ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

চতুর্থ শিল্প বিপ্লব

খুব কষ্ট করার দরকার নেই, কেবল গুগলে অনুসন্ধান করলেই শিল্প বিপ্লব ৪.০ বা ডিজিটাল শিল্প বিপ্লব বিষয়ে অনেক তথ্যই হাতের কাছেই পেয়ে যাবেন। এত তথ্য পাবেন যে, মাথা গুলিয়ে যেতে পারে। জার্মান সরকারের উৎপাদনশীলতাকে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক করার একটি প্রকল্প থেকে ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ শব্দটির সূচনা হয়। ২০১১ সালের সিবিট মেলায় শব্দটির পুনর্জন্ম হয় এবং ২০১২ সালের একই মেলায় কর্মশালার মধ্য দিয়ে জার্মান সরকারের কাছে এই বিষয়ক অনেক সুপারিশ পেশ করা হয়। ২০১২ সালে যে ওয়ার্কিং গ্রুপটি প্রাথমিক সুপারিশ পেশ করেছিল তারা ৮ এপ্রিল ২০১৩ সালে এর চূড়ান্ত সুপারিশ পেশ করে। এই ওয়ার্কিং গ্রুপটিকে ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ এর জনক বলে গণ্য করা হয়। এই সময়েই সারা দুনিয়াতে আলোড়ন তুলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধারণা। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অবস্থিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত অর্থনীতিবিদ কার্লস সোয়াব এর ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলিউশন বইটাকেই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বাইবেল মনে করা হয়। এর কারণটিও সহজবোধ্য। সোয়াব ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের নির্বাহী চেয়ারম্যান। বইটির ভূমিকাতে সোয়াব লিখেছেন: Of the many diverse and fascinating challenges we face today, the most intense and important is how to understand and shape the new technology revolution, which entails nothing less than a transformation of humankind. We are at the beginning of a revolution that is fundamentally changing the way we live, work, and relate to one another. In its scale, scope and complexity, what I consider to be the fourth industrial revolution is unlike anything humankind has experienced before. খুব সহজে এই কথাটি আমরা বলতে পারি যে, আজকের মানুষের জন্য নতুন প্রযুক্তিকে মোকাবেলা করার চ্যালেঞ্জকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। তার বিবেচনায়, ডিজিটাল শিল্প বিপ্লব আমরা কেমন করে জীবন ধারণ করব, কেমন করে কাজ করব এবং কেমন করে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করব তার পুরোটাই বদলে দেবে। সোয়াবের বইটির ভূমিকা একটি নতুন যুগের কথাই বলে। তিনি মনে করেন মানবসভ্যতা এর আগে কখনও এমন কোন বিপ্লবের মুখোমুখি হয়নি। আমরা যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলেছি তখনও এই কথাটিই বলেছে যে, মানবসভ্যতা এর আগে কখনও এমন একটি পরিবর্তনের ধারণাও করতে পারেনি। কাকতালীয় বিষয় যে, আমরা যখন ডিজিটাল বিপ্লবের কথা বলেছি তখন দেশ-বিদেশের মানুষ ব্যঙ্গ করেছে আর যখন ইউরোপীয়রা বলেছে তখন সেটি বিশ্ববাসীর স্লোগান হয়েছে। কার্লস সোয়াব চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে চিহ্নিত করতে গিয়ে বলেছেন, ÒConsider the unlimited possibilities of having billions of people connected by mobile devices, giving rise to unprecedented processing power, storage capabilities and knowledge access. Or think about the staggering confluence of emerging technology breakthroughs, covering wide-ranging fields such as artificial intelligence (AI), robotics, the internet of things (IoT), autonomous vehicles, 3D printing, nanotechnology, biotechnology, materials science, energy storage and quantum computing, to name a few. বইটির আলোচ্যসূচী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে যে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কোন ধরনের প্রযুক্তি নিয়ে দুনিয়া বদলাবে। এতে আলোচিত হয়েছে, প্রতিস্থাপনযোগ্য প্রযুক্তি, আমাদের ডিজিটাল উপস্থিতি, পরিধানযোগ্য ইন্টারনেট, যখন যেখানে সর্বত্র, সর্বদা কম্পিউটিং, পকেটে সুপার কম্পিউটার, সবার জন্য সকল কিছুর ডিজিটাল স্টোরেজ, ইন্টারনেট অব থিংস, সংযুক্ত বাসস্থান, ডিজিটাল নগরী, বিগ ডাটা বা বিশাল উপাত্ত, চালকবিহীন গাড়ি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও হোয়াইট কলার পেশা, রোবোটিক্সও সেবা, বিট কয়েন ও ব্লক চেইন, অংশীদারিত্বের অর্থনীতি, সরকার ও ব্লকচেইন, ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিং ও উৎপাদন, ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিং ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, ত্রিমাত্রিক প্রিন্টিং ও কনজুমার পণ্য স্থায়ুপ্রযুক্তি ইত্যাদি। আমরা সবাই জানি, আলোচ্য প্রযুক্তিগুলোর প্রায় সবই এখনও শৈশবেই রয়েছে। প্রায় সবগুলোই বিকাশমান। তবে এরই মাঝে সরকার থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-বাণিজ্য, দৈনন্দিন জীবনযাপন বদলে যাচ্ছে। সারা দুনিয়া এতদিনে অনুভব করছে যে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মানে হলো পুরো ব্যবস্থাটির ডিজিটাল রূপান্তর। আমরা যখন ২০০৮ সালে ঘোষণা দিয়ে একথা বললাম তখনও দুনিয়া সেটি অনুভব করেনি। অবশেষে উন্নত দুনিয়া যখন বলছে তখন বাংলাদেশেও তার ঢেউ লেগেছে। কার্লস সোয়াবের বইটির একটি অসাধারণ গুণ হচ্ছে যে, তিনি পুরো রূপান্তরটিকে ইতিবাচকভাবে দেখেছেন। বিষয়টি আমার কম্পিউটার শেখার মতো নয়। আশির দশকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ তে কম্পিউটার শিখতে গিয়েছিলাম। প্রথম দিন আমাদের ক্লাস নেয়া হয়। শিক্ষক ক্লাস থেকে বের হলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আজ যা পড়ালেন সামনেও কি তাই পড়াবেন? তিন হ্যাঁ, বললে আমি তাকে বলে দিলাম, এটিই আমার প্রথম ও শেষ ক্লাস। কারণ, বাইনারি অঙ্ক শেখার কোন ইচ্ছাই আমার নেই। সোয়াবও তেমনটি বলেছেন। "Technology is not an exogenous force over which we have no control. We are not constrained by a binary choice between 'accept and live with it' and 'reject and live without it'. Instead, take dramatic technological change as an invitation to reflect about who we are and how we see the world. The more we think about how to harness the technology revolution, the more we will examine ourselves and the underlying social models that these technologies embody and enable, and the more we will have an opportunity to shape the revolution in a manner that improves the state of the world.” আমাদের যে জনগোষ্ঠী ডিজিটাল বাংলাদেশ শুনলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন তাদের জন্য ওপরের উদ্ধৃতিটি খুবই প্রয়োজনীয়। বিষয়টি এমন নয় যে, বাইনারি যুগে সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকার দক্ষতা অর্জন করতে পারবে না। বাস্তবতা এমনই যে কেবল এখন যারা শিশু তাদেরকেই পরিকল্পিতভাবে আমরা ডিজিটাল দক্ষতা অর্জন করার শিক্ষা দিতে পারি। তবে এটি মনে রাখা দরকার যে শিল্পযুগের প্রথম স্তরের শিক্ষায় বাস করে আমাদের পক্ষে এই কাজটি করাও কঠিনতম হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটি কোনভাবেই ডিজিটাল যুগের ছোঁয়াও পায়নি। তবে এজন্য আতঙ্কিত হবার কোন কারণ নেই। আমি কার্লস সোয়াবের উদ্ধৃতিই দিচ্ছি, ÒShaping the fourth industrial revolution to ensure that it is empowering and human-centred, rather than divisive and dehumanizing, is not a task for any single stakeholder or sector or for any one region, industry or culture. The fundamental and global nature of this revolution means it will affect and be influenced by all countries, economies, sectors and people. It is, therefore, critical that we invest attention and energy in multistakeholder cooperation across academic, social, political, national and industry boundaries. These interactions and collaborations are needed to create positive, common and hope-filled narratives, enabling individuals and groups from all parts of the world to participate in, and benefit from, the ongoing transformations. সোয়াবের বইটিতে ডিজিটাল শিল্প বিপ্লব বলতে কি বোঝায় তার বিবরণও দিয়েছেন। তবে আমি পুরো ধারণাটিকেই শিল্প বিপ্লব হিসেবে দেখতে চাই না। প্রাসঙ্গিকভাবে এই বিষয়টি উল্লেখ করা দরকার যে, পশ্চিমা দুনিয়া শিল্প বিপ্লবের বিবর্তনকে অনেক আগে থেকেই মূল্যায়ন করা শুরু করেছে। আমি বিশেষভাবে এ্যালভিন টফলারের কথা উল্লেখ করতে পারি। টফলার ১৯৭০ সালে ফিউচার শক নামে একটি বই লেখেন। এরপর তার বিখ্যাত বইটি থার্ড ওয়েব লেখা হয় ১৯৮০ সালে। ১৯৯০ সালে লেখেন Powershift : Knowledge, Wealth and Violence at the Edge of the 21st Century. টফলিন যেভাবে পুরো বিষয়টা দেখেছেন সেটাই বস্তুত দিকনির্দেশনার মতো। সোয়াবের চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বস্তুত মানব সভ্যতা বা বিশ্বসভ্যতার তৃতীয় যুগ-কৃষি, শিল্প ও ডিজিটাল। সোয়াব গং বিপ্লবের এই ধারাটি যাকে ডিজিটাল শিল্প বিপ্লব বলা হয় তার ৪টি মৌলিক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন। ক. পারস্পরিক সংযুক্ত বা ইন্টার অপারেবিলিটি : এই বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানুষ ও যন্ত্রের পারস্পরিক সংযুক্ত বা একই সূত্রে কাজ করার বিষয়টি শিল্প উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে থাকবে। ইন্টারনেট অব থিংস বা আইওটিকে এই সংযুক্তির কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। একে অবশ্য বলা হচ্ছে আইওপি বা ইন্টারনেট অব পিপল। খ. তথ্য স্বচ্ছতা বা ইনফরমেশন ট্রান্সপারেন্সি : অপরিশোধিত সেন্সর ডাটাকে এমনভাবে উপস্থাপন করা যাতে বিদ্যমান বস্তুগত বিশ্বকে উপাত্ত আকারে স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যবহার করা যায়। গ. কারিগরি সহায়তা বা টেকনিক্যাল এ্যাসিস্টেন্স : প্রযুক্তিকে মানুষের জন্য ব্যবহার করতে পারা। মানুষ কাজ করার জন্য বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ শক্তি কাজে লাগাবে। যেসব কাজ মানুষের পক্ষে করা ক্লান্তিকর, ঝুঁকিপূর্ণ, অপ্রিয় সেইসব খাতে প্রযুক্তি ব্যবহার করা। ঘ. বিকেন্দ্রীকৃত সিদ্ধান্ত বা ডিসেন্ট্রালাইজড ডিসিশন : এই পদ্ধতিটিকে অহেতুক হস্তক্ষেপে ভারাক্রান্ত না করা ও বিকেন্দ্রীকরণভাবে পদ্ধতিটিকে কাজ করতে দেয়া। আমরা শিল্প বিপ্লবের স্তরগুলো সম্পর্কে যে ধারণা পেলাম তাতে বোঝা যায় যে, প্রথমটি ছিল যন্ত্র, পানি, বিদ্যুত এর শক্তিতে পরিচালিত। দ্বিতীয়টিকে বলা হচ্ছে গণউৎপাদন ব্যবস্থা। তৃতীয়টিকে কম্পিউটার বা স্বয়ংক্রিয়তা হিসেবে এবং চতুর্থটিকে সাইবার ফিজিক্যাল বা ডিজিটাল- মানবিক যুগ বলা হচ্ছে। কার্লস সোয়াবের এই বইটির পর ১৮ সালের জানুয়ারিতে শেপিং দ্য ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলিউশন নামে আরও একটি বই কার্লস সোয়াবের নেতৃত্বে বিশ্বের ২০০ বিশেষজ্ঞের অবদানে প্রকাশিত হয়েছে যে, বইটি বস্তুত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে কেমন করে আত্মস্থ করা যাবে এবং কিভাবে তার অংশ হওয়া যাবে বা কিভাবে তাকে মোকাবেলা করা যাবে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার-এর জনক
×