ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাহরিয়ার কবির

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধুর অবদান

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ২ অক্টোবর ২০১৮

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধুর অবদান

যে সব রাজনীতিবিদ ইতিহাসের গতি নির্ধারণ করেছেন, শান্তি, মানবতা ও সাম্যপ্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাদের ভেতর আমাদের উপমহাদেশে যে দু’জনের নাম তালিকার শীর্ষে থাকবেÑ তাঁরা হলেন ভারত ও বাংলাদেশের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মহাত্মা গান্ধী শুধু পুরোগামী নেতাই ছিলেন না, তাঁর প্রবর্তিত অহিংস অসহযোগ আন্দোলন বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মানবতাবাদী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকেও অনুপ্রাণিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মানুষের সমান অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অবিস্মরণীয় নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তিসংগ্রামের প্রধান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা তাঁদের আন্দোলন ও সংগ্রামে গান্ধীর আদর্শিক প্রেরণার কথা অকুণ্ঠ চিত্তে স্বীকার করেছেন। জাতিসংঘ ২০০৭ সালে গান্ধীর জন্মদিন ২ অক্টোবরকে ‘আন্তর্জাতিক অহিংস দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। নিজের জীবন ও দর্শন সম্পর্কে গান্ধী কম লেখেননি। তাঁর সম্পর্কে এর শতগুণ লিখেছেন ভারত এবং পশ্চিমের লেখকরা। সোয়া শ’ কোটি ভারতীয়র মহান নেতা হিসেবে বিশ্বব্যাপী গান্ধী সম্পর্কে যা লেখা হয়েছে, বাংলাদেশের ১৭ কোটি বাঙালীর নেতা এবং এশিয়ার প্রথম জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে দেশের বাইরে ততটা লেখা হয়নি বটে, তবে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাকামী বাঙালীর অবিসংবাদী নেতা হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম ছিলেন। গান্ধী তাঁর প্রথম জীবনের ২০ বছর কাটিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকায়, যেখানে তিনি আইন পেশার পাশাপাশি ব্রিটিশ শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় ও কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার ও মর্যাদার জন্য আন্দোলন করেছেন। তাঁর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ধারণা ও প্রয়োগের সূচনা হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। ১৯১৩ সালে স্বদেশে ফিরে গান্ধী যখন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন, তখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম দুই ধারায় বিভক্ত ছিল। বাল গঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে কংগ্রেসে এবং কংগ্রেসের বাইরেও সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী চরমপন্থী ধারা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী। গান্ধী চরমপন্থায় বিশ্বাস করতেন না। তাঁর অহিংস অসহযোগ আন্দোলন যখনই সহিংস হয়েছে, তখনই তিনি আন্দোলন বন্ধ করে দিয়েছেন। ১৯২০ সালে লোকমান্য তিলকের মৃত্যুর পর থেকে মহাত্মা গান্ধী আমৃত্যু কংগ্রেসের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নেতা হলেও তাঁর নেতৃত্ব বার বার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। লালা লাজপৎ রায়, এ্যানি বেসান্ত, বিপিণ চন্দ্র পাল, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এবং সবশেষে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু প্রমুখ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরোগামী নেতৃবৃন্দ মহাত্মা গান্ধীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন না। নরমপন্থা এবং চরমপন্থা ছাড়াও তিলক ও গান্ধীর চিন্তার মৌলিক পার্থক্য ছিল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের স্বরূপ বিশ্লেষণে। তিলক, লাজপৎ রায় এবং তাদের অনুসারী অধিকাংশ চরমপন্থী নেতা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। গান্ধী হিন্দুত্ববাদী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন না। তিনি সব ধর্মের সমন্বয়ে ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন। পক্ষান্তরে জওহরলাল নেহরু ছিলেন রাজনীতি এবং রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে পৃথক রাখার পক্ষপাতী । ভারতবর্ষের সব ধর্মের অনুসারী, বিশেষভাবে দুই প্রধান ধর্মের অনুসারী হিন্দু ও মুসলমানদের ঐক্যের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেছিলেন গান্ধী। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য তিনি বার বার অনশন করে মানুষের শ্রেয়চেতনা জাগ্রত করতে চেয়েছেন। আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য তিনি সর্বধর্মীয় প্রার্থনার প্রচলন করেছিলেন ভারতবর্ষে। ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতের বিভাজন তিনি কখনও সমর্থন করেননি। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভারত সরকার কর্তৃক পাকিস্তানকে প্রাপ্য অর্থ প্রদানে বিলম্ব করার প্রতিবাদে গান্ধী অনশন করেছিলেন, যা হিন্দু মৌলবাদীরা পছন্দ করেনি। ১৯৪৮ সালে গান্ধীকে হত্যার পর হিন্দুত্ববাদী ঘাতক নাথুরাম গডসে বলেছিলেন ‘গান্ধী এমনভাবে মুসলিম তোষণ আরম্ভ করেছিলেন যে, আমার রক্ত টগবগ করে ফুটছিল। নিজেকে আমি সংযত করতে পারিনি।’ মৃত্যুর আগে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও শান্তির জন্য দিল্লীর বিড়লা ভবনে গান্ধী সর্বধর্মীয় প্রার্থনা সভা পরিচালনা করেছিলেন। প্রার্থনা সভাকক্ষ থেকে বেরুবার পর তাঁকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা মুসলিম লীগ থেকে হলেও ব্যক্তিজীবনে তিনি অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে ছাত্রজীবনে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে থাকলেও জিন্নাহর ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতা ও প্রতারণা তিনি এই সাম্প্রদায়িক কৃত্রিম রাষ্ট্র সৃষ্টির এক বছরের ভেতরই উপলব্ধি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং তাঁর সম্পর্কে পাকিস্তানী গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকেও আমরা জেনেছি, তাঁর অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী চরিত্র সম্পর্কে। তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্রে। বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তানের উপনিবেশসুলভ শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে সব সময় সরব ছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালীর মুক্তি নেই- এই সত্য তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগেই উপলব্ধি করেছেন। ১৯৬২ সালে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে তরুণদের সচেতন করার জন্য দলের তরুণ নেতাদের নিয়ে গোপন নিউক্লিয়াস গঠন করেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য বঙ্গবন্ধু প্রকাশ্যে পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতর নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি করেছেন। গান্ধী, মার্টিন লুথার ও ম্যান্ডেলার মতো অহিংসবাদী নেতারা যেভাবে বার বার কারাবরণ করেছেন, বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। তিনি পাকিস্তানের কাঠামোর ভেতর ছয় দফার মাধ্যমে স্বাধীকার ও স্বায়ত্তশাসনের ধারণা জনপ্রিয় করেছেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। অন্যদিকে গোপনে তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। সশস্ত্র সংগ্রামের প্রেরণা তিনি পেয়েছেন সূর্য সেন, ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতা, বাঘা যতীন এবং সর্বোপরি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর কাছ থেকে। নেতাজীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর অনুরাগের কথা তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে রয়েছে। নেতাজী ও মহাত্মা গান্ধী ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বের শীর্ষে অবস্থান করলেও স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে তাঁদের পথ ছিল বিপরীতমুখী। গান্ধী কখনও সুভাষ বসুর সশস্ত্র সংগ্রামের নীতি সমর্থন করেননি। অন্যদিকে সুভাষ বসু ছিলেন গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের কঠোর সমালোচক। কংগ্রেসে নরমপন্থা ও চরমপন্থার বিরোধ এই দলের জন্মলগ্ন থেকেই ছিল। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য বঙ্গবন্ধু যে নীতি ও কৌশল অবলম্বন করেছিলেন, সেখানে তাঁর পূর্বসূরি দুই নেতা গান্ধী ও সুভাষ বসুর মিলিত প্রভাব ছিল বটে, তবে তিনি এই দুই নেতার শান্তি ও সংগ্রামের রণনীতি নিজের মতো করে গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের পরও পাকিস্তানী শাসকরা যখন নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি প্রকাশ করে, তখন ’৭১-এর মার্চের ১ তারিখ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু যে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনা করেছেন, উপমহাদেশের ইতিহাসে তার দ্বিতীয় নজির নেই। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় সরকারের সব কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দলের নির্দেশে। ক্যান্টনমেন্টের বাইরে সব সরকারী দফতর, ব্যাংক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, পরিবহন ও যোগাযোগ মাধ্যমেÑ সব কিছু স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিচালিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে, যার জন্য কোন রকম শক্তি প্রয়োগ করতে হয়নি। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারকে যে বয়কট বা অসহযোগের ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং যা অক্ষরে অক্ষরে কার্যকর হয়েছিল, বিশ্বের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে তা বিরল। বিশ্বশান্তির প্রতি বঙ্গবন্ধুর দায়বদ্ধতার পরিচয় তাঁর আত্মজীবনীতেই পাওয়া যাবে। ১৯৫৪ সালে চীনের রাজধানী বেজিং (তৎকালীন নাম পিকিং)-এ আয়োজিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে যুবক মুজিব চীন গিয়েছিলেন। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেনÑ ‘শান্তি সম্মেলন শুরু হলো। তিন শ’ আটাত্তর জন সদস্য সাঁইত্রিশটা দেশ থেকে যোগদান করেছে। সাঁইত্রিশটা দেশের পতাকা উড়ছে। শান্তির কপোত এঁকে সমস্ত হলটা সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে। প্রত্যেক টেবিলে হেডফোন আছে। আমরা পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা একপাশে বসেছি। বিভিন্ন দেশের নেতারা বক্তৃতা করতে শুরু করলেন। প্রত্যেক দেশের একজন বা দুজন সভাপতিত্ব করতেন। বক্তৃতা চলছে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও অনেকেই বক্তৃতা করলেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আতাউর রহমান খান ও আমি বক্তৃতা করলাম। আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম। আতাউর রহমান সাহেব ইংরেজী করে দিলেন। ইংরেজী থেকে চীনা, রুশ ও স্পেনিশ ভাষায় প্রতিনিধিরা শুনবেন। কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না? ভারত থেকে মনোজ বসু বাংলায় বক্তৃতা করেছেন। পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ায় অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজীতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য। আমার বক্তৃতার পরে মনোজ বসু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ভাই মুজিব, আজ আমরা দুই দেশের লোক, কিন্তু আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে কেউ পারে নাই। আর পারবেও না। তোমরা বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছ আমরা বাংলা ভাষাভাষী ভারতবর্ষের লোকেরাও তার জন্য গর্ব অনুভব করি।’ ‘বক্তৃতার পর, খন্দকার ইলিয়াস তো আমার গলাই ছাড়ে না। যদিও আমরা পরামর্শ করেই বক্তৃতা ঠিক করেছি। ক্ষিতীশ বাবু পিরোজপুরের লোক ছিলেন, বাংলা গানে মাতিয়ে তুলেছেন। সবাইকে বললেন, বাংলা ভাষাই আমাদের গর্ব।... কতগুলো কমিশনে সমস্ত কনফারেন্স ভাগ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন রুমে বসা হলো। আমিও একটা কমিশনের সদস্য ছিলাম। আলোচনায় যোগদানও করেছিলাম। কমিশনগুলোর মতামত জানিয়ে দেয়া হলো ড্রাফট কমিটির কাছে। প্রস্তাবগুলো ড্রাফট করে আবার সাধারণ অধিবেশনে পেশ করা হলো এবং সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হলো। ‘মানিক ভাই কমিশনে বসতেন না বললেই চলে। তিনি বলতেন, প্রস্তাব ঠিক হয়েই আছে। কনফারেন্সের শেষ হওয়ার পর, এক জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল। বিরাট জনসভায় প্রত্যেক দেশের প্রতিনিধিÑ দলের নেতারা বক্তৃতা করলেন এবং সকলের এক কথা, ‘শান্তি চাই, যুদ্ধ চাই না।’ বিভিন্ন ধর্মের লোকেরাও যোগদান করেছিল আলদা আলাদাভাবে শোভাযাত্রা করে। চীনে কনফুসিয়ান ধর্মের লোকেরা সংখ্যায় বেশি। তারপর বৌদ্ধ, মুসলমানের সংখ্যাও কম না, কিছু খ্রীস্টানও আছে। একটা মসজিদে গিয়েছিলাম, তারা বললেন, ধর্মকর্মে বাধা দেয় না এবং সাহায্যও করে না। আমার মনে হলো, জনসভায় তাহেরা মাজহারের বক্তৃতা খুবই ভাল হয়েছিল। তিনি একমাত্র মহিলা পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বক্তৃতা করেছিলেন। তাঁর বক্তৃতার পরে পাকিস্তানের ইজ্জত অনেকটা বেড়েছিল।.... ‘আমরা স্বাধীন হয়েছি ১৯৪৭ সালে আর চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে। যে মনোভাব পাকিস্তানের জনগণের ছিল, স্বাধীনতা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আজ যেন তা ঝিমিয়ে গেছে। সরকার তা ব্যবহার না করে তাকে চেপে মারার চেষ্টা করেছে। আর চীনের সরকার জনগণকে ব্যবহার করছে তাদের দেশের উন্নয়নমূলক কাজে। তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হলো, তাদের জনগণ জানতে পারল ও অনুভব করতে পারল এই দেশ এবং এ দেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর, আর তারা যেন কেউই নন। ফলে দেশের জনগণের মধ্যে ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। একটা মাত্র পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল সাদা চামড়ার জায়গায় কালা চামড়ার আমদানি হয়েছে। ‘চীনের জনগণ সরকারের কাজে সাহায্য করছে এটা বুঝতে কষ্ট হলো না। জনমত দেখলাম চীন সরকারের সঙ্গে। চীন সরকার নিজেকে ‘কমিউনিস্ট সরকার’ বলে ঘোষণা করেনি, তারা তাদের সরকারকে ‘নতুন গণতন্ত্রের কোয়ালিশন সরকার’ বলে থাকে। কমিউনিস্ট ছাড়াও অন্য মতাবলম্বী লোকও সরকারের মধ্যে আছে। যদিও আমার মনে হলো কমিউনিস্টরা নিয়ন্ত্রণ করছে সব কিছুই। আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্বশান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা। যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে যারা আবদ্ধ ছিল, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যাদের সর্বস্ব লুট করেছেÑ তাদের প্রয়োজন নিজের দেশকে গড়া ও জনগণের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তির দিকে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। বিশ্বশান্তির জন্য জনমত সৃষ্টি করা তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।’ ১৯৫৪ সালে বিশ্বশান্তি সম্মেলন উপলক্ষে চীন সফরে গিয়ে বঙ্গবন্ধু মাও সেতুঙের নেতৃত্বে নয়াচীনের সাফল্য ও অগ্রযাত্রায় মুগ্ধ হয়েছেন। আবার ’৬৬ সালে পাকিস্তানের সামরিক সরকারকে চীনের সমর্থনের কঠোর সমালোচনা করেছেন তিনি। তাঁর ‘কারাগারের রোজনামচা’য় এ বিষয়ে তাঁর পর্যবেক্ষণ প্রণিধানযোগ্য ‘চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই রাওয়ালপিন্ডি গিয়েছেন আইয়ুব সাহেবের সঙ্গে নতুন পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনা করার জন্য। আপনাকে আমরাও স্বাগতম জানাই। চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব আমরাও কামনা করি। তবে দয়া করে সার্টিফিকেট দেবেন না। আগে আপনি ও আপনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বড় বড় সার্টিফিকেট দিয়ে গিয়াছেন। লাভ হবে না। আপনারা জনগণের মুক্তিতে বিশ্বাস করেন, আর যে সরকার জনগণের অধিকার কেড়ে নিয়েছে তাদের সার্টিফিকেট দেয়া আপনাদের উচিত না। এতে অন্য দেশের ভেতরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা হয়। এই ব্যাপারে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ ও আপনাদের পথ এক না হওয়াই উচিত। ‘১৯৫৭ সালে আমি পাকিস্তান পার্লামেন্টারি ডেলিগেশনে নেতা হিসেবে চীন দেশে যাই। আপনি, আপনার সরকার ও জনগণ আমাকে ও আমার দলের সদস্যদের যথেষ্ট আদর আপ্যায়ন করেছেন এবং আমাকে আপনাদের পার্লামেন্টে বক্তৃতা দিতে দিয়ে যে সম্মান দিয়েছিলেন তা আজও আমি ভুলি নাই। আমি আপনাদের উন্নতি কামনা করি। নিজের দেশে যে নীতি আপনারা গ্রহণ করেছেন আশা করি অন্য দেশে অন্য নীতি গ্রহণ করবেন না। আপনারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন আর আমার দেশে চলেছে ধনতন্ত্রবাদ, আর ধনতন্ত্রবাদের মুখপাত্রকে আপনারা দিতেছেন সার্টিফিকেট। আপনারা আমেরিকান সরকারের মতো নীতিবহির্ভূত কাজকে প্রশ্রয় দিতেছেন। দুনিয়ার শোষিত জনসাধারণ আপনাদের কাছ থেকে অনেক কিছু আশা করেছিলেন। যেমন আমেরিকানরা নিজের দেশে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, আর অন্যের দেশে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য গণতন্ত্রকে হত্যা করে ডিক্টেটর বসাইয়া দেয়।’ চীনের সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর মোহভঙ্গ হয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পাঁচ বছর আগে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে চীন সমাজতন্ত্র ও বিশ্বশান্তির প্রতি দায়বদ্ধ থাকার অঙ্গীকার জলাঞ্জলি দিয়ে পাকিস্তানী সামরিক জান্তাকে মদদ দিয়েছে বাংলাদেশে নৃশংসতম গণহত্যা সংঘটনে। মহাত্মা গান্ধী বিশ্বের অশান্তি দূর করার জন্য আত্মশুদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। সাম্রাজ্যবাদ বা ‘পুঁজিবাদের শোষণ-পীড়ন সম্পর্কে তিনি কখনও সোচ্চার ছিলেন না, যতটা ছিলেন ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে শান্তিপূর্ণভাবে মুক্তির বিষয়ে। ১৯৫৪ সালে বঙ্গবন্ধু লিখছেন পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্বশান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা।’ নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণভাবে স্বাধীনতার সংগ্রাম সফল না হলে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ অবলম্বন করতে হবেÑ এই বোধ নেতাজী সুভাষ বসুর ছিল, বঙ্গবন্ধুর ছিল। তবে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বোধ শুধু ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি নয়, তা ছিল জনগণের সার্বিক মুক্তির অন্তর্গত। এ কারণে বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে সার্বিক মুক্তির সংগ্রাম যোগ করেছিলেন, যে মুক্তির নিদান স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে রেখেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর কাছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা শুধু রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য নয়Ñ তা ছিল বিশ্বশান্তির পূর্বশর্ত। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে ১০ জানুয়ারি লণ্ডন হয়ে স্বদেশে ফেরার পথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অনুরোধে বঙ্গবন্ধু কিছু সময়ের জন্য দিল্লীতে যাত্রাবিরতি করেছিলেন। তাঁকে লন্ডনে প্রশ্ন করা হয়েছিলÑ ভারত কেন বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধে এত সাহায্য সহযোগিতা করেছে, ভারতের সঙ্গে তাঁর কী সম্পর্ক? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অতুলনীয় সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধু ভারতের সরকার, সশস্ত্র বাহিনী, জনগণ এবং বিশেষভাবে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে ১০ জানুয়ারি (১৯৭২) দিল্লীতে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেছিলেন, আমি বিশ্বাস করি, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও তা বিশ্বাস করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের এই মিলÑ নীতির মিল, আদর্শের মিল, বিশ্বশান্তির জন্য এই মিল।’ ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন বিশ্বনেতৃবৃন্দ। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্তÑ শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ বঙ্গবন্ধুর শোষণ-পীড়নমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রকে বিবেচনা করেছেন বিশ্বশান্তির পূর্বশর্ত হিসেবে। মহাত্মা গান্ধী ধর্মবিশ্বাস, আত্মশুদ্ধি এবং পরমতসহিষ্ণুতার ভেতর বিশ্বশান্তির নিদান খুঁজেছেন। পথ ভিন্ন হলেও তাঁরা দুজনেই বিশ্বশান্তির আন্দোলনে সব সময় আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন। ১ অক্টোবর ২০১৮
×