ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জামায়াতের মদদে ত্রিদেশীয় জঙ্গী নেটওয়ার্ক;###;ভারতে গ্রেফতার জেএমবির শীর্ষ নেতা বোমারু মিজানের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

সংসদ নির্বাচনে টার্গেট কিলিংয়ের আশঙ্কা

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সংসদ নির্বাচনে টার্গেট কিলিংয়ের আশঙ্কা

গাফফার খান চৌধুরী ॥ বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে জঙ্গীদের নেটওয়ার্ক থাকার তথ্য দিয়েছে ভারতে গ্রেফতার জেএমবির শীর্ষ নেতা বোমারু মিজান। সেই নেটওয়ার্ক আরও শক্তিশালী করার জন্য সে কাজও করছিল। যদিও সেই নেটওয়ার্ক কতটা শক্তিশালী সে সম্পর্কে বিস্তারিত কোন তথ্য মেলেনি। ত্রিদেশীয় নেটওয়ার্কের সূত্রধরেই আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশে টার্গেট কিলিংয়ের আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া জেএমবি রোহিঙ্গাদের তাদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা রোহিঙ্গাদের মধ্যে কাজ করছে। পুরো এই প্রক্রিয়াটির নেপথ্যে রয়েছে পাকিস্তানী বিভিন্ন সংস্থা ও জঙ্গী সংগঠনগুলো এবং বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, চলতি বছরের ৬ আগস্ট ভারতের ব্যাঙ্গালুরুর মালাপ্পুরাম জেলার কোতাক্কালের একটি আস্তানা থেকে ভারতের মোস্টওয়ান্টেড ও দশ লাখ রুপী পুরস্কার ঘোষিত জঙ্গী কওসর ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থার (এনআইএ) হাতে গ্রেফতার হয়। পরবর্তীতে বিষয়টি বাংলাদেশকে জানানো হয়। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা গ্রেফতারকৃত কওসরকে দুর্ধর্ষ জেএমবি জঙ্গী বাংলাদেশ থেকে ছিনতাই করে নেয়া বোমারু মিজান বলে নিশ্চিত করে। ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কাশিমপুর থেকে ময়মনসিংহে নেয়ার পথে ত্রিশাল সাইনবোর্ড এলাকায় পুলিশের প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে পুলিশ হত্যা করে জেএমবি জঙ্গীরা বোমারু মিজান (৩৯), জেএমবির শূরা সদস্য দুর্ধর্ষ জঙ্গী রাকিবুল হাসান ও সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানিকে (৩৮) ছিনিয়ে নেয়। ওইদিনই মির্জাপুরে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে পালানোর সময় রাকিবুল হাসান নিহত হয়। বোমারু মিজান ও সানিকে ধরিয়ে দিতে বাংলাদেশ পুলিশ প্রত্যেকের জন্য ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার খাগড়াগড়ে জেএমবির আস্তানায় বিস্ফোরণে দুই জেএমবি জঙ্গী শাকিল আহাম্মদ ওরফে শাকিল গাজী ও সোবাহান ম-ল ওরফে সোবাহান শেখ নিহত হন। নিহত দুই জঙ্গীর স্ত্রী রাজিয়া বিবি ও আলিমা বিবিকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে ভারতীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলো। দুই নারীর দেয়া তথ্য এবং তদন্তে বেরিয়ে আসে বাংলাদেশী জেএমবি জঙ্গী কাওসার ওরফে বোমারু মিজান খাগড়াগড়ের আস্তানাটি গড়ে তোলার অন্যতম প্রধান কারিগর। পরবর্তীতে ভারতের এনআইএ বোমারু মিজানই কাওসার বলে নিশ্চিত হয়। ভারতে জেএমবির আস্তানা গড়ে তোলা এবং আস্তানায় তৈরিকৃত বোমা বাংলাদেশে পাঠানোর সঙ্গে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর অর্থায়ন করার তথ্য প্রকাশ পায়। জামায়াত ভারতের একটি রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে জেএমবিকে অর্থায়ন ও সুযোগ সুবিধা দিয়ে আসছিল বলে অভিযোগ ওঠে। বোমারু মিজানের পিতার নাম সুজা মিয়া (মৃত)। বাড়ি জামালপুর জেলা সদরের শেখের ভিটা গ্রামে। একই এলাকার বাসিন্দা শীর্ষ জঙ্গী ফাঁসিতে মৃত্যু হওয়া শায়খ আব্দুর রহমানের হাত ধরেই বোমারু মিজানের উত্থান। বাংলাদেশ পুলিশের এন্টি টেররিজম বিভাগের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক শফিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, বোমারু মিজান গ্রেফতার হওয়ার পর বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে জঙ্গী নেটওয়ার্ক থাকার তথ্য মিলেছে। বোমারু মিজান নিজেও ত্রিদেশীয় জঙ্গী নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করার কাজ করছিল। পুলিশ সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স এ্যান্ড স্পেশাল এ্যাফেয়ার্স বিভাগের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, বোমারু মিজান সম্পর্কে তথ্য পেতে ভারতের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ আছে তাদের। ইতোমধ্যেই ভারতের কাছ থেকে তথ্য পেয়ে বেশ কয়েকটি অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযানে অনেক শীর্ষ জেএমবি নেতা গ্রেফতারও হয়েছে। বোমারু মিজান জেএমবির পুরনো শাখার শীর্ষ নেতা। তার সঙ্গে জেএমবির পুরনো শাখারই যোগাযোগ সবচেয়ে বেশি। শুধু জেএমবি নয়, সব জঙ্গী সংগঠনের মধ্যেই বড় ধরনের কোন অপারেশন চালানোর ক্ষেত্রে সব জঙ্গী সংগঠনের মধ্যে যোগাযোগ হওয়ার রেকর্ড রয়েছে। কোন কোন বড় অপারেশনের ক্ষেত্রে বোমারু মিজানের সঙ্গে জেএমবির নতুন শাখার যোগাযোগ হওয়ার রেকর্ড রয়েছে। এরমধ্যে বোমারু মিজানের সঙ্গে হলি আর্টিজান হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন শীর্ষ নব্য জেএমবি নেতার যোগাযোগ থাকার তথ্য মিলেছে। এই কর্মকর্তা বলছেন, জেএমবির পুরনো শাখাটির তৎপরতা গত দেড়মাসে লক্ষ্য করা যায়নি। তবে তারা বসে নেই। জেএমবির পুরনো শাখার অনেক নিচের সারির নেতা বা সদস্যরা আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠে আসছে। এদের নিয়ে যথেষ্ট ভয়ের কারণ আছে। তাদের টার্গেট আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও রোহিঙ্গারা। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টার্গেট কিলিংয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের জেএমবি দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে। একজন শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, জেএমবির এমন তৎপরতার নেপথ্যে রয়েছে দেশী-বিদেশী মদদ। বিশেষ করে জেএমবিকে দিয়ে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে টার্গেট কিলিং করানোর চেষ্টা করছে পাকিস্তানের বিভিন্ন সংস্থা ও দেশটির জঙ্গী সংগঠনগুলো। এ ছাড়া সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জেএমবিকে দিয়ে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের একত্রিত করারও চেষ্টা অব্যাহত আছে। জেএমবির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মানসিকভাবে একত্রিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এখাতে প্রচুর অর্থায়ন করছে পাকিস্তানের বিভিন্ন সংস্থা ও জঙ্গী সংগঠনগুলো। অদূর ভবিষ্যতে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের একত্রিত করে এদেশে নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরির চেষ্টাও অব্যাহত আছে। যেটি বাংলাদেশের জন্য আরও ভয়াবহ কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে। সূত্রটি বলছে, একাজে সার্বিক সহায়তা করছে জামায়াতে ইসলামী। কারণ জেএমবির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক অনেক আগ থেকেই। রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) নামের সংগঠনটিকে আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা চলছে। আরএসওর সামরিক শাখার কমান্ডার ছিলেন নজমুল আলম চৌধুরী ওরফে মোহাম্মদ সেলিম ওরফে সেলিম উল্লাহ ওরফে সেলিম নামের এক রোহিঙ্গা জঙ্গী। সেলিম কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) বিএনপির সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী ও তার সহোদর কক্সবাজার জেলা জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল শাহজালাল চৌধুরীর বোন জামাই। সেলিমের সঙ্গে বোমারু মিজান, ভারতের তিহার জেলে বন্দী ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আসামি জঙ্গী মুরসালিন ও মুত্তাকিন, ফাঁসিতে মৃত্যু হওয়া মুফতি হান্নান, শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাইসহ দেশের সব শীর্ষ জঙ্গীর যোগাযোগ ছিল। সেলিম বহু জঙ্গীকে ট্রেনিং করিয়েছে। সূত্রটি বলছে, বোমারু মিজানের সঙ্গে পাকিস্তানে জঙ্গী ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা জঙ্গী আব্দুল করিম টু-ার যোগাযোগ আছে। আব্দুল করিম টু-া জেএমবির কারাবন্দী আমির জামায়াতে ইসলামীর সাবেক কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য মুফতি মাওলানা সাইদুর রহমান জাফরের মেয়ের জামাই পাকিস্তানে জঙ্গী আস্তানায় সেদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত ইজাজ ওরফে কারগিলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। ইজাজ ও আব্দুল করিম পাকিস্তানে একই জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ছিল। টু-ার কাজই হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে যাওয়া জঙ্গীদের থাকা খাওয়া ও জঙ্গী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের বিশেষ বিশেষ অপারেশন চালানোর জন্য বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানো।
×