ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

জনবান্ধব ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প হঠাৎ জনবল সঙ্কটে

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ২ অক্টোবর ২০১৮

জনবান্ধব ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প হঠাৎ জনবল সঙ্কটে

তপন বিশ্বাস ॥ জনবলের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে চলছে প্রধানমন্ত্রীর সর্বাধিক অগ্রাধিকার প্রকল্প ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ কার্যক্রম। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে রয়েছে প্রায় ৬ হাজার জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া। অর্ধেক জনবল নিয়ে অল্প সময়ে জনপ্রিয় হওয়া জনবান্ধব এই প্রকল্পটি উপকারভোগীদের হতাশ করছে। প্রধানমন্ত্রী দেশের উন্নয়নে দশটি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন যার প্রথমটি হলো একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এ উদ্যোগটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছে। এ উদ্যোগের মাধ্যমে দেশে এমনকি পৃথিবীতে এই প্রথমবারের মতো দরিদ্র মানুষের নিজস্ব সঞ্চয়ের সঙ্গে সরকার হতে অনুদান প্রদান করে স্থায়ী তহবিল গড়ে দেয়া হচ্ছে। যা গরিব মানুষেরা স্থায়ীভাবে আয়বর্ধক কাজে বিনিয়োগ করে দারিদ্র্য বিমোচন করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর এ বিশেষ উদ্যোগ দরিদ্র মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বিগত ৬/৭ বছরে দেশের ৩৬ লাখ গরিব মানুষ সঞ্চয় জমা করেছেন ১৩৩০ কোটি টাকা। সরকার হতে এর বিপরীতে অনুদান দেয়া হয়েছে ১১২৩ কোটি টাকা। আর ৩৬ লাখ সদস্য নিয়ে গড়া প্রায় ৭৫ হাজার গ্রাম সমিতিকে অনুদান দেয়া হয়েছে প্রায় ১৬০০ কোটি টাকা। আগামী দুই বছরে আরও প্রায় ২৫ লাখ দরিদ্র মানুষকে এ প্রকল্পের আওতায় আনার পরিকল্পনা আছে। দেশব্যাপী প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস্তবায়িত এ বিশেষ উদ্যোগটি বর্তমানে জনবলের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে চলছে। প্রকল্পের ১১৭৩৭ জনবলের মধ্যে বর্তমানে কর্মরত আছে মাত্র ৫৫২৮। এ প্রকল্পের কাজের বৈশিষ্ট্যের কারণে অর্থাৎ দরিদ্র মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে গ্রাম সমিতির আওতায় আনা, তাদের কাছ থেকে সঞ্চয় আদায় করা, তাদের মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ এবং তা যথাসময়ে আদায় করা, আবার পুন বিনিয়োগ করা-এ ধরনের কাজ বাস্তবায়নে সর্বক্ষণিক নিবিড় তদারকির প্রয়োজন হয়। তাছাড়া এ কাজ সুষ্ঠু বাস্তবায়ন কোনভাবেই সম্ভব না। প্রকল্পের প্রথম ও ২য় পর্যায়ে (২০০৯-২০১৬ মেয়াদে) গঠিত ৪০২১৬ গ্রাম উন্নয়ন সমিতির ২২ লাখ সদস্যের কাজ তদারকির জন্য ২০১৪ সালে ৪৫০৩ মাঠ সহকারী নিয়োগ দেয়া হয় প্রতি ইউনিয়নে একজন করে। এ সকল সমিতি, সদস্য ও তার তহবিল পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে স্থানান্তর করে দেয়া হয়েছে। আর ২০১৭-২০ মেয়াদে আরও ৬০ হাজার সমিতি গঠন এবং ৩৬ লাখ সদস্য অন্তর্ভুক্তির কাজ চলছে। অথচ প্রথম ও ২য় পর্যায়ে গঠিত সমিতির কাজ দেখার জন্য ৪৫০৩ জন মাঠ সহকারীর মধ্যে বর্তমানে কর্মরত আছে মাত্র ৩৮৪২। এদেরকে আবার তৃতীয় পর্যায়ের সমিতি গঠন ও সদস্য অন্তর্ভুক্তিসহ যাবতীয় কাজ তদারকি করতে হচ্ছে। যেখানে ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি ৪০০ সদস্যের জন্য ১ জন করে কর্মী নিয়োগ করে থাকে সেখানে প্রধানমন্ত্রীর এ বিশেষ উদ্যোগের কাজ তদারকির জন্য ১জন কর্মীর ঘাড়ে এখন গড়ে ১ হাজার সদস্যের কাজ তদারকি করতে হচ্ছে এবং একই সঙ্গে চলতি অর্থ বছরে আরও ২৫ লাখ সদস্য অন্তর্ভুক্তির কাজও তদারকি করতে হচ্ছে। যা একজন মাঠ কর্মীর পক্ষে সুষ্ঠুভাবে করা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। প্রকল্প এবং পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কাজে সৃষ্ট হয়েছে জগাখিচুড়ি অবস্থা। ২০১৬ সালে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে স্থানান্তরিত অংশে খেলাপী ঋণের হার ছিল ৪৭% তা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭১% এবং তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এটা অতি স্বাভাবিক ঘটনা। নিবিড় তদারকি ছাড়া ঋণ খেলাপী কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প কর্তৃপক্ষ বছর খানেক আগে প্রায় ৬ হাজার জনবল নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছিল। বিগত ২০১৭ সালের অক্টোবর-নবেম্বরে সারাদেশে প্রায় ১০ লক্ষাধিক নিয়োগ প্রার্থীর নিয়োগ পরীক্ষা অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে গ্রহণ সম্পন্ন করেছিল। তখন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সংবাদপত্রে এ নিয়োগ কার্যক্রমের ভূয়সী প্রশংসা করা হয় এবং পদ্ধতিকে আকবর পদ্ধতি নামেও অনেকে অভিহিত করে। সুষ্ঠু নিয়োগ পরীক্ষা নেয়ার পর সারাদেশে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে কিন্তু রহস্যজনক কারণে নিয়োগ প্রদান করা হচ্ছে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক আকবর হোসেন কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। বিশ্বাসযোগ্য সূত্রে জানা গেছে নিয়োগ বাণিজ্য করতে না পেরে কিছু অসাধু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিয়োগ কার্যক্রমকে বিতর্কিত করার মিশনে নেমেছে। যার ফল সমস্ত নিয়োগ কার্যক্রমের ওপর স্থবিরতা নেমে এসেছে। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগ তথা দেশের দরিদ্র মানুষ। অবিলম্বে প্রকল্পে জনবল নিয়োগ দিতে না পারলে অগ্রাধিকারমূলক এ প্রকল্পটি আরও দুস্থ হয়ে পড়বে। পাশাপাশি পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকও একটি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের কর্মচারী যারা ৩০ জুন ২০১৬ তারিখে কর্মরত ছিল তাদের পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে নিয়োগ দেয়ার জন্য বিগত ২২ মার্চ ২০১৭ তারিখে প্রকল্প ও ব্যাংকের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। কিন্তু দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলে প্রকল্পের কর্মচারীদের এখনও ব্যাংকে নিয়োগ প্রদান করা হয়নি। এ নিয়ে প্রকল্পের কর্মচারীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে হতাশা। তারা অনেকেই মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েছেন। জানা যায় এ পর্যন্ত ১৯ রিট মামলা হয়েছে ব্যাংক ও প্রকল্পের বিরুদ্ধে। তিনটি মামলায় ব্যাংকের বিরুদ্ধে রায়ও হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে এখানেও জনবল ব্যাংকে নিয়োগে বিলম্ব হচ্ছে। আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দরিদ্র সদস্যগণ। সত্ব¡র এ পরিস্থিতি হতে উত্তরণ না হলে প্রকল্প ও ব্যাংক উভয় প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে যাবে। ব্যর্থ হবে প্রধানমন্ত্রীর ১নং বিশেষ উদ্যোগ যার সফল বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এসডিজি অভীষ্ট ১ ও ২ ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচন। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আকবর হোসেন যিনি প্রকল্পেরও পরিচালককে ব্যাংকের বর্তমান অবস্থা অবহিত করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জনবল ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে চালানো সম্ভব নয়। কেন জনবল নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার নিয়োগের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির। ২৭৮ সিনিয়র অফিসার পদে জনবল নিয়োগ কার্যক্রম চলমান আছে। প্রকল্পের জনবল যাচাই বাছাই সম্পন্ন হয়েছে। খুব শীঘ্রই তাদের প্রকল্প হতে ব্যাংকে নিয়োগ শুরু হবে। তবে তিনি জানান, ব্যাংকে নিয়োগ হলেও তাদের প্রকল্প এবং ব্যাংক উভয় প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে হবে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পারফর্ম করতে হবে। অন্যথায় কোন প্রতিষ্ঠানের কাজই সুষ্ঠুভাবে করা যাবে না। তিনি আশা প্রকাশ করেন জনবল নিয়োগ হয়ে গেলে সমস্যা আস্তে আস্তে কেটে যাবে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ এ উদ্যোগ সফলভাবে বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা করছি।
×