪৭ শতাংশ মানুষ নতুন করে বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। এ সময়ের মধ্যে বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়েছে ৮০ শতাংশ। ২০৩০ সালে বিদ্যুতের চাহিদা মোকাবেলায় এখন থেকেই উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে। বিদ্যুত খাতের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি দক্ষতা বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে জ্বালানি ব্যবহারের অপচয়রোধ করতে হবে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয় বাংলাদেশে গ্যাসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় ৬-৭ গুণ কম। গ্যাস ব্যবহারে অপচয়রোধ করা গেলে ১৫ শতাংশ বিদ্যুত উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব বলে জানানো হয়। বিশ্বব্যাংক জানায়, বাংলাদেশ দ্রুত উন্নয়ন করছে। উন্নয়ন ধরে রাখতে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। রফতানি ও রেমিটেন্সে প্রবৃদ্ধি যেন কমে না যায় সেদিকে নজর রাখতে হবে। বিশ্বের ১০টি উদীয়মান দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। এজন্য শিক্ষা, প্রযুক্তি, মানবসম্পদ উন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে। বিশ্ব ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী সংস্কারের ক্ষেত্রে যদি সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল থাকে, বিদ্যুতের চাহিদার সঙ্গে যোগান সমন্বয় করা গেলে অর্থনীতি এগিয়ে যাবে। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)‘র নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, জিডিপি‘র গ্রোথ সরকারী হিসাবে ৮ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। এটা নিয়ে কিছু প্রশ্ন রয়েছে, এখানে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। গত কয়েক বছরে রফতানি আয় হতাশাজনক। জিডিপি’র তুলনায় রফতানি প্রবৃদ্ধি কম হলে কিভাবে প্রবৃদ্ধি বাড়বে ? তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রেমিট্যান্স কমছে, বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না। তিনি বলেন, ব্যাংকের নয়-ছয় পলিসি নির্ধারণ কোন কাজে আসেনি। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এই অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। আহসান এইচ মনসুর, সরকারের গৃহীত বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টের গুণগত মান ও খরচ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে এসব মেগা প্রকল্প থেকে কী ধরনের অর্থনৈতিক সুফল আসবে, তা নিয়ে চূড়ান্ত কোন হিসাব এখনও করা হয়নি। রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র, মেট্রোরেল ও পদ্মা সেতুর যেভাবে ব্যয় বাড়ছে তা কতটা যৌক্তিক তা ভেবে দেখতে হবে। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর কিমিয়াও ফান বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে। এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরও এগিয়ে নেয়া সম্ভব। এজন্য আর্থিক খাতের বেশ কিছু ইস্যুতে সংস্কার আনা প্রয়োজন। জাতীয় নির্বাচন অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর বলেন, সব দেশই নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি খুবই ভাল। কিন্তু এটি সংখ্যা দিয়ে বিবেচনা না করে, মান দিয়ে বিবেচনা করা উচিত। পাওয়ার এ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে কি না সেগুলো ভেবে দেখতে হবে। কেননা বাংলাদেশে এখনও ১৯ মিলিয়ন লোক চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করছে। সাড়ে ৫ মিলিয়ন শিশু এবং ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন নারী অপুষ্টিতে ভুগছে। তিনি বলেন, আমাদের প্রবৃদ্ধির হার নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। কাদের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, প্রবৃদ্ধির সুফল কার কাছে যাচ্ছে, সেটা বের করতে হবে। প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাংকের আঞ্চলিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
×