ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বজুড়ে ইলিশের স্বাদ

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বিশ্বজুড়ে ইলিশের স্বাদ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বাঙালী বলতেই ইলিশপ্রিয়। স্বাদে, ঘ্রাণে অতুলনীয় বাংলাদেশের ইলিশের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। শুধু কি খ্যাতি; ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়েছে বাংলাদেশের ইলিশ। উন্মোচন হয়েছে ইলিশ মাছের পূর্ণাঙ্গ জীবনরহস্য। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে প্রতিবছর ৫ লাখ টন ইলিশ আহরিত হয়। এর ৬০ শতাংশই আহরিত হয় বাংলাদেশে। ফলে দেশে মোট মৎস্য উৎপাদনে এককভাবে ইলিশের অবদানই প্রায় ১১ শতাংশ। জিডিপিতে এর হিস্যা ১ শতাংশের সমপরিমাণ। শীঘ্রই বাণিজ্যিকভাবে ইলিশ রফতানি করতে চায় সরকার। বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে উদ্বোধন হলো ৩ দিনব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক ইলিশ, পর্যটন ও উন্নয়ন উৎসব ২০১৮।’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। বক্তব্যে তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে পৌঁছে গেছে ইলিশের স্বাদ। ইউরোপীয় ও আমেরিকানদের কাছে এখন পছন্দের শীর্ষে মাছটি। তাই শীঘ্রই বাণিজ্যিকভাবে সরকার ইলিশ রফতানি করবে। মন্ত্রী বলেন, বিশ্ব বাজারে বাণিজ্যিকভাবে ইলিশ রফতানির প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পেলেই রফতানির এ কার্যক্রম শুরু হবে। তিনি বলেন, পদ্মায় ইলিশ হারিয়ে গিয়েছিল। সরকারসহ সবার প্রচেষ্টায় এখন আবার তা ফিরে এসেছে। বর্তমানে ইলিশ উৎপাদন ৬৬ ভাগ বেড়েছে। ফলে দেশে মাছের চাহিদার ১২ শতাংশই পূরণ করছে ইলিশ। মন্ত্রী আরও বলেন, মা ইলিশ রক্ষায় প্রতিবছর ইলিশ প্রজনন মৌসুমে নদী ও সমুদ্রে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার। সে অনুযায়ী আগামী ৭ অক্টোবর থেকে আবারও শুরু হচ্ছে সরকারী নিষেধাজ্ঞা। তিনি বলেন, সারাবছরই মা ইলিশ ডিম দিয়ে থাকে। তবে বছরের ২২ দিন (৭ থেকে ২৯ অক্টোবর) বেশিরভাগ ইলিশ ডিম দেয়। তাই উৎপাদন বাড়াতে প্রজনন মৌসুমে ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। মা ইলিশ রক্ষায় সরকার বিভিন্ন সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে সারাদেশে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করবে। নিষেধাজ্ঞার এ সময়ে সারাদেশে ইলিশ পরিবহন, মজুদ, বাজারজাতকরণ বা বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি এ সময়ে জেলেদের জীবিকা নির্বাহের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। উৎসবের আহ্বায়ক কবি আসাদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সংসদ সদস্য কাজী রোজী, ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব শ্যামসুন্দর সিকদার প্রমুখ। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন শিশুসাহিত্যিক ফারুক হোসেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন পদক্ষেপ বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক জান্নাতুন নিসা। উল্লেখ্য, ২৯ সেপ্টেম্বর শনিবার বেলা ১১টা থেকে চাঁদপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে এই উৎসবের দিনব্যাপী সমাপনী পর্ব অনুষ্ঠিত হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে বিশ্বে প্রতিবছর ৫ লাখ টন ইলিশ আহরিত হয়। এর ৬০ শতাংশই আহরিত হয় বাংলাদেশে। ফলে দেশে মোট মৎস্য উৎপাদনে এককভাবে ইলিশের অবদানই প্রায় ১১ শতাংশ। সার্বিক প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় জিডিপিতে এর হিস্যা ১ শতাংশের সমপরিমাণ। কয়েক বছর ধরেই দেশে ইলিশের উৎপাদন ৩ থেকে ৪ লাখ টনের মধ্যে ওঠানামা করছে। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৩ লাখ ৮৫ হাজার টন। তবে ইলিশের গড় উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে ৩ লাখ টনের মতো। এই হিসেবে প্রচলিত বাজার মূল্যে প্রতি কেজির গড় দাম কম করে ৬৫০ টাকা ধরা হলে সাড়ে ৩ লাখ টন ইলিশের সার্বিক বাজার মূল্য দাঁড়ায় ২২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এই হিসেবে চলতি মৌসুমে ৭০-৭৫ শতাংশ মা-ইলিশ জেলেদের জালে ধরা পড়ায় এর বাজার মূল্য দাঁড়াবে ১৫ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা। মাছ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ইলিশ পাওয়া যায় বিশ্বের এমন ১১টি দেশের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই ইলিশের উৎপাদন ক্রমাগত বাড়ছে। বাকি ১০টিতেই ইলিশের উৎপাদন কমছে। বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন প্রতি বছর ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। ওয়ার্ল্ড ফিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে উৎপাদিত মোট ইলিশের ৬৫ শতাংশই বাংলাদেশের। বাদ বাকি ১৫ শতাংশ ভারত ও ১০ শতাংশ মিয়ানমার এবং বাকি ১০ শতাংশ আটলান্টিক, প্রশান্ত ও আরব সাগর তীরবর্তী দেশগুলোয় উৎপন্ন হয়। নদী গবেষণা কেন্দ্রের এক তথ্যে জানা গেছে, দেশের ১৫টি জেলায় ৮৫টি উপজেলায় ইলিশ উৎপাদনের ভেতর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব বৃদ্ধির মূল কারণ হচ্ছে জাটকা রক্ষা কর্মসূচী জোরদার করা ও অভয়াশ্রমগুলোয় মা-মাছ আহরণ বন্ধ রাখা। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৩-০৪ অর্থবছরে শতকরা ৯ ভাগ, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ১০ ভাগ, ২০০৮ সালে ৩৮ ভাগ, ২০০৯ সালে ১৭ ভাগ, ২০১০ সালে ৩৩ ভাগ, ২০১১ সালে ৩৬ ভাগ, ২০১২-১৩ সালে ৪৪ ভাগ এবং ২০১৩-১৪ সালে ৫০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। মৎস্য অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, দেশের ১০০টি নদীতে কম-বেশি ইলিশ পাওয়া গেলেও এর প্রজনন ও পরিপক্বতা দক্ষিণাঞ্চলের নদীতেই হয়। দেশে মোট উৎপাদিত জাটকার শতকরা ৬০-৭০ ভাগ দক্ষিণের বিষখালী, পায়রা, আগুনমুখা, বুড়িশ্বর, বলেশ্বর ও কীর্তনখোলা নদী থেকে আহরণ করা হয়। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল ৪ মাসেই মোট জাটকার শতকরা ৪৫-৬৫ ভাগ নিধন হয়। জাটকা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ায় দেশে ফিরছে ইলিশের রাজত্ব।
×