ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এ যেন আশ্রিত রোহিঙ্গাদের যন্ত্রণারই বহির্প্রকাশ

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 এ যেন আশ্রিত  রোহিঙ্গাদের  যন্ত্রণারই  বহির্প্রকাশ

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ শতাব্দীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বরতার ঘটনা নিয়ে মনে গেঁথে থাকা পাথর চাপা ক্ষোভ, নিদারুণ যন্ত্রণা, স্বজন হারানোর বেদনা, চোখের সামনে বাপ-দাদার ভিটে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়া, সম্মানের সঙ্গে স্বদেশে ফিরে যাওয়া, ফিরে যাওয়ার পর একজন নাগরিকের প্রাপ্য সকল সুযোগ-সুবিধা বাধাহীনভাবে ভোগ করাসহ আনুষঙ্গিক সব কিছু বিশ্ব দরবারে অর্থাৎ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাবলীল ভাষায় উত্থাপন করায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সর্বস্তরে বড় ধরনের স্বস্তি নেমে এসেছে। এ যেন তাদের মনের কথা বাংলাদেশ আবারও জানান দিল পুরো বিশ্বকে। রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠী সদস্যরা আরও খুশি এ কারণে যে, তাদের নিয়ে সঙ্কট সামাল দেয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুটি সম্মাননা লাভ। উল্লেখ করা যেতে পারে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সেনা বর্বরতার মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় লাভ করার পর সঙ্কট সামাল দেয়ার ক্ষেত্রে অনুকরণীয়, দূরদর্শী ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের স্বীকৃতি হিসেবে শেখ হাসিনাকে ‘ইন্টারন্যাশনাল এ্যাচিভমেন্ট এ্যাওয়ার্ড’ ও ‘স্পেশাল রিকগনিশন ফর আউটস্ট্যান্ডিং লিডারশিপ’ দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা ইস্যুতে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর আয়োজনে জাতিসংঘ সদর দফতরে এক গোল টেবিল আলোচনায় যে সুনির্দিষ্ট তিনটি প্রস্তাব দিয়েছেন তা নিয়েও রোহিঙ্গারা খুশি। এ প্রস্তাবসমূহ হচ্ছে- রোহিঙ্গা শিশুদের মানসিক আঘাত লাঘব ও সামাজিক প্রয়োজন মেটাতে নজর দেয়া, তাদেরকে অনানুষ্ঠানিক ও জীবন দক্ষতাভিত্তিক বিশেষ শিক্ষা প্রদান এবং তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি অনুযায়ী শিক্ষা প্রদান করা। শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন, আমাদের বুঝতে হবে যে সংঘাত, জাতিগত নিধন এবং গণহত্যা থেকে পালিয়ে বাঁচা এসব শিশু মানসিক আতঙ্ক বহন করছে, বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা শিশুরা এখন ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশে বসবাস করছে বলে তারা স্বাভাবিক শিক্ষায় অভ্যস্ত নয়। প্রধানমন্ত্রী এও বলেছেন, রোহিঙ্গা শিশুরা যখন তাদের জন্মভূমিতে ফিরে যাবে তখন যেন শিক্ষাসহ অন্যান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়। কুতুপালং আশ্রয় শিবিরে রোহিঙ্গা মাঝি জিয়াবুল হক, বালুখালী ক্যাম্পের নুরুল বশর, হাবিব উল্লাহ, বশির উল্লাহ, সৈয়দ আকবর, নুর মোহাম্মদ জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধানের বিষয়টি নিয়ে তার প্রস্তাব এবং বাংলাদেশের পক্ষে এই ইস্যুটিকে ব্যাপকভাবে প্রাধান্য দেয়ার ঘটনায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শুক্রবার বিকেলে জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা শুধু প্রশংসনীয় নয়, সারা বিশ্বের নিপীড়িত নির্যাতিত এবং শরণার্থী হয়ে ভিনদেশে পরবাসী হয়ে থাকাদের জন্য নবপ্রেরণার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এসব রোহিঙ্গা মাঝিরা অভিন্ন কণ্ঠে জানিয়েছেন, আমরা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতায় বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মানবিক দৃষ্টিকোণ নিয়ে আমাদের জন্য সীমান্তের দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। তার নির্দেশে আমরা শুধু আশ্রয় পাইনি। তাৎক্ষণিকভাবে ত্রাণ সহায়তাও পেয়েছি। যে কারণে আমাদের কোন সদস্য আশ্রয় অভাবে বা খাদ্যাভাবে মৃত্যুর মুখে পড়েনি। মিয়ানমার পক্ষ বাংলাদেশ সরকারের এ ধরনের আচরণে সামান্যটুকুও প্রদর্শন করলে আমাদের হয়ত বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসতে হতো না। জাতিসংঘ রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর জোরালো বক্তব্যে আমরা নতুন আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। অপরদিকে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও সংগ্রাম কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক হামিদুল হক চৌধুরী তার প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সুনির্দিষ্ট এবং সমাধানের পথও তিনি দেখিয়েছেন। এখন বল মিয়ানমারের কোর্টে। এরপরেও মিয়ানমারে বোধোদয় না ঘটলে তা হবে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। পুরো বিশ্ব সমাজের কাছে ইতোমধ্যেই মিয়ানমারের বর্তমান সরকার ঘৃণীত ও নিন্দিত। বিষয়টি চরম রূপ নেয়ার আগেই মিয়ানমার সরকারকে এ বিষয়টি সর্বাগ্রে স্থান দিয়ে অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করতে হবে। তিনি আরও জানিয়েছেন, সারা বিশ্ব এক হয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে রোহিঙ্গাদের আর যাতে নিজেদের ভিটেমাটি ছেড়ে দেশান্তরি হতে না হয়। এর পাশাপাশি মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিচারের বিষয়টিও ত্বরান্বিত করতে হবে। অধ্যাপক হামিদুল হক চৌধুরী আরও জানান, উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলে স্থানীয় অধিবাসীরা বর্তমানে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিয়ে এক মহা বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপর্যুপরি উদ্যোগ ও কূটনৈতিক সফল তৎপরতায় তারা আশাবাদী হয়ে পথ চেয়ে আছেন। রোহিঙ্গাদের এখনও শুধু আশ্রিত নয়, এলাকাবাসী অনেকটা ভিনদেশী মেহমানের মর্যাদা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তা দিনের পর দিন হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ অধিবেশনে তার বক্তৃতায় এ বিষয়টিও উল্লেখ করায় উখিয়া-টেকনাফের স্থায়ী বাসিন্দাদের মনের অব্যক্ত বেদনার বিষয়টিরও বহির্প্রকাশ ঘটেছে বলে তিনি মত ব্যক্ত করেন।
×