ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পপি দেবী থাপা

আফ্রিকার অহঙ্কার গ্রাসা ম্যাশেল

প্রকাশিত: ০৭:২৮, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আফ্রিকার অহঙ্কার গ্রাসা ম্যাশেল

আফ্রিকার রাজনীতিতে জীবন্ত কিংবদন্তি গ্রাসা সিমবিয়েন ম্যাশেল। শুধু আফ্রিকা নয় সারা বিশ্বে অত্যন্ত সম্মানিত একটি নাম। আফ্রিকার দুই মহান রাষ্ট্র নায়কের প্রেমিকা ও স্ত্রী হিসেবেও তার পরিচ্ছন্ন, নির্লোভ জীবনযাত্রা জনশ্রুতি। একজন মানবতাবাদী। মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এক অক্লান্ত যোদ্ধা। জন্ম ১৭ অক্টোবর ১৯৪৫, সাবেক পর্তুগীজ পূর্ব আফ্রিকা বর্তমান মোজাম্বিকের গাজা প্রদেশে। ৬ সন্তানের মধ্যে ছিলেন কনিষ্ঠ। জন্মের ১৭ দিন পূর্বে মারা যান তার বাবা। মা নিরক্ষর হলেও তাদের গোত্রের প্রধাণ নেত্রী ছিলেন। ইচ্ছে ছিল মেয়ে অন্তত মাধ্যমিক পাস করবে। অভাব অনটনের সংসার আর তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় গ্রাসা ঠিকই পেরিয়ে যান মাধ্যমিকের গণ্ডি। এর মধ্যেই ১৯৬৮ সালে গির্জার বৃত্তি নিয়ে পর্তুগালের লিজবন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব নিয়ে পড়ার সুযোগ হয় তার। রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠায় পর্তুগীজ গোয়েন্দা পুলিশের তাড়া খেয়ে ও নিশ্চিত সাজার ভয়ে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে পালিয়ে যান সুইজারল্যান্ড। ইউরোপে থাকাকালীন ১৯৭৩ এ যোগ দেন মার্কসবাদী মোজাম্বিক লিবারেশন ফ্রন্ট (ফ্রেলিমো)-তে। দলটি তখন মোজাম্বিকে পর্তুগীজ উপনিবেশবাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলায় লিপ্ত। ইউরোপ থেকে তানজানিয়ায় ফিরে ফ্রেলিমোর অপারেশনাল সদর দফতরে যোগ দেন তিনি। গ্রহণ করেন পুরোদস্তুর সামরিক প্রশিক্ষণ। সেই সংগ্রামের দিনগুলোতে মোজাম্বিকের কাবো ডেলগাদো প্রদেশে তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় সামোরা ম্যাশেলের। সামোরা তখন ফ্রেলিমোর সুপ্রিম কমান্ডার। বয়সের ঢের ব্যবধান সত্ত্বেও প্রেমে পরেন একে অপরের। ১৯৭৫-এ সদ্য স্বাধীন মোজাম্বিকের প্রথম রাষ্ট্র্রপতি সামোরার সঙ্গে আবদ্ধ হন পরিণয় সূত্রে। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে তাদের প্রেম ভালবাসার বিচিত্র উপাখ্যান। সামোরার প্রথম স্ত্রী সোরিতা লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১৯৭১ সালে। রেখে যান ৫টি সন্তান। গ্রাসার গর্ভে জন্ম নেয় আরও দুই সন্তান। সামারাÑগ্রাসার নেতৃত্বে শুরু হয় মোজাম্বিকের নতুন পথযাত্রা। স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালীন মুক্তাঞ্চল ও তানজানিয়ায় ফ্রেলিমো পরিচালিত স্কুলগুলোতে শিক্ষা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। তার সে অবদান বিবেচনায় ১৯৭৫-এ গঠিত স্বাধীন মোজাম্বিকের প্রথম সরকারের শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। একটানা ১৪ বছর দায়িত্ব পালন করাকালীন প্রতিটি নাগরিকের জন্য শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। প্রথম ১০ বছরে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় দ্বিগুণ। মোজাম্বিকের মতো একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শিক্ষার বিস্তারে তার অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছে সারা বিশ্ব। শুধু তাই নয় তিনি কথা বলেছেন শিশুদের অধিকার, পরিবার এবং সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে। রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনায় সামোরার মৃত্যু হলে ১৯ অক্টোবর ১৯৮৬ সালে পদত্যাগ করেন শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে। ততদিনে অশিক্ষার হার কমিয়ে আনতে পেরেছিলেন ৭২ শতাংশ। কাজ করেছেন যুদ্ধে পিতামাতা হারানো অনাথ শিশুদের নিয়ে। তাদের পুনর্বাসনে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। মোজাম্বিকে নারীর ক্ষমতায়নেও তার ছিল অগ্রণী ভূমিকা। অসংখ্য দেশী-বিদেশী সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। মোজাম্বিকে ন্যাশনাল অরগানাইজেশন অব চিল্ড্রেন ও ইউনেস্কো কমিশনের প্রধান হিসেবে গৃহযুদ্ধের শিকার তরুণদের নিয়ে মিশেলের নেতৃত্বে প্রণীত একটি গবেষণাপত্র জাতিসংঘ প্রকাশ করে ১১ নবেম্বর ১৯৯৬। তার এ রিপোর্ট সমস্যার গভীরে আলো ফেলে নতুন করে। নেয়া হয় কার্যকর ব্যবস্থা। এছাড়াও ভূমি মাইন সঙ্কটকে মিশেল আনেন আলোতে। তার সুপারিশে উঠে অসে, ভূমি মাইন অপসারণ হতে হবে প্রতিটি শান্তি চুক্তিতে বধ্যতামূলক। এই মাইন অপসারণের ব্যয় বহন করতে হবে যারা এই মাইন বাণিজ্যে লাভবান হয়েছেন তাদের সবাইকে। জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের অনুরোধে শিশুদের ওপর সশস্ত্র সংঘাতের প্রতিক্রিয়া নিয়ে আর একটি গবেষণা পত্র প্রণয়ন করেন। জাতিসংঘের ইতিহাসে সেটি ছিল প্রথম। তার রিপোর্ট ছুঁয়ে যায় বিশ্ববিবেক। স্বামীর মৃত্যুর পর গ্রাসা ক্রমেই জড়িয়ে পড়েন দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতিতে। ক্রমান্বয়ে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে। ৯০ দশকের শুরুতেই তাদের সম্পর্ক আলোয় আসে। তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৮ জুলাই ১৯৯৮। সেবাকর্মের জন্যও তিনি পেয়েছেন বিস্তর সম্মাননা। এর মধ্যে আছে লরিয়েট অব আফ্রিকা প্রাইজ, যেটি তাকে দেওয়া হয় ‘সাসটেনেবল এ্যান্ড অব হাঙ্গার’ কার্যক্রমের জন্য, হাঙ্গার প্রজেক্টের পক্ষ থেকে ১৯৯২ সালে। এর ৩ বছর পর ‘নানসেন মেডেল’ দেয়া হয় উদ্বাস্তু শিশুদের কল্যাণে ভূমিকা রাখার জন্য। এছাড়াও জাতিসংঘ মহাসচিব তাকেÑ ‘ক্রুসেডের ফর চিলড্রেন রাইট’ বলে অভিহিত করেন। এক পর্যায়ে ১৯৯৬ এ জাতিসংঘের মহাসচিবের জন্য তার নাম প্রস্তাব করা হলেও তিনি স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ান সে দৌড় থেকে। ১৯৯৭ সালে রানী এলিজাবেথ ১১ এর তরফ থেকে সম্মানিত হন ‘অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এ্যাম্পায়ারে’। ২০০৭ থেকে কাজ করছেন প্রবীণ অধিকারের পক্ষে। পাশাপাশি ইসরাইল-প্যালেস্টাইন, দুই কোরিয়া, সুদানের সঙ্কটসহ কাজ করছেন টেকসই উন্নয়ন, কন্যাশিশু ও নারী অধিকারের পক্ষে। ম্যাশেল বিশেষ করে গুরুত্ব দিতে চান বাল্য বিয়ে প্রতিরোধে। এছাড়াও ম্যাশেল আফ্রিকা প্রোগ্রেস প্যানেলে ১০ জন সম্মানিত সদস্যের একজন। এই প্যানেল প্রতি বছর আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাবলী চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি নীতিনির্ধারণী সুপারিশ পত্র প্রণয়ন করে। গ্রাসার জীবন এখন উৎসর্গকৃত পৃথিবীর মানুষের কল্যাণে। একথা নিশ্চিত করেই বলা যায় তিনি হাঁটছেন অমরত্বের পথে।
×