ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পাঁচ দফা দাবিতে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের মহাসমাবেশ

সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বর্জনের ডাক

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বর্জনের ডাক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবাই মিলে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। তারা বলেছেন, সংখ্যালঘু-আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত যে কোন ধরনের বৈষম্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে জাতীয় ও স্থানীয়ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি বিশ্বাস না থাকা ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধ নয় এমন কাউকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া যাবে না। ধর্মীয় উপাসনালয়কে নির্বাচনী কর্মকা-ে ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। নির্বাচনে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক উস্কানি রোধে নির্বাচন কমিশনকে কঠোর আইন প্রণয়নের দাবিও জানান বক্তারা। শুক্রবার রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে আয়োজিত এক মহাসমাবেশ থেকে এসব দাবি জানান তারা। ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষায়’ এই মহাসমাবেশের আয়োজন করে ২২ সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্যপরিষদ। নির্বাচন কমিশনের কাছে দাবি জানিয়ে বক্তারা বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। যদি না করা হয় তবে সংখ্যালঘু-আদিবাসীরা ভোটকেন্দ্রে যাবে না। সেইসঙ্গে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস রোধে গ্রামে গ্রামে প্রতিরোধ কমিটি গঠন করারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। সমাবেশ থেকে ২০১৫ সালের জাতীয় ঐকমত্যের ৭ দফা দাবিনামার প্রেক্ষিতে এবার পাঁচ দফা ঘোষণা করা হয়েছে। দফাসমূহের মধ্যে রয়েছেÑ সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী জনপ্রতিনিধিকে মনোনয়ন না দেয়া-নির্বাচিত হয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বে থেকে সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী-স্বার্থবিরোধী কোন ধরনের কর্মকা-ে জড়িত কাউকে প্রার্থী দেয়া হলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী সেসব নির্বাচনী এলাকায় ভোট বর্জন করবে। যেসব দল বা জোট সাত দফা দাবির প্রতি সমর্থন দিয়ে নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন করবে তাদের প্রতি সমর্থন দেবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। আদিবাসী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণসহ জনসংখ্যার আনুপাতিকহারে সংসদে ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘুদের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহকে দায়িত্ব নিতে হবে। নির্বাচনের পূর্বাপর ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নির্বাচনে সব ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার ব্যবহার-মন্দির-মসজিদ-গির্জা-প্যাগোডাসহ ধর্মীয় সব উপসনালয়কে নির্বাচনী কর্মকা-ে ব্যবহার, নির্বাচনী সভাসমূহে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রদান বা কোনরূপ প্রচার নিষিদ্ধকরণের পাশাপাশি তা ভঙ্গের দায়ে সরাসরি প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলসহ ন্যূনতম তাকে এক বছর কারাদ- ও অর্থদ-ের বিধান রেখে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনী আইনের যুগোপযোগী সংস্কার করা। নির্বাচনের পূর্বে সরকারকে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় ও জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন-সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন-অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যার্পন আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন-সমতলে আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠন-বর্ণবৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন এবং পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বাস্তবায়নসহ পার্বত্য শান্তিচুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নে রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। সমাবেশকে কেন্দ্র করে সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে নেতাকর্মীরা আসতে থাকেন। দুপুরের আগেই জনতার ঢল নামে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানজুড়ে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন দাবি দাওয়া আগত নেতা-কর্মীরা প্ল্যাকার্ড, ব্যানার ও ফেস্টুনের মাধ্যমে তুলে ধরেন। মহাসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, রাষ্ট্রের প্রতি অনাস্থার কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন দেশ ত্যাগ করছেন। তিনি বলেন, সরকারের প্রতি আহ্বান বারবার সাম্প্রদায়িক হামলা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের রক্ষাকবচ হিসেবে সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে। তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কল্যাণে পৃথক মন্ত্রণালয়ের দাবি জানিয়ে বলেন, দেশের বেশিরভাগ মানুষ অসাম্প্রদায়িক তা বিশ্বাস করি। স্বাধীনতার মূল নীতি বাস্তবায়নে আন্তরিক হলে দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর হবে। আমাদের কর্তব্য সব শক্তি দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ করা। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরেও আমরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর-উপাসনালয়ে আক্রমণ দেখেছি। প্রতিবেশী ও রাজনৈতিক নেতারা আক্রমণ প্রতিরোধে এগিয়ে আসলে নির্যাতন বড় আকার ধারণ করত না। নির্যাতন রোধে ও অপরাধীদের বিচারে প্রশাসন বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেনি। এমন বাস্তবতায় রাষ্ট্রের প্রতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনাস্থার তৈরি। সব নির্যাতন-নিপীড়ন বন্ধের দায়িত্ব রাষ্ট্রের একথা উল্লেখ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দায়িত্ব নিয়ে যারা বলেন আমাদের চেয়ে ভাল শাসক আর নেই তাদের প্রতি ধিক জানাই। তিনি বলেন, প্রতিটি অন্যায়-অবিচার বন্ধে প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক। কিন্তু কাদের দুর্বলতায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ বাস্তবায়ন হয় না, নির্যাতিত মানুষ বিচার পায় না তা বের করা দরকার। প্রধানমন্ত্রী তা বের করতে না পারলে সবাই বলবে শেখ হাসিনার আমলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিপন্ন। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে কেউ সুযোগ নিলে ছাড় দেয়া যাবে না। ঐক্য ন্যাপের নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে বাঁচাতে আজকের এই সমাবেশ। বিনাযুদ্ধে সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে পরাস্ত হয়ে যাব এটা মেনে নেয়া যায় না। তিনি বলেন, আমরা সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাই না। মৌলবাদী শক্তির বিনাশে রাষ্ট্রকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, স্বাধীনতার দুশমন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত বহাল তবিয়তে থাকবে আর কোন যুক্তিতে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ সংখ্যালঘু শূন্য হবে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ৩৭ জেলায় সংখ্যালঘু নির্যাতনকারীরা কেন দায় মুক্তি পেল এমন প্রশ্ন রেখে প্রবীণ এই রাজনৈতিক নেতা বলেন, পাহাড় ও সমতলে রক্তের হোলি খেলার জবাব দিতে হবে। দায় মুক্তি মেনে নিতে পারি না। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন, সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতায় আসলে এক দিনে এক লাখ মানুষকে হত্যা করা হবে। রাষ্ট্র যদি মানুষের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয় তবে এমন রাষ্ট্রকে আমি মানি না। আগামীতে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ও সাম্প্রদায়িক শক্তির সংসদ চাই না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। আদিবাসী নেতা সঞ্জিব দ্রং বলেন, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা নির্বাচনের সময় নিরাপত্তার জন্য হাহাকার করে। ১১ লাখ নির্যাতিত রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে মানবিক রাষ্ট্র হয়েছে বাংলাদেশ। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে রাষ্ট্র নিজ দেশের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করবে। আগামীতে সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে দেশকে যেতে না দেয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে খ্রীস্টান এ্যাসোসিয়েশনের নেতা নির্মল রোজারিও চাকরিক্ষেত্রে পাঁচ ভাগ আদিবাসী ও দুই ভাগ প্রতিবন্ধী কোটা রাখার দাবি জানান। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোটের আমলে ১০ হাজার সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনার কোন বিচার হয়নি। সংখ্যালঘু কমিশন গঠন ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নয়নে পৃথক মন্ত্রণালয়ের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, যে কোন মূল্যে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে। ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে আসার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে। ভবিষ্যতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নির্যাতনে ঘটনায় আইনী সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিনাশ ঘটানো সম্ভব হচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি বিশ্বাস ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন প্রার্থীকে মনোনয়ন না দেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, যাদের পাকিস্তানপ্রীতি আছে তারা যদি মনোনয়ন পান তাহলে দেশে নির্যাতন বন্ধ হবে না। ওয়াজ মাহফিলের নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে উস্কানি ও অপপ্রচার আইন করে বন্ধের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস রোধ করতেই হবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অস্তিত্ব রক্ষায় সবাইকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। মহাসমাবেশে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্যপরিষদের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রানাদাশগুপ্ত। এতে বলা হয়, উগ্রধর্মীয় মৌলবাদ দিন দিন শক্তি সঞ্চয় করছে। ফলে রাষ্ট্র ও রাজনীতি এর কাছে নতি স্বীকার করছে। সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদমুক্ত জাতীয় সংসদ দেখার দাবি জানিয়ে বলা হয়, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা আমাদের সকলের জন্য খুবই জরুরী। ১২ ভাগ ভোট পাস কাটিয়ে কোন দল বা জোট ক্ষমতায় আসবে তা যেমন ভাবা যায় না তেমনি এই ভোটারদের বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব নয়। যেসব দল ও জোটের নির্বাচনী ইশতেহারে আমাদের সাত দফা দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস থাকবে তাদের প্রতি ১২ভাগ সংখ্যালঘু ভোটারের সমর্থন থাকবে। আয়োজক সংগঠনের সভাপতি উষাতন তালুকদার এমপির সভাপতিত্বে মহাসমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন, অধ্যাপক নিমচন্দ্র ভৌমিক, জিনভোদি ভিক্ষু, ডাঃ ইকবাল আর্সালান প্রমুখ।
×