ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রাষ্ট্র বিনির্মাণের এক দার্শনিক

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

রাষ্ট্র বিনির্মাণের এক দার্শনিক

১৭ মে ১৯৮১ মানিক মিয়া এ্যাভিনিউতে প্রকৃতির কান্নার মাঝে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সে ভাষণ ছিল বাংলাদেশের নিয়তির অভিসার। সর্বস্ব হারানোর ব্যথা, দৃপ্ত শপথ, ইস্পাত কঠিন মনোবল নিয়ে, যেই রাজনৈতিক দর্শন তিনি অন্তরে লালন করেছেন, তা ছিল বাঙালী জাতি তথা বাঙালীর মুক্তির অভিপ্রায়। ১৯৮১ থেকে ২০১৮, সুদীর্ঘ ৩৭ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। একটি দেশের ইতিহাসে এটা খুবই অল্প সময়। অল্প সময় হলেও প্রাপ্তি এক বিশাল। মানবকল্যাণ সূচক উন্নয়নের দিক থেকে বিবেচনা করলে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেনের ভাষায় এবং গবেষণায় বাংলাদেশ-ভারতসহ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো (ডঐঙ, টঘওঈঊঋ, টঘ এবং টঘউচ, ঋঅঙ) প্রায় সবাই এ উন্নয়নের স্বীকৃতিস্বরূপ অধিৎফ দিতেও কুণ্ঠিত বোধ করেনি। ৩৭ বছরের আন্দোলন, নির্বাচন, বিরোধী দলের আসনে বসা গণতন্ত্রের স্বার্থে জীবনের সব ধরনের ঝুঁকিকে তুচ্ছ জ্ঞান করে সহজভাবে মেনে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু যেমন সামরিক শাসনের অধীনে ’৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে গণতন্ত্রের জনক আব্রাহাম লিঙ্কনকে স্পর্শ করেছিলেন তেমনি একাত্তরের ৭ মার্চের পরে অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে গান্ধীর সমকক্ষ হয়েছিলেন এবং ২৬ মার্চ সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দিয়ে ফিদেল ক্যাস্ট্রো বা চে গুয়েভরাকে অতিক্রম করেছিলেন। সেই যোগ্য পিতার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে নিজেকে গঠন করে চলছেন সেই দুঃখিনী কন্যা শেখ হাসিনা। সরকার পরিচালনার পুরো সাফল্যটাকে আমরা নি¤েœাক্তভাবে তুলে ধরতে পারি : ১. সামরিক শাসনের অবসান ঘটানো, ২. জাতির জনকসহ সব নৃশংস হত্যাকা-ের বিচারের জন্য সোচ্চার হওয়া এবং সর্বশেষ বিচার করা, ৩. জাতির জনকের নেতৃত্বে প্রণীত ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে আসা, ৪. অনগ্রসরতা ও সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণ, ৫. বাধ্যতামূলক ফ্রি শিক্ষা এবং উপবৃত্তি প্রদান, ৬. ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারী সম্পত্তি ভোগ-দখলমুক্ত করা, ৭. নারী শিক্ষাসহ নারী অগ্রগতি এবং লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করা, ৮. খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং খাদ্য রফতানি করে অতীতের সব অপবাদ ঘোচানো, ৯. কৃষি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এবং সময়মতো সার বিতরণ, ১০. প্রতি বছর ১ জানুয়ারি বিনা মূল্যে বই বিতরণ এবং একযোগে সারাদেশে বই উৎসব, ১১. যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করে স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচার নিশ্চিতকরণ এবং রায় বাস্তবায়ন, ১২. মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্ক ভাতা, মাতৃত্বকালীন ছুটি বৃদ্ধি এবং ভাতা ও বেতন অক্ষুণœ রাখা, প্রতিবন্ধী ভাতা ইত্যাদি, ১৩. বিদ্যুত উৎপাদনে অসামান্য অর্জন, ১৪. বিদেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, ১৫. রাস্তাঘাট সেতু ও কালভার্ট নির্মাণ, ১৬. মৎস্য উৎপাদনে বিপ্লব ঘটানো, ১৭. সবজি উৎপাদন ও রফতানিতে তৃতীয় বৃহত্তম দেশ, ১৮. রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন, ১৯. ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, ২০. উন্নয়নশীল দেশে উন্নীতকরণ, ২১. আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে সমুদ্রসীমা জয়, ২২. ভারতের সঙ্গে ছিটমহল বিরোধের স্থায়ী সমাধান, ২৩. সড়ক-মহাসড়ক ও জনপদের ব্যাপক উন্নয়ন, ২৪. রেলপথ উন্নয়ন ও মেট্রোরেল স্থাপন, ২৫. ইতিহাসের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ২৬. সর্বশেষ মহাকাশ জয় অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, ২৭. তৃণমূল পর্যায়ে চিকিৎসা সেবা এবং পরিবার পরিকল্পনার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করা এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে প্রতি ৬০০০ জনের জন্য প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা ও উপদেশ প্রদান, ২৮. ভূমি সংস্কার, ২৯. ধর্মকে রাজনীতির বাইরে তার নিজস্ব পবিত্র আসনে প্রতিষ্ঠা, ৩০. ভিজিডি কার্ডের মাধ্যমে দরিদ্রের খাদ্য সংস্থান, ৩১. পরিবেশ সংরক্ষণের উদ্যোগ ও কাজের অধিকার সুনিশ্চিত করা, ৩২. গড় আয়ু বৃদ্ধি, ৩৩. শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস, ৩৪. ধর্মীয় স্বাধীনতা, ৩৫. অটিজমসহ ¯œায়ুবিক দুর্বলতার স্বীকার শিশুদের ভাতা এবং বিশেষ যতœ এবং বিশেষ সুরক্ষা ট্রাস্ট আইনসহ ৩৬. সর্বশেষ অর্থনৈতিক প্রগতিও সমতা অর্জন এবং কল্যাণকর রাষ্ট্রের মতো বিভিন্ন সেক্টরে ভাতা প্রদান ইত্যাদি অনেক উন্নয়নমূলক কাজ। রাষ্ট্রের এই অগ্রযাত্রা, সার্বিক উন্নয়ন সূচকের উন্নতি, কৃষিতে সমৃদ্ধি ইত্যাদি অনেক কারণেই তিনি আজ জগৎ নন্দিনী। শেখ হাসিনার বর্তমান বাংলাদেশের উন্নয়নের চিত্র, যার তুলনা চলে আলফ্রেড টেনিসনের অনবদ্য বর্ণনার সংঙ্গে : আমি ভবিষ্যতের গভীরে তাকালাম মানব চক্ষু যতদূর দেখতে পায় সারা বিশ্ব উদ্ভাসিত হলো সে অপরূপ সম্ভাবনা, আমাদের সামনে। অপরূপ সম্ভাবনার বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন সোনার বাংলা আজ যে অদম্য গতিতে এগিয়ে চলছে তাতে পুরো বিশ্ব বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্পর্কে নিশ্চিত। বাংলাদেশের বর্তমান সমস্যা রোহিঙ্গা সমস্যা যাকে শরণার্থী সমস্যা বললে ভুল হবে। এটা হলো মানবতা ভূলুণ্ঠিত করে একটা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে তার পিতৃভূমি বা মাতৃভূমি থেকে বিতারিত করা। ইতিহাসের এই বর্বরতা দেখে যখন গোটা বিশ্ব বিস্মিত কিন্তু সত্যিকার প্রতিবাদ হয়নি। মানবতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে শেখ হাসিনাকে বুঝতে কষ্ট হয়নি, এখানে শুধু ধর্মীয় উন্মাদনা হয়নি, আন্তর্জাতিক চক্রান্ত এমন কি জঙ্গী আন্দোলনের যোগসূত্র থাকতে পারে, এমন সব কিছুকে তিনি বিবেচনায় রেখেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখতে ছুটলেন মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে। সঙ্গে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আরেক প্রজ্বলিত আলো শেখ রেহানা। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কষ্ট বুঝতে তাদের বেগ পেতে হয়নি, কারণ তারাও এক প্রকার শরণার্থী হিসেবে ৫ বছর বিদেশে অবস্থান করেছিলেন। ইউরোপের কোন দেশে যদি কয়েক হাজার শরণার্থী উপস্থিত হয়, তা হলে ইউরোপীয় সরকারগুলোর চিৎকারে পুরো বিশ্ব কেঁপে ওঠে। উনার ভাষণের সারমর্ম ‘রোহিঙ্গা সমস্যা নিষ্পত্তিতে ৫ প্রস্তাব, মিয়ানমারে চিরতরে সহিংসতা ও জাতিগত নিধন নিঃশর্তে বন্ধ, অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘ মহাসচিবের অনুসন্ধানী দল প্রেরণ, মিয়ানমারে দ্রুত জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় গড়ে তোলা। রাখাইন থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ নিজ বাড়িঘরে প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা। ‘আনান কমিশনে’র সুপারিশমালার দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মতো তিনি ও ‘শান্তি ও ন্যায়’ বিচারের পক্ষে তার অঙ্গীকারের কথা বলে গেছেন। মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মানবতাবাদী, একজন মা হিসেবে সদ্য বার্মিজ তথাকথিত বৌদ্ধ কর্তৃক, রোহিঙ্গা মুসলমান নিধনকে এবং বিতারণকে যেভাবে গ্রহণ করেছেন তা বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়েছে। যেখানে ভূমধ্য সাগর পাড়ি দিয়ে কয়েক হাজার উদ্বাস্তু ইউরোপের দেশে আশ্রয় নিলে তাদের চিৎকারে বিশ্ব কম্পমান, সেক্ষেত্রে আট লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে তিনি বিশ্বের দরবারে নিজেকে, বাংলাদেশকে এবং বাঙালী জাতিকে এক সুউচ্চ সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি যখন বললেন, আমরা আধা পেট খেয়ে হলেও শরণার্থীদের খেতে দেব। এই কথাটি আমাকে ছোট বেলায় শেখা একটি কোটেশন মনে করিয়ে দেয় ‘ডরষষরধস জঁপশবষ ংযধংি এর ‘ঘধঃঁৎব চৎড়ারফবং ধ ভৎবব ষঁহপয ড়হষু রভ বি পড়হঃৎড়ষ ড়ঁৎ ধঢ়ঢ়বঃরঃবং’ আজ তিনি পৃথিবীতে স্বীয় মাতৃত্ব, সহমর্মিতা, মানুষের প্রতি ভালবাসা এবং তার নির্লোভ গুণাবলীর জন্য মানবতার জননী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা, বাংলার মানসকন্যা, বঙ্গ সমাজের কুলবধূ, বাংলার অহঙ্কার, মানবতার জননী, রাজনীতির দার্শনিক শেখ হাসিনাকে যেন দীর্ঘায়ু দান করেন। বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের ক্ষুধা ও নিরক্ষতার অবসান ঘটানোর শক্তি দান করেন। শুভ জন্মদিন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। লেখক : সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×