ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সৌম্য সালেক

ছন্দে সারল্যে স্বদেশের ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৭:৩৭, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ছন্দে সারল্যে স্বদেশের ইতিহাস

বর্তমান সময়ের কবিরা ছন্দকে এড়িয়ে চলছেন। বলা হচ্ছে, ছন্দ ভাবের স্বাচ্ছন্দকে ক্ষুণœ করে এবং অনেক ক্ষেত্রে কবিতাকে দীর্ঘ করে ফেলে। গদ্যে উপস্থাপনার কলকাঠি কবির হাতে থাকে এবং সেখানে তিনি ইচ্ছে মতো ভাঙা-গড়ার খেলায় এগুতে পারেন। এমন অভিযোগের বাইরেও অনেক বক্তব্য রয়েছে, কেননা কবিতা ও গদ্যের পার্থক্য নির্ধারণের একমাত্র না হলেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হলো ছন্দ। আমরা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, জসীমউদ্দীন থেকে পরবর্তী অনেক কবির অসংখ্য বিখ্যাত ছন্দোবদ্ধ কবিতা পাব, যেখানে ছন্দের মাধুর্যের পাশাপাশি ভাবেরও অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছে। আসলে ছন্দ ব্যবহারে সাফল্য-অসাফল্য [জঞঋ কবির সক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল। আমাদের উদ্দিষ্ট কবিতাগ্রন্থটি পীযূষ কান্তি বড়ুয়ার লেখা, ‘ব-দ্বীপ হতে বাংলাদেশ’। শীর্ষনামের মধ্যে ভূগোল ও দেশের প্রাকৃতিকতার পরশ থাকলেও গ্রন্থটিতে মূলত ছন্দে ছন্দে ৪৩ টিকবিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ঠাঁই পেয়েছে। ‘শেকড়’, নামের কবিতার মাধ্যমে কাব্যটি আরম্ভ হয়; কবিতাটি হাজার বছর ধরে সাগর চুমে জেগে ওঠা নদীমাতৃক সবুজ বাংলাদেশের জন্মকথা পরিবেশনের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করে লেখা হয়েছে। ‘ছয়জনপদ’ শীর্ষক লেখাটিতে খুবই চমৎকারভাবে বাংলার প্রাচীন ছয় জনপদের কথা প্রকাশিত হয়েছে। জনপদগুলোর বর্ণনা শেষে রয়েছে : ‘ছয়জনপদ ব-দ্বীপজুড়ে/ ধন-ধান্যে ভরা/ পাহাড়-সাগর শ্যামলরূপে/ ছয়খানা অপ্সরা।’ আমরা ঋগে¦দে ‘বঙ্গ’ শব্দের উল্লেখ খুঁজে পাই সেদিকে লক্ষ্য রেখেই ‘বাংলাভাষা’ কবিতাটি আরম্ভ হয়েছে: ‘যীশুর জন্মের চার হাজারের/ অধিক বছর আগে/ বঙ্গ কিংবা বঙ্গা হতে বাংলা কথা জাগে।’ কবিতাটির পরবর্তী অংশে বাংলা ভাষা গোষ্ঠী, চর্যাপদ এবং বিশ্বব্যাপী বাংলা ভাষার গৌরব ও গ্রহণযোগ্যতার কথা বিবৃত হয়েছে। গ্রন্থটিতে মৌর্য এবং গুপ্ত শাসনকাল থেকে আরম্ভ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পর্যন্ত আন্দোলন, সংগ্রামের প্রায় প্রতিটি উল্লেখযোগ্য পর্ব খুবই চমৎকার ও সহজপাঠ্য রূপে ওঠে এসেছে। সূচিভুক্ত ধারাবাহিক কতিপয় শিরোনাম এমন: বাংলা শাসন, আকবরী আমল, বার ভূঁইয়া, সিরাজ-উদ্-দৌলা, পলাশীযুদ্ধ, সাওতাল বিদ্রোহ, ফরায়েজী আন্দোলন, তিতুমীর, সিপাহী বিদ্রোহ, বঙ্গভঙ্গ, ১৯৪৭, রাষ্ট্রভাষা, ছয় দফা, ৬৯ এর গণ-আন্দোলন, সত্তরের নির্বাচন, সাতমার্চ, পঁচিশ মার্চ কালরাত, স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বাধীনতা দিবস, জয়বাংলা, বীরাঙ্গনা, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবস, সাত বীর শ্রেষ্ঠ, ১৫ আগস্ট, মাতৃভাষা দিবস এবং স্বাধীনতার স্থপতি মুজিব। পলাশীযুদ্ধে সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলা ব্রিটিশ শাসনের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়, কেবল লোভের করাল গ্রাস এ দেশেকে দুঃশাসনের আগুনে নিক্ষেপ করে, কবির উচ্চারণেও প্রবলভাবে এই খেদ ও হতাশা ধ্বনিত হয়েছে। ‘ঘসেটি আর মীরজাফরের/একটু লোভের রেশ সোনার বাংলা শ্মশান হলো পরাধীন হয় দেশ।’ গ্রন্থটি রচনা করতে গিয়ে বোধ করি লেখক বাংলাদেশের ইতিহাসকে গভীরভাবে রপ্ত করেছেন, তাই দেখা যায় খুব ঘনিষ্ঠভাবে বক্তব্যের সঙ্গে তথ্য ও পরিবেশিত হয়েছে ঠিকঠাক। কবিতার নাম ‘জয়বাংলা’, ‘ঊনসত্তর সেপ্টেম্বর মাস/ দিন পনেরোয় হলোই তা উদ্ভাস/ আফতাব আর চিশ্তী দুয়ে মিলে/ জয়বাংলা স্লোগান সেদিন দিলে/ পরের বছর জুনের এলো সাত বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে হলো মাত।’ ‘মুক্তিযোদ্ধা’, শিরোনামের কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে মুক্তি-পাগল বীর বাঙালীর সাহস ও প্রতিরোধের ভাষ্য: ‘কাঁধে ঝোলে রাইফেল অস্ত্র কী আর/ মনে জ্বলে মুক্তির শত হুঁশিয়ার।’ ভাষার জন্য বীর-যুবাদের আত্মদান বিশ্বের ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত; আমাদের এই অর্জনের স্বীকৃতি মিলেছে ১৯৯৯ সালে। মাতৃভাষা দিবস আজ পালিত হচ্ছে পৃথিবী জুড়ে, এ আমাদের পরম প্রাপ্তি: ‘দুই-হাজারে একুশ এলো/ জাতিসংঘ জুড়ে/ শোক যদিও শহীদ স্মরে/ মন তবু ফুরফুরে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি তাঁকে নিয়ে লেখা হয়েছে গ্রন্থের শেষ কবিতাটি, সেখানে প্রকাশিত হয়েছে জাতির জনকের প্রতি গভীরশ্রদ্ধা ও স্তুতি: ‘ক্যাস্ট্রোর হিমালয় মুজিব নিজে/ আজও তাঁর স্মরণে নয়ন ভিজে/ হাজার বছর সেরা মহান মুজিব/ মর্ত্যরে মাঝে তিনি স্বর্গ-প্রদীপ।’ গ্রন্থটিতে শিশু-কিশোর ও সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে বাঙালী জাতির ইতিহাসকে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন লেখক। আমরা জানি, জাতির ইতিহাস অত্যন্ত ব্যাপক, নানা ঘটনা, তথ্য ও অর্জন-বিসর্জনের মাধ্যমে যা এগিয়েছে; সেটিকে সম্পূর্ণরূপে একটি কাব্যে তুলে আনা খুবই কঠিন কিন্তু কবি-ছড়াকার পীযূষ কান্তি বড়ুয়া সেক্ষেত্রে বহুদূর এগিয়েছেন। এ গ্রন্থে লাহোর প্রস্তাবের কথা আসেনি। এছাড়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে, মওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা এবং তাজউদ্দীন আহমেদ-এর স্মরণে কবিতা থাকলে ভাল হতো। বইটিতে আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস এসেছে কিন্তু সংস্কৃতি, সৌন্দর্য, ভূগোল ও ঐতিহ্য সেভাবে আসতে পারেনি, কালেবরের সীমাবদ্ধতা হয়ত লেখার সীমারেখা টেনেছে। ঐতিহাসিক ঘটনা নির্ভর এমন গ্রন্থ আরও বৃহৎ আকারে প্রকাশ হলেও অসুবিধা হবার কথা নয়। অবশ্য এই গ্রন্থটিও আরও সংয্ুিক্ত এবং নান্দনিক প্রচ্ছদ-অলঙ্করণে পুনরায় প্রকাশ হতে পারে। এটা ছড়া-কবিতায় ইতিহাসের একটি নান্দনিক পাঠ; আমাদের শিশু-কিশোর-যুবকরা এ গ্রন্থপাঠে খুব সহজেই ছন্দে ছন্দে ইতিহাসের তথ্য-জ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে পারে। ঐতিহাসিক সত্যতা রক্ষণের পাশাপাশি কবি-ছড়াকার পীযুষ কান্তি বড়ুয়া গ্রন্থটির প্রায় পুরোটা জুড়ে ছন্দ রক্ষণেও বেশ পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। গ্রন্থটির বহুল প্রচার প্রত্যাশা করছি, সেইসঙ্গে এ গ্রন্থরচনার উদ্দেশ্য সংক্রান্ত লেখকের একটি চমৎকার কবিতাংশ উপস্থাপনের মাধ্যমে আলোচনা শেষ করছি। ‘যে শিশুটি জন্মেছে আজ জন্মাবে যে কাল যে কিশোরের জীবন-কুসুম ফুটেছে সকাল যে জানেনি স্বদেশখানি কোন ভূমিতে গড়া যার দুচোখে জানতে চেয়ে দৃষ্টি অবাক করা যে জানেনি স্বর্ণে লেখা জাতির ইতিহাস তাদের হাতে গ্রন্থখানি হোক নতুন আবাস।’
×