ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কবিতায় ব্যতিক্রমী দ্যোতনা

প্রকাশিত: ০৭:৩৩, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

কবিতায় ব্যতিক্রমী দ্যোতনা

কাল ফাল্গুনে আমন্ত্রণ জানানো কবি ফারুক আফিন্দী বাংলাকে দেখেন জীবনানন্দের চোখ দিয়ে। কিন্তু তার বর্ণনা ভিন্নতর। উপমা-উৎপ্রেক্ষা আরও আধুনিক, নান্দনিক এবং উপভোগ্য। ঘৃতজোছনায় পিঙ্গল ছাই ওড়া দৃশ্য দেখে অভিভুত কবি আষাঢ়ে পাটক্ষেতে কঙ্কালপ্রেত দেখে মূর্ছা যান। আবার আন্তর্জাতিক বৃষ্টিতে মহব্বতের মেঘপাপড়ী পরে আষাঢ় প্রদীপ জ্বালান সোনালতা হাতে। নগরবাসী কবির মধ্যে আমরা সহজেই আবিষ্কার কবি লোকজমিথ। অবশ্য এ আবিষ্কার নতুন কিছু নয়। এর আগেও তা ধ্বনিত হয়েছে আল মাহমুদে। তিতাসের বোয়ালগুলো অবলীলায় উঠে এসেছে আফিন্দীর গোলাপনগরে সন্ধ্যার আকাশ ভেঙ্গে। ‘আকাশে উপুর হয়ে আছে কড়াই পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা গলিত ঘি একজন একাকে জোছনারা এভাবেই অত্যাচার করে’ (অত্যাচার) কড়াইয়ের সঙ্গে চাঁদের আর জোছনার সঙ্গে ফোঁটা ফোঁটা গলিত ঘি এর তুলনা সমকালীন বাংলা কবিতায় এক নতুন সংযোজন। একাকিত্ব নিঃসন্দেহে কষ্টের। তবে সেই কষ্ট-জোছনার অত্যাচার কতটা আনন্দময় কিংবা বেদনার তা একমাত্র কবিই জানেন। ‘মেঘ দেখে শিশু হয়েছিলাম ও নারী পুণ্যতোয়া, মহতী গো, মহতী, এই মেঘ তুমি’ (মেঘ এবং মহতী) নারীকে মেঘের সঙ্গে তুলনা কিংবা নারীরূপী মেঘ দেখে শিশু হওয়ার যে আকাক্সক্ষা তা কবিমনের আশ্চর্য খেয়ালেরই বহিঃপ্রকাশ। কবি ফারুক আফিন্দী কবিতায় শব্দের যে নিরেট বুনন এবং বর্ণনার যে বিরল ছটা স্থাপন করেছেন তা এ সময়ের কবিদের মধ্যে ব্যতিক্রম। তার কবিতার একটি নিজস্ব ভঙ্গি আছে। বাস্তবতা, আবেগ এবং সততার মেলবন্ধনে আবদ্ধ এ কবি এগিয়েছেন ধীরে ধীরে তবে তা অবশ্যই আস্থার সঙ্গে এবং পরম ঋদ্ধতায়। কোথাও কোথাও শব্দ এবং বর্ণনা নিয়ে নিরীক্ষা তাতে যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা। কবিতার নামকরণ এবং শব্দ বিন্যাসেও এ কবি ধরে রেখেছেন তার স্বাতন্ত্র্যতা। প্রথম ভাদরে ভরা সাদরে, হেঁটে যাচ্ছে খয়েরি শামুক, ধান রোদে কয়েকটি শালিক, মৃতজোছনায় উড়ছে পিঙ্গল ছাই, ছোপ ছোপ তারার মতো কিংবা নিখোঁজ পাঁজর এখন ধঞ্চের বাড়িতেÑ কবিতার এমন নামকরণ একজন আলাদা ঘরানার আধুনিক অথচ গ্রামমুখী কবিকে শনাক্ত করিয়ে দেয়। কাব্যগ্রন্থের নাম ‘হিম নাকি তাপিত রে মন’ হলেও গ্রন্থটির কোথাও এ নামের কোন কবিতা নেই। এটাও কবির একটি বিশেষত্ব হিসেবে চিহ্নিত হয় বৈকি। কবিতাকে শব্দের চাল হিসেবে মেনে নিলে ফারুক আফিন্দীকে সে চালে অভিজ্ঞ ও সফল একজন ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা যায়। ধানের স্তূপে উড়াল সাদা বাষ্প খুঁজে ফেরা কবি সবিতার চুলক্ষেতে পিঁপড়ার স্পর্শের মতো জলবায়ুর বিলি কাটা দেখতে দেখতে ঢুকে পড়েন শামুক কুড়ানি মেয়ের ঝুড়িতে আর গাওবাদী বাঁশিটার টানে তার উচাটন মন কাচি ও হুকো নিয়ে অঘ্রাণ সকালে পুড়তে থাকে ক্রমাগত সোনারঙ আঁচে। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় আস্থাহীন কবির কাছে সংসার যেন এক নিকষিয়া তুমুল অন্ধকার। তিনি উচ্চারণ করেনÑ ‘মানুষেরা রৌদ্রে ধোঁয়ায় কাক কোলাহল করে সংসারের টানে সংসার, এই এক নিকষিয়া তুমুল অন্ধকার।’ (সংসার, এই এক অন্ধকার) বৃষ্টির প্রতি অতিমাত্রায় সংবেদনশীল কবি তার বর্ষার গ্রামজস্মৃতি নিয়ে ফিরে আসেন নগরকীর্তনে। বৃষ্টি বাতাসের সেই দোলা তার কবিতায় ব্যক্ত এভাবেÑ ‘এখানে কতো কতো দিন ডুবেছি বর্ষায় কতো কতো দিন মাথার উপর দিয়ে সাঁই- সাঁই ছুঁয়ে গেছে পইশ্চাল বৃষ্টি বর্ষা ও বাতাসের ঝাপটায় বুকের ভেতরে ভাঙচুর - বর্ষার ¯্রােত মনের ডহরে ডোবে শালিকের পাখ কাকের ডানায় জমা মেঘের পরিণয়! বরষার শাস! জীবনের ভার নিয়ে ফিরে আসি আজ নগরকীর্তনে।’ (বাইশে শ্রাবণ) একই কবিতায় কবিগুরুর প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধায় তার উচ্চারণ - ‘২২ শে শ্রাবণ দিনটির মধ্যে বৃষ্টির অনেক ভার ২২ শে শ্রাবণ কথাটার মধ্যেই বৃষ্টির সম্ভার।’ ফারুক আফিন্দী Ñ সময়ের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কবিতায় এক ব্যতিক্রমী দ্যোতনা রচনায় সদা ক্রিয়াশীল কাব্য যোদ্ধা। কবিতা তার কাছে স্বপ্নের লাটাই, বোধের ঝংকার। ‘হিম নাকি তাপিত রে মন’ কবির সেই সৃষ্টি সলতেতে যেন একবিন্দু অগ্নির স্পর্শ। এ গ্রন্থের মধ্য দিয়ে তিনি আক্ষরিক অর্থেই আবিষ্কৃত হয়েছেন এক ভিন্ন মাত্রার চিত্রল সম্ভাবনার মানুষ হিসেবে। কবি হিসেবে তার যাত্রা লোরকা কিংবা বোদলেয়রের মতো না হলেও সে পথ শামসুর রহমান কিংবা আল মাহমুদে মিশে যেতে পারে এমন ধারণা বোধ হয় অতিরঞ্জিত হবে না। অগ্রসরমান কবির কবিতা-যাত্রা নিষ্কন্টক এবং গতিময় হোক- এই প্রার্থনা। শাহীন রেজা
×