ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

উচ্চমাত্রার ক্যাফেইনযুক্ত এনার্জি ড্রিঙ্কসের অনুমোদন নেই দেশে

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

উচ্চমাত্রার ক্যাফেইনযুক্ত এনার্জি ড্রিঙ্কসের অনুমোদন নেই দেশে

শাহীন রহমান ॥ উচ্চমাত্রায় ক্যাফেইন থাকায় দেশে কোন প্রতিষ্ঠানে এনার্জি ড্রিঙ্কসের উৎপাদন ও বাজারজাতের অনুমোদনই দেয়া হয়নি। বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তারা জানান, ক্ষতিকর বিবেচনায় এই পণ্যের মান নির্ধারণ না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সফ্ট ড্রিংকস নামে যেসব পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করা হচ্ছে তাহলো কার্বোনেটেড বেভারেজ। এসব পণ্যের বিজ্ঞাপনে এনার্জি ড্রিংকস শব্দ উল্লেখ করায় বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে। কার্বোনেটেড বেভারেজ কোন এনার্জি ড্রিংকস পণ্য নয়। অথচ অনেক প্রতিষ্ঠান পণ্যের গায়ে এনার্জি ড্রিংকস উল্লেখ করছে। এটি এক ধরনের অপরাধ। এর বিজ্ঞাপনে ও পণ্যের গায়ে ‘এনার্জি ড্রিংকস’ উল্লেখ না করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয়া হচ্ছে বলে জানান তারা। বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রতিটি পণ্যেরই একটি আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড থাকে। সে অনুযায়ী দেশে পণ্যের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের আগে বিএসটিআই থেকে মান নির্ধারণ করা হয়। মান নির্ধারণের পরেই কেবল তা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনুককূলে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে অনুমোদন বা লাইসেন্স দেয়া হয়ে থাকে। এনার্জি ড্রিংকসে যেহেতু উচ্চমাত্রায় ক্যাফেইন থাকে তাই এর মান নির্ধারণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএসটিআই। মান নির্ধারণ না হওয়ায় দেশে এসব পণ্যের বৈধ উৎপাদন ও বাজারজাতের কোন সুযোগ নেই। আবার বিদেশ থেকে আমদানির অনুমতিও বিএসটিআই কাউকে দেয়নি। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব পলিসি অনুযায়ী কেউ যদি আমদানি করে থাকে তার দায় বিএসটিআইয়ের নয়। তারা অবশ্য উল্লেখ করেন বাজারে এনার্জি ড্রিংকস নামে কোন পণ্য বৈধভাবে দেশে বিক্রি হয় না। কার্বোনেটেড বেভারেজ নামে যে সফ্ট ড্রিংসের অনুমতি দেয়া হয়েছে সেখানে ক্যাফেইনের মাত্রা আন্তর্জাতিক মানের চেয়ে অনেক কম। ফলে এগুলো ব্যবহারে মানব শরীরে ক্ষতিকর কোন প্রভাব নেই। বিএসটিআইয়ের সহকারী পরিচালক একেএম হানিফ মাহমুদ বলেন আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সমন্বয় করেই দেশে কার্বোনেটেড বেভারেজ উৎপাদনের জন্য লাইসেন্স দেয়া হয়ে থাকে। এটি স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর নয়। এনার্জি ড্রিংকস নামে কোন পণ্য দেশে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের কোন অনুমতি বিএসটিআই কাউকে দেয়নি। এই নামে কোন পণ্যও বাজারে নেই। প্রতিষ্ঠান কর্মকর্তা নজির আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, কার্বোনেটেড বেভারেজ পণ্যের মান ঠিক আছে। প্রতি বছর এর স্যাম্পল পরীক্ষা করা হয়। নিয়মিত বিএসটিআই থেকে মনিটর করা হয়। তিনি বলেন, বেভারেজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্যের বিজ্ঞাপনে এনার্জি ড্রিংক শব্দ উল্লেখ করায় এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। এটা আসলে এনার্জি ড্রিংকস নয়। এই ধরনের বিজ্ঞাপন দেয়ার অধিকার তাদের নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এনার্জি ড্রিংকসে উচ্চ মাত্রার ক্যাফেইন থাকে, যা বাংলাদেশের জন্য অনুমোদিত নয়। পাশাপাশি টরুইনন ও ইনোসিটল রয়েছে। এটি পান করলে দেহের ব্লাড সার্কুলেশন বা রক্তসঞ্চালন বেড়ে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এছাড়া এটি শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের পান করাও নিষিদ্ধ। বাংলাদেশে এটি উৎপাদনের অনুমোদন না থাকলেও কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এনার্জি ড্রিংকস উৎপাদন করা হয়। কিন্তু পণ্যের লেবেলে এটি শিশু ও গর্ভবতী মহিলাদের ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকে। এছাড়া কিছু মুসলিম দেশে রয়েছে এর ব্যবহার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে যারা কার্বোনেটেড বেভারেজ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত তারা দীর্ঘদিন ধরেই এনার্জি ড্রিংকসের মান নির্ধারণে বিএসটিআইকে অনুরোধ করে আসছে। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে দেশে এই পণ্যের মান নির্ধারণ করা যায় কিনা তা নিরীক্ষা করতে বিএসটিআইয়ের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অংশীজনের এই আবেদন যাচাই বাছাইয়ের জন্য বিএসটিআইয়ের অধীনে টেকনিক্যাল কমিটিতে পাঠানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিজ্ঞানী ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা এই টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছে। তারা যাচাই-বাছাই করে দেশে এনার্জি ড্রিংকস উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের বিপক্ষে মত দেয়। এরপর স্টেকহোল্ডাররা দেশে এনার্জি ড্রিংকস আমদানির অনুমতি দেয়ার জন্য বিএসটিআইয়ের কাছে আবেদন জানালে টেকনিক্যাল কমিটি তারও অনুমোদন না দেয়ার সুপারিশ করে। অংশীজনের আবেদন টেকনিক্যাল কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে এনার্জিং ড্রিংকসের মান নির্ধারণে বিষয়টি জনগণের মতামত দেয়ার জন্য ওয়েবসাইটে দেয়া হয়। এতে এটির উৎপাদন ও বাজারজাতের বেশিরভাগই বিপক্ষে মত প্রদান করে। ফলে বিএসটিআই এনার্জি ড্রিংকসের মান নির্ধারণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এনার্জি ড্রিংকস কি ॥ কয়েকদিন ধরে এনার্জি ড্রিংকস নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা চলছে। বিএসটিআই বলছে, এই পণ্যের কোন লাইন্সেস কোন প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়নি। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত সচিব মাহাবুব কবির বলেছেন, এটা বাজারজাতকরণ করা যাবে না। উৎপাদন করা যাবে না। প্রচার ও বিজ্ঞাপন দেয়া যাবে না। এ বিষয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত হয়েছে। শীঘ্রই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কার্বোনেটেড বেভারেজের নামে লাইসেন্স নিয়ে এত দিন যারা এনার্জি ড্রিংকস বাজারজাত করেছে এখন আর তারা তা পারবে না। বাজারে যাদের এনার্জি ড্রিংকস আছে তাদের চিঠি দিয়ে এগুলো তুলে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হবে। পাশাপাশি যাতে এনার্জি ড্রিংকস আমদানি বন্ধ হয় সে জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কাস্টমসকেও চিঠি দেয়া হবে। বিএসটিআই কর্মকর্তারা জানান, এনার্জি ড্রিংকস হলো উচ্চ মাত্রার ক্যাফেইনযুক্ত কোমল পানীয়। এ ছাড়াও এটিতে টরুইন এবং ইনোসিটল নামে এক ধরনের পদার্থ থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত এনার্জি ড্রিংকসে ক্যাফেইনের মাত্রা সাড়ে তিন শ’ থেকে সাড়ে চার শ’ পিপিএম থাকায় মানব স্বাস্থ্যের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। এটি শিশু এবং গর্ভবতী মহিলাদের পান করাও নিষিদ্ধ। বেশিমাত্রায় এ্যালকোহল থাকায় এটি মানব দেহের ব্লাড সার্কুলেশন বাড়িয়ে দেয়। ফলে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে বেশি। গর্ভবতী মহিলারা এটি পান করলে গর্ভপাত হয়ে যাবে। কোন মা যদি এনার্জি ড্রিংক খায় তাহলে বুকের দুধ খাওয়া শিশুর ওপর প্রভার পড়বে। কানাডা অস্ট্রেলিয়ায় এটি ব্যবহার হলেও নারী, শিশু ও গর্ভবতী নারীদের এটি পান না করায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া থাকে। এই বিবেচনায় নিয়ে দেশে এটি উৎপাদন বিপণন এবং বিদেশ থেকে আমদানির অনুকূলে বিএসটিআই কোন প্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্রও দেয়নি। অপরদিকে দেশে অনুমোদিত সফ্ট ড্রিংক বা কার্বোনেটেড বেভারেজে ক্ষতিকর মাত্রায় কোন ক্যাফেইন নেই। আন্তর্জাতিক মানের চেয়েও কম মাত্রার ক্যাফেইন ব্যবহার হয়েছে। তারা বলছে, বিএসটিআই নিয়মিত মনিটরিংয়ে যে তথ্য পেয়েছে তাতে কার্বোনেটেড বেভারেজের নামে কেউ এনার্জি ড্রিংকস উৎপাদন ও বাজারজাত করছে না। তবে যারা বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে এনার্জি ড্রিংকসের কথা বলছে তাদের আমরা চিঠি দিয়ে বিজ্ঞাপনের ভাষা পরিবর্তনের কথা বলেছি। দেশে যেসব সফ্ট ড্রিংক বা কার্বোনেটেড ব্যবহারের অনুমোদন রয়েছে ॥ বিএসটিআই কর্মকর্তারা বলছেন, বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্তির কারণে এনার্জি ড্রিংকস নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের পণ্যের গায়ে এনার্জি ড্রিংক লেখা থাকে। এই ধরনের বিজ্ঞাপন দেয়ার অধিকার কোন প্রতিষ্ঠানের নেই। বিএসটিআই পরিচালক (মান) ইসহাক আলী বলেন, যারা বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে এনার্জি ড্রিংকসের কথা বলছে তাদের চিঠি দিয়ে বিজ্ঞাপনের ভাষা পরিবর্তনের কথা বলেছি। বাজারে কার্বেনেটেড পণ্যের মধ্যে রয়েছে পেপসি, পেপসি ডায়েট, পেপসি কোলা, সেভেন আপ, সেভেন আপ লাইট, ম্যারিন্ডা অরেঞ্জ, মাউন্টেইন ডিউ, স্টিং, ইভারভেস, আরসি কোলা, আরসি লেমন, আরসি অরেঞ্জ, আরসি কোলা ডায়েট, বিগ বস, রয়্যাল কোলা সোডা, চিয়ার আপ, ম্যাক্স কোলা, ম্যাক্স লেমন, অরেঞ্জ লেমন, কোনিয়া লিচিনা, ইউরো (লেমন অরেঞ্জ কোলা) রয়্যাল টাইগার, ফিজ আপ, ব্ল্যাক হর্স, র‌্যয়াল টাইগার ডায়েট, ইউরো অরেঞ্জি, ইউরো লেমনঞ্জি, প্রাণ আপ, ফাইভফ্লাই, ট্যাঙ্গো (অরেঞ্জ, ম্যাঙ্গো, লিচি), কালার (অরেঞ্জ, লেমন), পাওয়ার, বুলেট, কোকাকোলা, রেস, স্প্রাই, স্প্রাই অরেঞ্জ, লেমন, লায়ন কিং, পপস সাইডার (গ্রীন মেলন, পাইন আপেল, ম্যাঙ্গো), বুমবুম, বাফালো লেমন আপ, বাফালো কোলা ক্লাসিক, বাফালো লেমন আপ, উইংস, অ্যাহ কোলা, জি-৫০, ওডি (অরেঞ্জ) ম্যাক্স কোলা, ম্যাক্স লেমন, চিয়ার আপ, কোলাকোলা স্পাইট, ফানটা, পোকোলোকো, ফ্রেক (ধুম কোলা গুগলি সউল আপ, ম্যাজেন্ডা, ক্লাব সেভেন সোডা,) গিয়ার, স্পাইট, স্পাইট জিরো সুগার, ফানটা কোলাকোলা, কোলোকোলা জিরো, ডায়েট কোক, থাম্বস, আপ চার্জ, ফানটা লিচি ফ্লেবার, জিল আপ, জিল অরেঞ্জ, জিল কোলা চাঙ্গা, ইউরো (লেমন, অরেঞ্জ, কোলা), দেশবন্ধু (কোলা লেমন), ব্লু ক্রাস হট ব্লাড, নেকটার (লেমন, অরেঞ্জ) প্রভৃতি। বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এই কার্বোনেটে পণ্যে ক্যাফেইনের মাত্রা আন্তর্জাতিক মাত্রার চেয়ে অনেক কম। প্রতি বছর এইসব পণ্যের স্যাম্পল পরীক্ষা করা এবং মনিটর করা হয় বিএসটিআইয়ের পক্ষ থেকে।
×