ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধিকাংশ থ্যালাসেমিয়া রোগী চূড়ান্ত চিকিৎসা না পেয়েই মারা যায়

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

অধিকাংশ থ্যালাসেমিয়া রোগী চূড়ান্ত চিকিৎসা না পেয়েই মারা যায়

নিখিল মানখিন ॥ দুরারোগ্য ব্যাধি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত আট বছরের শিশু শিমুল। সাড়ে তিন বছর থেকেই সে এ রোগে ভুগছে। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে তাকে চিকিৎসা করানো হয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে বোনম্যারো প্রতিস্থাপন করাতে ভারতের মাদ্রাজে নিয়ে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। এজন্য প্রয়োজন ৩৫ থেকে ৪৫ লাখ টাকার। শিশুটির বাবা ইউনূস একজন গরিব কৃষক। তার পক্ষে এই ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সন্তানের এমন অবস্থায় সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েছেন ইউনূস। শুধু শিশু শিমুল নয়, হাজার হাজার থ্যালাসেমিয়ার রোগী ব্যয়বহুল চিকিৎসা করাতে না পেরে ধীরে ধীরে নিশ্চিত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে থ্যালাসেমিয়া রোগীর চিকিৎসা ব্যয় কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশে সীমিত পরিসরে থ্যালাসেমিয়া রোগের চূড়ান্ত চিকিৎসা ‘বোনম্যারো প্রতিস্থাপন’ চলছে। এ পর্যন্ত প্রায় পঁয়ত্রিশ জনের বোনম্যারো প্রতিস্থাপন হয়েছে। বোনম্যারো প্রতিস্থাপন চালু হলেও তা দেশের রোগীদের তুলনায় একেবারে অপ্রতুল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের জানান, বোনম্যারো প্রতিস্থাপন অত্যন্ত ব্যয়বহুল চিকিৎসা। বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে আরেকটি মাইলফলক স্থাপিত হলো। ঢাকা মেডিক্যালের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ইউনিটে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন সফল সম্পন্ন করা হয়েছে। এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে দেশের অনেক রোগী উপকৃত হবে। ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হবে না। বাংলাদেশের চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, নার্স, মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টদের যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বিষয়ক প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সূত্র জানায়, এ্যালোজেনিক পদ্ধতিতে বোনম্যারো প্রতিস্থাপন চালুর পরিকল্পনা করছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। এ পদ্ধতিতে কোন স্বজন কিংবা দাতার (ডোনার) শরীর থেকে সেল নিয়ে প্রতিস্থাপন করা হবে। বর্তমানে অটোলোগাস পদ্ধতিতে নিজেদের শরীর থেকে কোষ নিয়ে এ চিকিৎসা করা হয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, এ্যালোজেনিক পদ্ধতি চালু হলে আরও অনেক রোগী এ চিকিৎসা সুবিধা নেয়ার সুযোগ পাবেন। বোনম্যারো (অস্থিমজ্জা) প্রতিস্থাপনে আশার আলো দেখছে বাংলাদেশ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) শুরু হওয়ার পর ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালেও (সিএমএইচ) কয়েক ক্যান্সার রোগীকে বোনম্যারো প্রতিস্থাপন করা হয়। ঢাকা মেডিক্যালের রক্তরোগবিদ্যা (হেমাটোলজি) বিভাগের প্রধান ও হাসপাতালে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন ইউনিটের প্রধান এম এ খান জানান, ঢাকা মেডিক্যালে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ইউনিটের মাধ্যমে ব্লাড ক্যান্সার, লিউকিমিয়া, থ্যালাসেমিয়া, লিম্ফোমা, সিভিয়ার এ্যাপ্লাস্টি এ্যানিমিয়াসহ জটিল রোগের চিকিৎসা সম্ভব হবে। সফলভাবে কর্মসূচীটি চালু রাখা গেলে রোগীরা অল্প খরচে উন্নতমানের চিকিৎসা পাবেন। তাদের আর অন্য কোথাও যেতে হবে না। ব্যয়বহুল হওয়ায় দেশের অনেক রোগী অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ছাড়াই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ঢাকা মেডিক্যালে স্থাপিত বোনম্যারো প্রতিস্থাপন ইউনিটের মাধ্যমে বর্তমানে সীমিত সংখ্যক রোগীকে সেবা দেয়া সম্ভব বলে জানান অধ্যাপক এম এ খান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করছে, দেশে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। এ রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখ। বংশগত এই রোগ নিয়ে প্রতি বছর দেশে সাত হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে। থ্যালাসেমিয়ার বাহকদের মধ্যে বিয়ে হলে এ রোগের বিস্তার ঘটে। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তশূন্যতা দেখা দেয়, পেটের প্লিহা বড় হয়ে যায়, তাকে ফ্যাকাশে দেখায়। থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের মহাসচিব আবদুর রহিম বলেন, দেশে রক্তশূন্যতাজনিত রোগ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এ রোগের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। কোন পরিবারে কেউ থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা করাতে সে পরিবারটি অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে যায়। তাই বিয়ের আগে ছেলেমেয়ের রক্ত পরীক্ষা, আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে বিয়ে না করা এবং ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমেই এর প্রতিরোধ সম্ভব। তিনি আরও বলেন, থ্যালাসেমিয়া বাহকদের বিয়ে হলে এ রোগের বিস্তার ঘটে। তাছাড়া জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সচেতনতার অভাব, অপ্রতুল চিকিৎসাব্যবস্থা এবং রোগ প্রতিরোধে বাস্তবমুখী কার্যক্রমের অভাবে থ্যালাসেমিয়া দেশের স্বাস্থ্যসেবার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। তিনি বলেন, থ্যালাসেমিয়া কোন সংক্রামক রোগ নয়। আক্রান্ত শিশুদের প্রতি দুই থেকে চার সপ্তাহ পর পর নতুন রক্ত গ্রহণ করে বেঁচে থাকতে হয়। সঠিক ও নিয়মিত চিকিৎসা পেলে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। তবে থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক ও থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগী দুটি এক জিনিস নয়। থ্যালাসেমিয়ার বাহকরা এ রোগে আক্রান্ত নন। থ্যালাসেমিয়ার দুই বাহকের মধ্যে বিয়ে হলে কিংবা তাদের মধ্যে মিলনের ফলে জন্ম নেয়া সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। থ্যালাসেমিয়া রোগীর বাহ্যিক কোন লক্ষণ নেই। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তশূন্যতা দেখা দেবে, পেটের প্লিহা বড় হয়ে যাবে, তাকে ফ্যাকাশে দেখাবে। এই রোগের চিকিৎসা হচ্ছে যতদিন বাঁচবে, ততদিন নিয়মিত নতুন রক্ত গ্রহণ করতে হবে কিংবা বোনম্যারো প্রতিস্থাপন করতে হবে। তাই সবারই উচিত, রক্তে থ্যালাসেমিয়া আছে কি না, তা পরীক্ষা করা। রোগ প্রতিরোধে থ্যালাসেমিয়া বাহকদের পারস্পরিক বিয়ে বন্ধ করা দরকার।
×