ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিপদের কাণ্ডারি মাহমুদুল্লাহ

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বিপদের কাণ্ডারি মাহমুদুল্লাহ

ক্যারিয়ারের গোড়ার দিক থেকেই তিনি এমন। কিন্তু ফলাফল বিবেচনায় দলের পারফর্মেন্স সুবিধাজনক না হওয়াতেই হয়ত এতটা বেশি নজরে আসেননি তিনি। তবে গত কয়েক বছরে নিজেকে চিনিয়েছেন ৩২ বছর বয়সী মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। অধিকাংশ সময় ৬ কিংবা ৭ নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে বিপদের মুখে মানব ঢাল হয়ে প্রতিপক্ষ বোলারদের মোকাবেলা করেছেন এবং দলকে বড় বিপর্যয় থেকে টেনে তুলেছেন অনেকবার। যার শেষ প্রদর্শনী তিনি দেখালেন এবার আরব আমিরাতে চলমান এশিয়া কাপে সুপার ফোরের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে। এবারও যখন ৭ নম্বরে নামলেন তখন ৮৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ নিজেদের ডু-অর-ডাই ম্যাচে। খেললেন ৮১ বলে ৩ চার, ২ ছক্কায় ৭৪ রানের ইনিংস। আবার প্রয়োজনের সময় বল হাতেও প্রতিপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ উইকেট শিকার করে ম্যাচসেরা হয়েছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের এই বিপদের ত্রাণকর্তা। ২০০৭ সালে অভিষেক ম্যাচেই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৭ নম্বরে নেমে ৩৬ রানের ইনিংস খেলেছিলেন কলম্বোয়। তবে সেবার দলকে জেতাতে না পারার আক্ষেপ সঙ্গী হয়েছিল আগেভাগে আউট হয়ে যাওয়ার কারণে। কিন্তু এই পজিশনে তিনি যে কিছু করে দেখাতে পারবেন তার নমুনা দেখিয়েছিলেন। দুই বছর লেগেছিল বিজয়ী বীর হয়ে মাঠ ছাড়তে। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সেন্ট কিটসের উইন্ডসর পার্ক! সে মাঠে মাহমুদুল্লাহ প্রথমবারের মতো ম্যাচজয়ী পারফর্মার হিসেবে মাঠ ছাড়েন। ২৪৯ রানের জয়ের লক্ষ্যে নেমে বাংলাদেশ দলের হার দেখা যাচ্ছিল ১৩৩ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলায়। ১৮৩ রানের মাথায় ব্যাটিং স্তম্ভ মুশফিকুর রহীমও বিদায় নেন। কিন্তু মাহমুদুল্লাহ ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় অর্ধশতক হাঁকিয়ে অপরাজিত থাকলেন, দলকে করলেন বিজয়ী। সেদিন তার ৭০ বলে ২ চার, ১ ছক্কায় করা ৫১ রানে ৩ উইকেটের জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ দল। প্রথমবার ম্যাচসেরাও হন তিনি। এরপর থেকেই মাহমুদুল্লাহ বাংলাদেশ দলের বিপর্যয়ের ত্রাণকর্তা হিসেবে নাম কামাতে শুরু করেন। নিজের ভিন্ন রূপটাও দেখিয়েছেন পরের বছর। ২০১০ সালের ৭ জানুয়ারি মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে বিধ্বংসী রূপে আবির্ভূত হন তিনি। ৪৫ বলে ৮ চারে ৬০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে দলকে বড় সংগ্রহ এনে দিয়েছিলেন। বিপদের মুখে মাথা ঠা-া রেখে ধীরস্থির ব্যাটিংয়ে দলের ইনিংসের রং ফিরিয়ে আনা এবং ভাল সময়ে ঝড়ো ব্যাটিংয়ে দলের অবস্থান সুদৃঢ় করা- এ দুটি ভূমিকাতেই মাহমুদুল্লাহকে অনেকবার দেখা গেছে। ত্রিদেশীয় সেই আসরের আরেক ম্যাচে চারদিন পরই একই প্রতিপক্ষ ভারতের বিরুদ্ধে ৯৫ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে বিপদগ্রস্ত বাংলাদেশকে বাঁচান ৮০ বলে ৫ চার, ১ ছক্কায় ৬৪ রানের একটি অপরাজিত ইনিংস খেলে। মাঝে অনেকটা সময় এরপর নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছিলেন মাহমুদুল্লাহ। তাই তীব্র সমালোচনার মুখে থাকা মাহমুদুল্লাহর ব্যাটিং পজিশনে পরিবর্তন এনে ২০১১ সালের ১৩ এপ্রিল মিরপুরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নামানো হয়েছিল ৪ নম্বরে। লক্ষ্য অনেক বড় থাকায় (৩৬২) দলকে জেতাতে না পারলেও প্রথমবার ওপরের দিকে ব্যাটিংয়ে নেমে সেদিন ৬১ বলে ৫ চার, ২ ছক্কায় ৬৮ রানের অপরাজিত একটি ইনিংস উপহার দিয়েছিলেন। সে বছরই ২১ আগস্ট বুলাওয়েতে ৭ নম্বরে নেমে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ১২৭ রানে ৫ উইকেট হারানো দলকে তিনি ভাল অবস্থানে নিয়ে যান ৬৭ বলে ৫ চার, ১ ছক্কায় ৬০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলে। সেই ম্যাচে ৯৩ রানের জয় পায় বাংলাদেশ দল। এমন অসংখ্য ইনিংস রয়েছে মাহমুদুল্লাহর। তবে বিশ্বব্যাপী তিনি আলোচনায় এসেছেন ক্যারিয়ারের সেরা তিনটি ইনিংস খেলে। ২০১৫ বিশ্বকাপে পর পর দুই ম্যাচে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে রেকর্ড গড়েন। এডিলেডে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৯ মার্চ ৪ নম্বরে নেমে ১৩৮ বলে ৭ চার, ২ ছক্কায় ১০৩ রানের একটি পরিণত ইনিংস উপহার দিয়ে সবার নজর কাড়েন। ক্যারিয়ারের প্রথম সেই সেঞ্চুরি বিফলে যায়নি, বাংলাদেশ ১৫ রানের জয় তুলে নিয়েছিল। একই পজিশনে পরের ম্যাচে ১৩ মার্চ হ্যামিল্টনে নেমে তার ১২৩ বলে ১২ চার, ৩ ছক্কায় করা ১২৮ রানের অপরাজিত ইনিংস অবশ্য নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জেতাতে পারেনি দলকে। কিন্তু এই পজিশনেও তিনি দলের জন্য উজ্জ্বল ভূমিকা দেখাতে সক্ষম সেটার প্রমাণ দেন পরবর্তীতে আরও ৪টি অর্ধশতক (৫০, ৫২, ৬২ ও ৭৫) হাঁকিয়ে। ক্যারিয়ারের আরেকটি স্মরণীয় ইনিংস খেলেন গত বছর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে। ৩৩ রানে ৪ উইকেট হারানোর পরও দলকেব অবিশ্বাস্য ও অবিস্মরণীয় এক জয় এনে দেন ৬ নম্বরে নেমে ১০৭ বলে ৮ চার ও ২ ছক্কায় অপরাজিত ১০২ রানের ইনিংস উপহার দিয়ে। ম্যাচটি ৯ জুন কার্ডিফে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর চলতি বছর জানুয়ারিতে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে মিরপুরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৫ নম্বরে নেমে ৭৬ রান অবশ্য অন্যদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশকে জেতাতে পারেনি। কিন্তু সেন্ট কিটসে গত ২৮ জুলাই তার ৪৯ বলে ৫ চার, ৩ ছক্কায় করা ৬৭ রানের হার না মানা বিস্ফোরক ইনিংসটি দলকে ১৮ রানের জয় এনে দিয়েছিল। এটি বাংলাদেশ দলকে ২-১ ব্যবধানে সিরিজে বিজয়ী করে। যে কোন পজিশনে, যে কোন পরিস্থিতিতে যে কোনভাবে ব্যাটিং করার সামর্থ্যটা বার বারই প্রমাণ করেছেন মাহমুদুল্লাহ। তবে বরাবরই দলের ত্রাণকর্তা হিসেবে তিনি পরিচিতি পেয়েছেন বেশি। কারণ, সে ভূমিকায় তাকে অনেকবার দেখা গেছে। তবে এবার আরব আমিরাতের মাটিতে গত তিন ম্যাচে চিরাচরিত মাহমুদুল্লাহকে দেখা যাচ্ছিল না। আগের তিন ম্যাচে তিনি ৬ নম্বরে নেমে ১, ২৭ ও ২৫ রান করতে পেরেছিলেন। দলও যেন এক অন্ধকার গহ্বরে পতিত হয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে একেবারে চরম চাপের ম্যাচেই গর্জে উঠলেন মাহমুদুল্লাহ, আরেকবার তাকে দেখা গেল ত্রাণকর্তার ভূমিকায়। আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটি জেতার প্রয়োজন ছিল মর্যাদা রক্ষা এবং ফাইনালে ওঠার আশা জিইয়ে রাখার জন্য। সে ম্যাচেও বেহাল অবস্থায় পড়ে যায় বাংলাদেশ দল। মাত্র ৮৭ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে চরম দুর্দশাগ্রস্ত দলকে বাঁচাতে তিনি ৭ নম্বরে ব্যাটিং করতে নামেন। এবার সঙ্গী হিসেবে অভিজ্ঞ টপঅর্ডার ইমরুল কায়েসকে পেয়ে যান যিনি প্রথমবারের মতো নেমেছিলেন ৬ নম্বরে। এই পরিস্থিতিতে দেখেশুনে খেলে তিনি ক্যারিয়ারের ২০তম অর্ধশতক আদায় করে নেন এবং সাড়ে ৩ হাজার ওয়ানডে রান পেরিয়ে যান। দলের চরম বিপ দূর করেন। ষষ্ঠ উইকেটে ইমরুলের সঙ্গে ১২৮ রানের জুটি গড়ে দলকে চ্যালেঞ্জিং একটি সংগ্রহ পাইয়ে দেন। ভেঙ্গে ফেলেন দেশের ষষ্ঠ উইকেট জুটির রেকর্ড। আল শাহরিয়ার রোকন ও খালেদ মাসুদ পাইলট ১৯৯৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ১২৩ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটির রেকর্ড গড়েছিলেন ষষ্ঠ উইকেটে। সেটিকে ভেঙ্গে দেন মাহমুদুল্লাহ-ইমরুল জুটি। দল যখন ২১৫ রানে থাকে, তখনই ৮১ বলে ৩ চার ও ২ ছক্কায় ৭৪ রান করে আউট হন মাহমুদুল্লাহ। কিন্তু দল তখন বিপদ কাটিয়ে ভাল একটি অবস্থানে পৌঁছে গেছে। আর আরেকবার নিজের ত্রাণকর্তা পরিচয়টাকে তুলে ধরেছেন মাহমুদুল্লাহ।
×