ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অপরিকল্পিত ফুটওভারব্রিজ স্থানান্তরের উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

অপরিকল্পিত ফুটওভারব্রিজ স্থানান্তরের উদ্যোগ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সঠিক নিয়ম না মেনে রাজধানীর অপ্রয়োজনীয় স্থানে অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ফুটওভারব্রিজগুলো স্থানান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি)। সংস্থা দুটি বলছে, যেসব ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার করা হচ্ছে না কিংবা নির্ধারিত স্থান থেকে অপেক্ষাকৃত দূরে, সেসব ফুটওভারব্রিজ স্থানান্তর করে সঠিক স্থানে পুনঃর্র্নিমাণ করা হবে। আর ব্যবহার হওয়া ফুটওভারব্রিজগুলোকে দৃষ্টিনন্দন করা হবে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এ কাজ শুরু করা হবে। বিষয়টি নিয়ে সংস্থার সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে একাধিক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে এতে কী পরিমাণ ব্যয় হবে তা এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। অথচ এই ফুটওভারব্রিজগুলো নির্মাণ করতে সিটি কর্পোরেশনের ২০০ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে যেসব ফুটওভারব্রিজ রয়েছে সেগুলো সঠিক নিয়মে নির্মিত হয়নি। এর অধিকাংশই নির্মাণ হয়েছে ভুল জায়গায়। ফুটওভারব্রিজগুলোর উচ্চতা অনেক বেশি। দেখতেও ভাল লাগে না। একইসঙ্গে সিঁড়ির ধাপগুলো আনুপাতিকভাবে সঠিক নয়। বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষকে এগুলো ব্যবহার করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। এ কারণে ফুটওভারব্রিজ রেখে যানবাহনের মধ্য দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পথচারীরা রাস্তা পারাপার হচ্ছেন। বহু অর্থ খরচ করে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলগাছ রোপণ ও ব্যবহারে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেও কোন সফলতা আসছে না। যার ফলে বাড়ছে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা। দুই সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে রাজধানীতে ৮৭টি ফুটওভারব্রিজ রয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা দক্ষিণে ৩২টি ও ঢাকা উত্তরে ৪৯টি। ডিএনসিসিতে আরও দুটি নির্মাণাধীন এবং নির্মাণের পরিকল্পনায় আছে আরও তিনটি ফুটওভারব্রিজ। এ ছাড়া সংস্থাটির আওতায় রোড এ্যান্ড হাইওয়ের ৫টি এবং রাজউকের একটি ফুটওভারব্রিজ রয়েছে। পাশাপাশি ঢাকা দক্ষিণের একটি ও উত্তরের দুটি আন্ডারপাস রয়েছে। দুই সিটি সূত্র জানিয়েছে, এসব ফুটওভারব্রিজ নির্মাণে খরচ হয়েছে ২০০ কোটি টাকার বেশি। ২০০৪ সালে নগর গবেষণা কেন্দ্র রাজধানীর ২৫টি ফুটওভারব্রিজ নিয়ে জরিপ চালায়। এতে ফুটওভারব্রিজ ব্যবহারে পথচারীদের অনীহার পেছনে বেশ কিছু কারণ তুলে ধরা হয়। এরমধ্যে অন্যতম ফুটওভারব্রিজ দিয়ে চলাচলে অস্বস্তি, নোংরা পরিবেশ, সঠিক স্থানে নির্মাণ না করা, নিরাপত্তাহীনতা, হকারদের দখলদারিত্ব, ছিন্নমূল মানুষের বসবাস, অত্যাধিক উচ্চতা ও অধিক সময় ব্যয়। ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশের (আইএবি) তথ্যানুযায়ী, দেশের কোন ফুটওভারব্রিজ সঠিক নিয়মে নির্মিত হয়নি। ৯৯ শতাংশই নির্মিত হয়েছে ভুল জায়গায়। এগুলোর উচ্চতাও অনেক বেশি। একই সঙ্গে সিঁড়ির ধাপগুলো আনুপাতিকভাবে সঠিক নয়। দেখতেও ভাল লাগে না। কোন বয়স্ক মানুষকে ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার করতে হলে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। যার ফলে মানুষ এগুলো ব্যবহার করছে না। এ অবস্থায় রাজধানীর অপ্রয়োজনী ও পথচারীশূন্য স্থানে নির্মিত ফুটওভারব্রিজগুলো স্থানান্তরের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি)। পাশাপাশি ব্যবহার হওয়া ফুটওভারব্রিজগুলো দৃষ্টিনন্দন করতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেন, ‘আমাদের যেসব ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার হয় না কিংবা ইতোপূর্বে অপ্রয়োজনীয় স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলো স্থানান্তর করে প্রয়োজনীয় ও লোকসমাগমপূর্ণ স্থানে নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’ নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশনগুলো সুপরিকল্পতিভাবে অনেক কাজ করে না। কোন কোন লোকেশনে ফুটওভারব্রিজ দরকার, আবার কোন স্থানে জেব্রা ক্রসিং করা দরকার সে নিয়ে কোন গবেষণা করা হয়নি। এ নিয়ে পথচারী ও পেশাজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। কোথায় ফুটওভারব্রিজ আবার কোথায় জেব্রা ক্রসিং দিয়ে মানুষের পারাপার করা দরকার সেখানে সেটা দেখতে হবে। এজন্য গবেষণা করতে হবে। পরিকল্পনা ছাড়া আবারও স্থানান্তর করা হলে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। অপ্রয়োজনীয় স্থানে ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করলে তা ব্যবহার করবে না জনগণ।’ দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন সূত্র জানিয়েছে, সংস্থার ৫টি অঞ্চলে ৩২টি ফুটওভারব্রিজ রয়েছে। এগুলো হচ্ছেÑ কলাবাগান বাসস্ট্যান্ড, সাইন্সল্যাব মোড, নিউমার্কেট, শাহবাগ (বিএসএমএমইউ হাসপাতাল এবং বারডেমের লিংক ব্রিজ), শাহবাগ (বারডেম ও শিশুপার্ক), শাহবাগ (এলিফ্যান্ড রোড), রমনা আইইবির সামনে, কাকরাইল উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনে, কার্জন হল (কলেজ রোড), বাংলামোটর, শুক্রবাদ মেট্রো শপিংমল (মিরপুর রোড), সোবহানবাগ মসজিদ, ল্যাবএইড হাসপাতাল, বসুন্ধরা শপিংমল, বেইলি রোড অফিসার্স ক্লাব, পরিবাগ, সাত মসজিদ রোড, প্রেসক্লাব, পল্টন বায়তুল মোকাররম মসজিদের পেছনে, মুগদাপাড়া জনপথ সড়ক, জনপথ রোড (বাসাবো), কমলাপুর, মতিঝিল বয়েজ স্কুল, মতিঝিল শাপলা চত্বর, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল, নটরডেম কলেজের সামনে, আজিমপুর গার্লস স্কুল, সোনারগাঁও রোড (বুয়েট), নর্থসাউথ রোডে, সুরিটোলা হাইস্কুলের সামনে, সদরঘাট বাংলাবাজার মোড়, হোটেল ইলিসিয়াম (হাটখোলা রোড) ও জুরাইনে। অপরদিকে, উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ফুটওভারব্রিজগুলো হচ্ছেÑ আবুল হোটেল, রামপুরা টিভি সেন্টার, মধ্যবাড্ডা, উত্তরবাড্ডা, ক্যামব্রিয়ান কলেজ, নতুনবাজার, নর্দা, ঢাকা পলিটেকনিক, তেজগাঁও কহিনূর কেমিক্যাল, মহাখালী আইসিডিডিআরবি, বনানী রোড-১১, কাকলী, তিতুমীর কলেজ, গুদারাঘাট (লিংকরোড), বাংলামোটর ক্রসিং, কাওরানবাজার (ডেইলি স্টার), ফার্মগেট (হলি ক্রিসেন্ট), ফার্মগেট (পুলিশ বক্স), কলমিলতা বাজার, পুরান বিমানবন্দর, শাহীন কলেজ, শ্যামলী, কল্যাণপুর, দারুসসালাম (টেকনিক্যাল), মিরপুর বাংলা কলেজ, মিরপুর-১, মিরপুর-২ (ক্রিকেট স্টেডিয়াম), মিরপুর-১০, মিরপুর-১৩, মিরপুর-১৪ পুলিশ স্কুল, কাজীপাড়া, আনন্দ সিনেমা হল, শেওড়াপাড়া (মনিপুরী স্কুল), আনোয়ার গার্সল স্কুল (দক্ষিণ), আনোয়ার গার্স স্কুল (পূর্ব), আদমজী কলেজ, গ্যারিসন সিনেমা, ক্যান্টনমেন্ট (সিএমএইচ), জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভারের পশ্চিম পাশে, নতুন খিলক্ষেত ক্রসিং, কুড়িল ফ্লাইওভার, খিলক্ষেত, কাওলা, নতুন বিমানবন্দর ক্রসিং, স্কলাস্টিকা স্কুল, রাজলক্ষ্মী, আজমপুর, রাজউক কলেজ, হাউজ বিল্ডিং, আব্দুল্লাহপুর ও কুর্মিটোল জেনারেল হাসপাতাল। আন্ডারপাসগুলো হচ্ছে- কাওরানবাজার ও গাবতলী আন্ডারপাস। এছাড়া যে তিনটি ফুটওভারব্রিজ নির্মাণাধীন রয়েছে সেগুলো হচ্ছে- রজনীগন্ধা মার্কেট (মিরপুর), আবু তালেব স্কুল (মিরপুর) ও শিশুমেলা। সরেজমিন এসব ফুটওভারব্রিজের অধিকাংশ ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার হয় না। রাস্তা পারাপারের চাপ আছে এমন স্থান থেকে ফুটওভারব্রিজ অনেক দূরে। বেশ কয়েকটিতে নেই রাতে আলোর ব্যবস্থা। এগুলো সঠিকভাবে দেখভালও করা হচ্ছে না। বেশ কয়েকটিতে ফুলগাছ রোপণ করা হলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অধিকাংশ মরে গেছে। হাতেগোনা কয়েকটি ফুটওভারব্রিজ রাস্তা পারাপারের চাহিদা রয়েছে এমন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে। জানতে চাইলে পরিবেশ বাঁচাও (পবা) আন্দোলনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, ‘ফুটওভারব্রিজ স্থানান্তর করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। সিটি কর্পোরেশনকে এগুলো ব্যবহার উপযোগী করতে হবে। আমরা যদি সচেতন হই, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো জনগণকে বাধ্য করে, তাহলে এগুলো ব্যবহার হবে।’ তিনি বলেন, ‘পরিবর্তন করা মানেই হচ্ছে প্রকল্প। সুবিধাবাদীরা নয়-ছয় করার জন্যই এগুলো করে থাকে। যারা প্রকল্প গ্রহণ করবে এবং যারা নির্মাণ করবে তারা আর্থিক সুবিধার জন্যই এসব করার পরিকল্পনা নিচ্ছে। ভাঙা আর গড়াই হচ্ছে তাদের কাজ। অপ্রয়োজনীয় স্থানে ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করার কারণে লাভবান হয়েছে অসাধু কর্মকর্তা ও একশ্রেণীর ঠিকাদার।’ সরেজমিন দেখা গেছে, বসুন্ধরা সিটির সামনের সড়কে স্থাপিত ফুটওভারব্রিজটি দিয়ে পথচারীদের পারাপার নেই বললেই চলে। তারপরও অপ্রয়োজনীয় এ ফুটওভারব্রিজটি দীর্ঘদিন টিকে আছে। বেইল রোড অফিসার্স ক্লাব ফুটওভারব্রিজে গিয়েও দেখা গেছে একই অবস্থা। এই ফুটওভারব্রিজটিও ব্যবহার হচ্ছে না। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ব্রিজ এলাকায় রাস্তা পারাপারে জনগণের কোন চাপ নেই। এটি সঠিক জায়গায় স্থাপন করা হয়। বেইলি রোড অফিসার্স ক্লাব সংলগ্ন স্থান থেকে সরিয়ে রাস্তার বিপরীত পাশে স্থাপন করায় রাস্তা পার হয়ে ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার করতে হয়। যে কারণে এটি ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ। রাজধানীর গুলশান-বাড্ডা লিংক রোডের গুদারাঘাট সংলগ্ন ফুটওভারব্রিজটির অবস্থাও একই। এটিতে দৈনিক ১০ জন মানুষও পারাপার হয় না জানিয়ে পাশের দোকানি রাজিব উদ্দিন বলেন, ‘এতে কোন মানুষই উঠে না। নিচের রাস্তা দিয়েই চলাচল করে। অনেক দুর্ঘটনা ঘটে।’ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র জামাল মোস্তফা বলেন, ‘আমরাও আমাদের ফুটওভারব্রিজগুলো ব্যবহার উপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছি। যেখানে থেকে ফুটওভারব্রিজ উঠিয়ে নেয়ার দরকার সেখান থেকে উঠিয়ে নেব। আবার যেখানে বসালে পথচারীদের জন্য উপযোগী হবে সেখানে বসাব। আর যেগুলো ব্যবহার হচ্ছে সেগুলোকে দৃষ্টিনন্দন করার উদ্যোগ রয়েছে।’
×