ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা চান খামারিরা

নিবন্ধন, বীমা, নীতিমালা নেই- যেন অভিভাবকহীন খাত ॥ মহাসঙ্কটে পোল্ট্রি শিল্প (শেষ)

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

নিবন্ধন, বীমা, নীতিমালা নেই- যেন অভিভাবকহীন খাত ॥ মহাসঙ্কটে পোল্ট্রি শিল্প (শেষ)

রহিম শেখ ॥ এক দশক আগেও দেশে পোল্ট্রি খামারের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২০ হাজার। বর্তমানে তা নেমে এসেছে প্রায় ৬০ হাজারে। এছাড়াও আছে ব্রিডার ফার্ম, হ্যাচারি ও মুরগির খাবার তৈরির কারখানা। পোল্ট্রি শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে লিঙ্কেজ শিল্প, কাঁচামাল ও ওষুধ প্রস্তুতকারক এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। সবগুলোরই এখন দৈন্যদশা। পরিসংখ্যান বলছে, গত কয়েক বছরে ঝরে পড়েছে প্রায় অর্ধলাখ খামারি। মুরগির বাচ্চার দাম বৃদ্ধি, খাদ্যপণ্য ও ওষুধের দাম বৃদ্ধি, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবহন ব্যবস্থা, অব্যবস্থাপনা, আড়তদারদের হাতে ডিমের বাজার জিম্মি হওয়া ও ব্যাংকঋণের অপ্রতুলতাসহ নানা কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এই শিল্প। একই সঙ্গে দেশের অধিকাংশ মুরগির খামারই চলছে নিবন্ধন ছাড়াই। এসব খামার রয়েছে সরকারের নজরদারির বাইরে। পাশাপাশি পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনকারী অনেক প্রতিষ্ঠানেও নিবন্ধন নেই। পুঁজি হারানো খামারিদের কপালে জোটেনি কোন ‘বীমা’ সুবিধা। দীর্ঘ সময়েও এ খাতের জন্য বাস্তবায়ন হয়নি নীতিমালা। পোল্ট্রি শিল্প যেন অভিভাবকহীন এক খাত। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) হিসাব মতে, দেশের পোল্ট্রি শিল্পে বর্তমানে প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। পরোক্ষভাবে এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল প্রায় ৬০ লাখ মানুষ। ২০৩০ সালে এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল হবে ১ কোটি মানুষ। তথ্য মতে, বর্তমানে সারাদেশে ছোট-বড় খামার রয়েছে প্রায় ৬০ হাজার। আশির দশকে শুরু হওয়া পোল্ট্রি শিল্পের ১৫শ’ কোটি টাকার বিনিয়োগ এখন ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ২০২১ সালে সাধারণ মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে এ খাতে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের প্রতিটি মানুষের সুষম খাদ্য নিশ্চিত করতে পোল্ট্রি শিল্পকে এগিয়ে যেতে হবে আরও বহুদূর। দেশে প্রতিনিয়তই বাড়বে ডিম ও মাংসের চাহিদা। এর ওপর ভর করে সৃষ্টি হবে আরও বড় বাজার। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মুরগির বাচ্চার দাম বৃদ্ধি, খাদ্যপণ্য ও ওষুধের দাম বৃদ্ধি, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবহন ব্যবস্থা, অব্যবস্থাপনা, আড়তদারদের হাতে ডিমের বাজার জিম্মি হওয়া ও ব্যাংকঋণের অপ্রতুলতাসহ নানা কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে এই শিল্প। বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সম্পাদক ও বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ এ্যাসোসিয়েশনের সদস্য খন্দকার মহসিন জনকণ্ঠকে বলেন, বাচ্চার দাম নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই। খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সেদিকে সরকারের নজর নেই। মুরগির বাচ্চার পাশাপাশি খাবারের দামসহ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমাদের খাতটিকে অভিভাবকহীন মনে হয়। ওয়ার্ল্ড’স পোল্ট্রি সায়েন্স এ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখার (ওয়াপসা-বিবি) সভাপতি শামসুল আরেফিন জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের পোল্ট্রি শিল্প বর্তমানে সাম্যাবস্থায় রয়েছে। অনেকটা ভাল ও মন্দের মাঝামাঝি। যতটুকু জোগান দেয়া দরকার আমরা ততটাই দিচ্ছি। এ খাতের পুরো উন্নয়ন হয়েছে বেসরকারীভাবে। তিনি বলেন, কৃষি ক্ষেত্রে ঋণ প্রদান করা হলেও পোল্ট্রি শিল্পের ছোট ছোট খামারিদের জন্য আলাদা করে ঋণ প্রদান করা হচ্ছে না। পোল্ট্রি শিল্পের বিকাশে ৫ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া উচিত। এছাড়া খামারিদের মুরগি বার্ড ফ্লুর মতো রোগে আক্রান্ত হলে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা যেন পথে বসে না যায়, সে লক্ষ্যে পোল্ট্রি বীমা করা এবং কর সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। জানা গেছে, ২০১৯ সাল পর্যন্ত পোল্ট্রি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকার কথা থাকলেও হঠাৎ ২০১৫ সালে এসে তা বন্ধ করে নতুন কর আরোপ করা হয়। কৃষি তথ্য বিশ্লেষক রেজাউল করিম সিদ্দিক বলেন, এটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা। কিন্তু এখানে এখনও কোন বীমা ব্যবস্থা চালু হয়নি। এতে করে বিভিন্ন রোগ বালাইয়ের কারণে কোন ক্ষতি হলে তার ক্ষতিপূরণ পায় না খামারিরা। এতে বাধ্য হয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা খামার ছেড়ে দেন। এমন পরিস্থিতিতে ছোট ছোট খামারিদের স্বার্থ রক্ষায় কৃষির মতো পোল্ট্রি খাতেও স্বল্প সুদে ঋণ ও ‘পোল্ট্রি বীমা’ চালু করার দাবি জানান তিনি। পোল্ট্রি খাতের উন্নয়নে ২০০৮ সালে করা হয়েছিল জাতীয় পোল্ট্রি উন্নয়ন নীতিমালা। যেখানে পোল্ট্রিকে প্রাণিজ কৃষি খাত ঘোষণা করে শস্য খাতের সমান সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে বলা হয়েছিল। কিন্তু কাগুজে নীতিমালাতেই আটকে আছে উন্নয়ন। আর এ ক্ষেত্রে সরকারের উদাসিনতাকেই দায়ী করছে পোল্ট্রি শিল্পের অভিভাবক সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি কেন্দ্রীয় কাউন্সিল। দীর্ঘ সময়েও নীতিমালা বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে নিম্নমানের ওষুধ বাজারে আসা বন্ধ হবে। পাশাপাশি ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহারও কমে আসবে। একই সঙ্গে পোল্ট্রি’র রোগ-বালাই পর্যবেক্ষণে একটি শক্তিশালী মনিটরিং সেল গঠনেরও প্রস্তাব দেন তিনি। জানা গেছে, পোল্ট্রি উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করা হলেও সেখানে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়নি। নীতিমালার ২.২ ধারা বলা হয়েছে ব্যবসার উদ্দেশ্যে ১০০ বা এর বেশি পোল্ট্রি পালন বাণিজ্যিক হিসেবে গণ্য হবে। অথচ বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ১০০ তো নয়ই এমনকি ৩০০ বা ৪০০ মুরগির খামারকেও নিবন্ধনের আওতায় আনা হচ্ছে না। সেখানে বাণিজ্যিক খামারে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়নি। তবে উদ্যোক্তাদের অভিযোগ হচ্ছে এ খাতের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই নীতিমালা করা হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যমান নীতিমালা অনেকাংশে প্রয়োগ হচ্ছে না। পোল্ট্রি ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ এ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ফিআব) সাধারণ সম্পাদক আহসানুজ্জামান বলেন, বর্তমানে নিবন্ধিত ফিড মিলের সংখ্যা ৭৬টি। কিন্তু প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাবে এ সংখ্যা ১৫০টি। যদিও বাস্তবে ফিড মিলের সংখ্যা দু’শতাধিক। অনিবন্ধিত এ ফিড মিলগুলোর কারও কাছেই কোন জবাবদিহিতা নেই! একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিবন্ধনের চিত্রও প্রায় একই রকম। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, টাঙ্গাইলের মধুপুর ও ঘাটাইলে ছোট-বড় মিলিয়ে ৫ হাজারের বেশি পোল্ট্রি খামার রয়েছে। লেয়ার খামার আছে প্রায় ৪ হাজার এবং ব্রয়লার ৮শ’। এ অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার ১৪ ভাগই পোল্ট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এ উপজেলার ১১ হাজার ২৫৭টি পরিবার পোল্ট্রি শিল্পের ওপর নির্ভরশীল হলেও নিবন্ধিত খামারের সংখ্যা মাত্র ৪৮৪টি। মধুপুর উপজেলায় ৩৩২ লেয়ার এবং ২৯৯টি ব্রয়লার খামার আছে। যার মধ্যে নিবন্ধিত হয়েছে মাত্র ৭১ লেয়ার এবং ১৬১টি ব্রয়লার খামার। অর্থাৎ দুই উপজেলার প্রায় সাড়ে ৫ হাজার খামারের মধ্যে নিবন্ধিত হয়েছে মোট ৭১৬টি খামার। টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস সূত্রে জানা যায়, লেয়ার এবং ব্রয়লার মিলে এ উপজেলায় প্রায় ১৫শ’ পোল্ট্রি খামার আছে তবে খামারিরা বলছেন অবৈধ খামারের সংখ্যাও কম নয়। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি মসিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, সব ধরনের বাণিজ্যিক খামার, ব্রিডার ফার্ম, হ্যাচারি, ফিড মিলগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে। নিরাপদ পোল্ট্রি খাদ্য নিশ্চিত করতে এটি খুবই জরুরী। তার মতে, খামারের জীব নিরাপত্তা, বর্জ্য নিষ্কাশন ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ সন্তোষজনক না হলে নিবন্ধন দেয়া উচিত হবে না।
×