ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিগন্যাল সামলাতেই ব্যস্ত পুলিশ! অল্প কদিন ছিল ঠিকঠাক

বেপরোয়া চালক পথচারী- রুখবে কে?

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ১ অক্টোবর ২০১৮

বেপরোয়া চালক পথচারী- রুখবে কে?

রাজন ভট্টাচার্য ॥ ‘নিয়ম মেনে রাস্তা পারাপার হোন। পারাপারে ফুটওভারব্রিজ, আন্ডারপাস ও জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করুন। বেপরোয়া গাড়ি চালাবেন না। মোটরসাইকেল চালাতে হেলমেট ব্যবহার করুন। ট্রাফিক সিগন্যাল না মানলে ঘটতে পারে দুর্ঘটনা’। রাজধানীর ফকিরাপুল ট্রাফিক সিগন্যালে সকাল থেকেই মাইকে এ রকম ঘোষণা আসছিল। ট্রাফিক বুথ থেকে স্কাউট সদস্যরা যখন এ রকম ঘোষণা দিচ্ছিলেন তখন চার রাস্তার সিগন্যাল সামলাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছিল ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের। একদিকে সিগন্যাল অমান্য করে গাড়ি চালানো, ইচ্ছামতো পার্কিং, যত্রতত্র রাস্তা পারাপার, জেব্রা ক্রসিংয়ে গাড়ি রাখাসহ নানা রকমের বিশৃঙ্খলা চোখে পড়ে। পুলিশ জানায়, গত দুই মাসে ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অনেকটা সচেতনতা এসেছে। কিন্তু পথচারী ও বাসচালকরা এখনও বেপরোয়া। যাত্রী তোলার অশুভ প্রতিযোগিতা চলছেই। পুলিশের পক্ষ থেকে রাজধানীর ১২১ পয়েন্টে বাসস্টপেজ নির্ধারণ করা হলেও মানছে না চালকরা। বাসের চেহারা দেখলেই বোঝা যায় রেশারেশির মাত্রা কতটা? অর্থাৎ বেশিরভাগ বাস পাল্লাপাল্লিতে ক্ষতবিক্ষত। এসব বিষয়ে সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, আমরা চেষ্টা করছি পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরানোর। কিন্তু একদিনে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তবে আগের চেয়ে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে। সার্বিক উন্নতির জন্য সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন। বুধবার মালিবাগ রেলগেট এলাকা। রাত আটটা। তুরাগ পরিবহনের কয়েকটি বাস দাঁড়িয়েছিল। বেশিরভাগ বাসে যাত্রী ছিল কম। তাই প্রতিটি বাসে যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা। পেছনে একই কোম্পানির বাস আসার পরই সামনের গাড়িকে সজোরে ধাক্কা! যাত্রীদের কি হবে এ নিয়ে চালকদের কোন মাথাব্যথা নেই। চালকদের এটাই নাকি ‘নিয়ম’। ২০ মিনিটে এ রকম ঘটনা চোখে পড়ল অন্তত দশটি। কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত কন্ডাক্টর, চালকসহ যাত্রীরা জানিয়েছেন, যাত্রী উঠানোর প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব থেকেই এক বাসকে আরেক বাসের ধাক্কা দেয়ার প্রবণতা এখন নিয়মে দাঁড়িয়েছে। টঙ্গী স্টেশন রোড থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত পুরো রুটেই এই কোম্পানির বাসের চিত্র একই। শুধু তাই নয় একটি বাসও পাওয়া যাবে না যেগুলোর দু’পাশের বডি অক্ষত! চলতি পথে রেষারেষির কারণে বাসের বাইরের অংশের ছাল বাকল উঠে গেছে। প্রতিটি বাসের সামনে ও পেছনের অংশ থেতলানো। লাইট নষ্ট। ফ্যান নেই। জানালা ভাঙ্গা। এ চিত্র বলে দেয় কোম্পানির গাড়িগুলোর বেপরোয়া চলনের কথা। মালিবাগ রেলগেট থেকে এবারের যাত্রা বাসাবোর দিকে। মালিবাগ মোড় থেকে কমিউনিটি সেন্টার পর্যন্ত সড়কের পাশে একাধিক সারিতে সোহাগ পরিবহনের গাড়ি পার্কিং। একদিকে ব্যস্ততম মালিবাগ মোড়। সেখানে সোহাগের কাউন্টারের সামনে কিছু সময় পর পর যাত্রী উঠানো হয়। এর একটু সামনেই পার্কিং! স্থানীয় লোকজন জানালেন এই পয়েন্টে যানজট ও যাত্রী ভোগান্তির অন্যতম কারণ সোহাগ পরিবহনের স্বেচ্ছাচারিতা। পুলিশের নাকের ডগায় বছরের পর বছর এসব হচ্ছে। অথচ কারও যেন দেখার নেই। এর একটু সামনেই খিলগাঁও পর্যন্ত রাস্তার বাঁয়ে একাধিক সারিতে মিডলাইন ও বাহন পরিবহনের পার্কিং! এই রুটে এখন লাব্বাইক, রাইদা, অনাবিল, ছালছাবিল, নূর-ই মক্কাসহ আরও কয়েকটি পরিবহন কোম্পানির বাস চলাচল করে। প্রশ্ন হলো বেপরোয়া চলাচলে শুধু কি ‘তুরাগ’ পরিবহনই! না, মালিবাগ মোড় থেকে একটু সামনে আনসার ক্যাম্প। এই পয়েন্টে ঢাকা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে সড়কের পাশে সাইনবোর্ড ঝোলানো আছে। লেখা আছে, ‘এখানে বাস থামাবে’। কে শোনে কার কথা। ইচ্ছামতো বাস থামানো হচ্ছে। অন্য কোম্পানির বাসের মধ্যেও চলছে পাল্টাপাল্টি যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা। ছালছাবিল পরিবহনের দুই বাসের রেশারেশিতে জানালার কাঁচ ভাঙ্গার দৃশ্যও চোখে পড়ে। ধাক্কার চোটে বাসের ফ্যানের খাঁচাও খুলে যায় অহরহ। ফ্লাইওভারের গোড়া থেকে শুরু করে বাসাব, বৌদ্ধমন্দির, কমলাপুর, মুগদা, টিটিপাড়া, মানিকনগর, সায়েদাবাদ পয়েন্ট পর্যন্ত এই রুটের বাসগুলোর চলাচলের চিত্র এরকমই। পথে পথে পরিবহনের নৈরাজ্য আর আইন না মানার প্রবণতা চোখে পড়ে। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশের এ নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। তারা তাদের মতো দিব্যি আছে। আইন মানতে চালকদের বাধ্য করতেও দেখা যায়নি। এ নিয়ে সরাসরি কোন কথা বলতেও সম্মত নন ট্রাফিক বিভাগের কেউ। রাস্তায় যারা ডিউটি করছিল তাদের সঙ্গে কয়েক দফা কথা বলার চেষ্টা করা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানিয়েছে, ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে বাস স্টপেজ যেমন নির্ধারণ করা হয়েছে তেমনি বাস না থামানোর জন্যও নির্দেশনা রয়েছে। মূলত যানজট নিরসন ও পরিবহনে শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা থেকেই এই উদ্যোগ। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এর উদাহরণ হিসেবে এক যাত্রী জানান, মৌচাক থেকে মগবাজারের ভাড়া ১০ টাকা। এই গন্তব্য ছাড়িয়ে বাংলামোটর গেলেই লাব্বাইক পরিবহনে ২০ টাকা গুনতে হচ্ছে। অর্থাৎ এক কিলোমিটারের কম রাস্তার জন্য ১০টাকা বাড়তি ভাড়া নেয়া হচ্ছে। লাব্বাইক, তুরাগসহ একাধিক পরিবহন কোম্পানির চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সপ্তাহের কম সময়ের প্রশিক্ষণে তারা ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছেন। লাইসেন্স নেয়ার সময় সামাজিক বাস্তবতা ও রাস্তা সম্পর্কে কোন ধারণা দেয়া হয়নি। গাড়ি চালাতে পারে এই বিবেচনায় মিলেছে লাইসেন্স। চালক সোহাগের বক্তব্য হলো, লাইসেন্স পাবার পর গত আট বছরে তাদের কোন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কেও তাদের সচেতন করা হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনা ও সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে চালকদের অনেকেই জানতে চান। কিন্তু এ নিয়ে মালিক বা বিআরটিএর কোন ভাবনা নেই। অপর চালক রাশেদ জানালেন, প্রতিটি পরিবহন কোম্পানি থেকে ট্রাফিক পুলিশ মাসোহারা নেয়। তাছাড়া দুর্ঘটনা ঘটলে দ্রæত সমস্যার সমাধান মেলে। তাই চালকদের অনেকেই রাস্তায় কোন কিছু পরোয়া করে না। পাশাপাশি চালকদের মানবিক বিষয়ে কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। অনেক চালক থাকে মাদকাসক্ত। পাশাপাশি চুক্তিতে গাড়ি ভাড়ার প্রবণতাও চালকদের বেপরোয়া হওয়ার কারণ, বলছেন অনেক চালকই। পথচারীদের বেপরোয়া আচরণ লক্ষ্য করা গেছে রাজধানীজুড়ে। ব্যস্ততম পয়েন্টে মতিঝিলে ওভারব্রিজ থাকা সত্তেও ঝুঁকি নিয়ে দিনভর রাস্তা পারপার হতে দেখা গেছে। গুলিস্তান, সেগুনবাগিচা, পল্টন, শাহবাগ, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, গুলশান, ধানমন্ডি, মিরপুর, ফার্মগেট, গাবতলী, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ীসহ গোটা রাজধানীতে বেপরোয়া সড়ক পারাপারের চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। স্কুলের শিশুদের নিয়ে অভিভাবকদের বেপরোয়া রাস্তা পার হতে দেখা গেছে। স্কুল শিক্ষার্থীদের অনেকেই রাস্তা চলাচলে অভিভাবদের সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। ট্রাফিক কনস্টেবল লিটন চৌধুরী বলেন, আমরা চাই সবাই আইন মেনে রাস্তা পার হোক। কিন্তু শতভাগ আইন মানানো কঠিন। সবচেয়ে বেশি বেপরোয়া বাস, বাইকচালক ও পথচারী। অনেকেই না বুঝে পথ চলেন। কেউ কেউ আইনের প্রতি কোন রকম তোয়াক্কা করে না। তিনি বলেন, আইন ভঙ্গের অভিযোগে কারো বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলেও নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়। যাত্রী অধিকার সংরক্ষণে কাজ করা যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত। মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, রাজধানীসহ সারাদেশের গণপরিবহনে নৈরাজ্য চলছে। বাসে-বাসে রেশারেশি করে বেপরোয়া চলাচল ও পাল্লাপাল্লিতে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন যাত্রীরা। যত্রতত্র বাস থামানো, রাস্তার মাঝ পথে গতি কমিয়ে, চলন্ত বাসে যাত্রী উঠানামা করানো, ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন, যাত্রী ধরার জন্য বাসে বাসে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা, অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা ঢাকার গণপরিবহনের নিত্যদিনের চিত্র। সম্প্রতি সরকারী তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব নিহতের ঘটনায় সারাদেশ কেঁদে উঠলেও দেশের সড়ক মহাসড়কে ঝরছে দিনে কমপক্ষে ৬৪ তাজা প্রাণ। আহত ও পঙ্গুত্বের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে দেড়শ’র বেশি মানুষ। সড়ক ব্যবস্থাপনা, সড়কের শৃঙ্খলা মারাত্মক ভেঙ্গে পড়েছে বলে দাবি করেন তিনি। সমিতির এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমানে সারাদেশে নিবন্ধিত ৩১ লাখ যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনিবন্ধিত, ভুয়া নাম্বারধারী ও অযান্ত্রিক যান মিলে প্রায় ৫০ লাখ যান চলছে। যার ৭২ শতাংশ ফিটনেস অযোগ্য। অন্যদিকে সারাদেশে ৭০ লাখ চালকের মধ্যে বিআরটিএর লাইসেন্স আছে মাত্র ১৬ লাখ চালকের। রাজধানীতে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাস ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করে বেপরোয়া চলাচল করে। ফলে এসব বাসে দুর্ঘটনায় কারো হাত, কারো পা, কারো মাথা, কারো জীবন পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। সংগঠনের সড়ক দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণ সেলের তথ্যমতে, সারাদেশে জানুয়ারি ’১৮ থেকে ২০ এপ্রিল ’১৮ পর্যন্ত ১ হাজার ৭৭৯ সড়ক দুর্ঘটনায় এক হাজার ৮৪১ জনের প্রাণহানিও ৫ হাজার ৪৭৭ আহত হয়েছে। পঙ্গুত্ববরণ করেছেন ২৮৮ জন। তিনি বলেন, আমরা এসব দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা নয় পরিকল্পিত হত্যাকান্ড বলতে চাই। কেননা আমাদের সড়কে সমস্ত অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা জিইয়ে রেখে নৈরাজ্যকর পরিবেশে আমাদের যাতায়াতে বাধ্য করা হচ্ছে। নগরীর প্রতিটি বাস-মিনিবাসের ব্যবসা মূলত চালকরা নিয়ন্ত্রণ করছে। দৈনিক চুক্তিভিক্তিক ইজারায় প্রতিটি মালিক তার বাস চালকের হাতে তুলে দিয়েছে। এতেই চালকরা যাত্রী উঠানোর জন্য বাসে বাসে ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এহেন পরিস্থিতিতে বাস চালাতে গিয়ে বাসের নিচে কে পড়ল কার হাত বা পা গেল তা দেখার সময় নেই তাদের। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক এক সেমিনারে বলেন, মানবাধিকারের অন্যতম শর্ত মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার। আমাদের সড়কে এই অধিকার অব্যবস্থাপনা ও নৈরাজ্যের চাকায় পৃষ্ট হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে আইনের প্রয়োগ থাকলেও আমাদের এখানে প্রকৃতপক্ষে আইনের কোন প্রয়োগ নেই। জানতে চাইলে বিআরটিএ সচিব শওকত আলী বলেন, পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জনসচেতনতামূলক মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ চলছে। এছাড়া মোবাইল কোর্টের অভিযানও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
×