ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

॥ পর্ব-সাত ॥ (গত বুধবারের পর) গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার আমাদেরকে প্রথমেই জানালেন যে, যেহেতু তিনি আমাদের সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ক কর্মতৎপরতা বিষয়ে মোটামুটিভাবে প্রথম থেকেই অবহিত রয়েছেন এবং আমাদের অনেক সাপ্তাহিক সভায়ও উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছে তাই নতুন করে তেমন কিছু বলার নেই। তবে তিনি যে কথাটি আমাদের সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন সেটা হলো যে, আমাদের সেক্টর কমান্ডারগণ এবং তাদের অধীনে পাক হানাদার বাহিনীর বাঙালী নিধন অভিযান প্রতিহত করা ও প্রয়োজন বোধে তাদের সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার দায়িত্ব পালনে অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তা সৈনিক এবং বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধারা কিন্তু নামমাত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদের সরবরাহকৃত স্বল্পতম অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ নিয়ে চব্বিশ ঘণ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে স্বাধীনতা অর্জনের প্রাণপণ যুদ্ধ। তাই তিনি আমাদের অনুরোধ করলেন যে, মুক্তিযোদ্ধাদের এই ত্যাগ ও জীবনবাজি রেখে প্রতিমুহূর্তে হানাদার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহসিকতা ও বীরত্বগাথার কথা স্মরণ রেখেই আমাদের সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার কর্মসূচী প্রণয়ন করে কার্যকরীভাবে তা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। তিনি গর্বের সঙ্গে এ বিষয়টাও আমাদের জানিয়ে দিলেন যে, কিভাবে মাত্র কয়েকজন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাইলটকে নিয়ে মাত্র চারটি পুরনো বিমান মেরামত করে কার্যোপযোগী করে ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের দীমাপুর ঘাঁটি থেকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যাত্রা শুরু করা হয়। উল্লেখ্য, বাঙালী পাইলট মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এই পুরনো যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিচালনা করে হানাদার পাকবাহিনীর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়েছিল এবং তাই এটা ছিল আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম একটি সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অভিযানের অংশ। মেজর জিয়াউর রহমান এরপরে সাক্ষাতকার নেয়া হয় মেজর জিয়াউর রহমানের যিনি ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার ট্রান্সমিটার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার একটা ঘোষণা দেন। তার কণ্ঠস্বর আমি মেজর জিয়া বলছি, ‘এ সময়ে অনেকটা দিশেহারা মানুষকে স্বস্তি দিয়েছিল, উদ্দীপনা যুগিয়েছিল। মেজর জিয়া ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বিদ্রোহ করেন। তিনি তখন চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন এবং রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আবদুর রশিদ জানজুয়া ও অন্য অবাঙালী সেনা কর্মকর্তাদের গ্রেফতার এবং হত্যা করে বিদ্রোহ শুরু করেন। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক ছুটির দিনে তার থিয়েটার রোডের অফিসে ডেকে নিয়ে আমার অংশগ্রহণে আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত নিয়মিত সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান ‘জবাব দাও’-এ প্রচারের জন্য যে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে ‘প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছে মুজিবনগর সরকার, ভারত সরকার নয় ‘অনেকটা সে রকমই একটা বক্তব্য দিয়ে মেজর জিয়া শুরু করেন তার সাক্ষাতকার অনুষ্ঠান। তিনি আমাদের বললেন যে সব সময় আপনাদের গুরুত্বসহকারে যে কথাটি প্রকাশ ও প্রচার করতে হবে সেটা হলো যে মুজিবনগরে অবস্থিত বাংলাদেশ সরকারই পরিচালনা করছে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য একজনকে সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, একজনকে চীফ অব স্টাফ এবং ১১ জন সেনা কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে। আর বেসরকারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদানে এবং অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলাবারুদ বিষয়ে সহায়তা প্রদানে ভারত সরকার যে আমাদের সহযোগিতা করছে সে কথাটাও উল্লেখ করার প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি আমাদের জানান। আরও যে বিষয়টির প্রতি আমাদের দৃষ্টি তিনি বিশেষভাবে আকর্ষণ করলেন সেটা হলো গ্রাম-গঞ্জ থেকে আসা হাজার হাজার বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা যারা স্বল্পতম সময়ের জন্য নামমাত্র অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের জীবনবাজি রেখে হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের প্রতিহত করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। তাদের অনেকে হয়ত ধরা পড়ছে শত্রুদের হাতে। কিন্তু শত অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা বিষয়ে কোন তথ্য দিচ্ছে না তারা শত্রুদের। এদের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে আমরা যেন দেশের মানুষ ও বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেই আমাদের নানামুখী প্রচারণা ও প্রকাশনার মাধ্যমে এসব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ অভিযানের কাহিনী বিশেষ করে যারা তাদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য সেই সূর্য সন্তানদের বীরত্বগাথার কথা গুরুত্বসহকারে জানাতে হবে বিশ্ববাসীকে। তবে মেজর জিয়া আমাদের একটা সুখবরও দিলেন। তারই উদ্যোগে প্রথম তৃতীয়, অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্রিগেড তৈরি করা হয়েছে এবং তাকে তার নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে এই ব্রিগেডের নাম রাখা হয়েছে জেড ফোর্স। মেজর খালেদ মোশাররফ সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ে আলাপ করার জন্য মেজর খালেদ মোশাররফের কাছে সময় চাইলে তিনি খুব খুশি হলেন এবং পরের দিনই আমাদের সময় দিলেন তার অফিসে যেতে। নানা বিষয়ে ঘণ্টাখানেক আলাপ হলো তার সঙ্গে। প্রথমেই তিনি আমাদের স্বাধীন বাংলা বেতারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আরও বেশি গভীর সম্পর্ক স্থাপন করার পরামর্শ দিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে লড়াই ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার সাহসিকতা ও বীরত্বগাথার আরও বিস্তারিত খবরাখবর প্রতিদিনই প্রচার করার ওপর আরও বেশি গুরুত্বারোপ করলেন। একইভাবে তিনি আকাশবাণী বিবিসি এবং অন্যান্য গণমাধ্যমের স্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে আরও বেশি মুক্তিযুদ্ধের প্রচার ও প্রকাশ করার কথা আমাদের বললেন। তার অভিমত মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা যত বেশি প্রচারিত হবে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তত বেশি উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ হবে। তবে মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছিল যে, তিনি হয় সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ে বেশ লেখাপড়া করেছেন নতুবা বিষয়ক কোন কর্মশালা অথবা প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নিয়েছেন। তিনি আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছিলেন যা হলোÑ সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ক কোন কার্যক্রম গ্রহণ করার পূর্বে নির্ধারণ করতে হবে যে কার্যক্রমের টার্গেট গ্রুপ কারা অথবা কাদের উদ্দেশ্যে এই কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে। তার বক্তব্য ছিল যে টার্গেট গ্রুপ যদি সঠিকভাবে এবং সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা যায় তাহলে কার্যক্রম গ্রহণ করাটা যেমন সঠিকভাবে সম্ভব তেমনিভাবে সেটা বাস্তবায়ন করাটাও হয় সহজতর এবং সুনির্দিষ্টভাবে। তিনি অন্য যে আর একটি মূল্যবান উপদেশ দিয়েছিলেন সেটা হলো, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিস্তারিত তথ্য পেতে হলে আমাদের নিয়মিতভাবে সব সেক্টর কমান্ডারকে অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। তিনি উদাহরণস্বরূপ আমাদের বলেছিলেন যে, ওই সময় দেশের অভ্যন্তরে দুই শ্রেণীর লোক ছিল। দেশের অধিকাংশ লোকই বলা যায় ৯৫-৯৬ শতাংশ লোকই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের এবং দেশপ্রেমিক ও মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দাতা এবং শুভাকাক্সক্ষী। অন্য গ্রুপ ছিল হানাদার পাকবাহিনীর সমর্থক মুসলিম লীগ, জামায়াত ও অন্য কয়েকটি ছোটখাটো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান/সংস্থার নেতা ও কর্মী, রাজাকার, আলবদর ও আল-শামস বাহিনীর সদস্য এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী উর্দু ভাষার ব্যক্তিরা স্বাভাবিকভাবেই দেশের অধিকাংশ লোকের মনোবল দেশপ্রেম ও জাতীয়বাদী চেতনা দৃঢ় রাখার জন্য যেসব কার্যক্রম জোরদারভাবে চালু রাখলে তারা যেমন হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের প্রতিহত করার কার্যক্রমে আরও সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসবে তেমনিভাবে তাদের সর্বাঙ্গীন সাহায্য-সহযোগিতা ও আশ্রয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে নিতে আরও বেশি শক্তিশালী ও সাহসী হবে এবং স্বচ্ছন্দে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের জন্য গ্রহণ করতে হবে এমন সব কার্যক্রম যা তাদের মনোবল ও সাহস হ্রাস করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। ফলে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হবে ভয়-ভীতি ও ভবিষ্যতে বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষা। মেজর কাজী নুরুজ্জামান এরপর আমাদের সঙ্গে কথা হয় মেজর কাজী নুরুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি চাকরিতে অন্যান্য সেক্টর কমান্ডারের চেয়ে সিনিয়র থাকার কারণে তাকে সবাই শ্রদ্ধা করতেন। তিনি আমাদের প্রথমেই যে উপদেশটা ছিলেন, সেটা হলো যে আমাদের তরফ থেকে যেন এমন কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা না হয় তার ফলে রাজনীতিবিদ, বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী, সামরিক কর্মকর্তা ও সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য বাহিনী ও সাধারণ ব্যক্তিবর্গ এবং দেশের ভেতরে অবস্থানকারী দেশবাসী কারও মধ্যে যেন কোন বিভেদ সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি বললেন, যে মুক্তিযুদ্ধের মতো জাতীয় ক্রান্তিলগ্নে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধভাবে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের প্রতিহত করে আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত করা। মেজর নুরুজ্জামান দ্বিতীয় যে কথাটা গুরুত্বের সঙ্গে বললেন, সেটা ছিল পাকিস্তান রেডিও ঢাকা এবং পাকিস্তানের অন্যান্য কেন্দ্র থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে যেসব প্রচারণামূলক অর্থাৎ সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ক বক্তব্য পেশ করা হয় সেটা নিয়মিতভাবে মনিটর করা যাতে আমাদের পক্ষে তাদের প্রচারণামূলক মিথ্যা, বানোয়াট ও অতিরঞ্জিত বক্তব্যগুলো আমরা সময়মতো এবং যথাযোগ্যভাবে কাউন্টার করে আমাদের বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারি। উল্লেখ্য, আমরা আমাদের কার্যক্রম শুরুর প্রথম থেকেই এ বিষয়টা আমাদের অগ্রাধিকার বিষয় হিসেবে বিবেচিত ছিল। এ জন্য অফিস থেকে একটা রেডিও সরবরাহ করা হয়েছিল এবং আমাদের সহকর্মী কবি আল মাহমুদকে দেয়া হয়েছিল রেডিও পাকিস্তানের অনুষ্ঠানসমূহ বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রচার করা অনুষ্ঠানগুলো মনিটর করা। চলবে... লেখক : মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার প্রধানের দায়িত্ব পালনকারী
×