ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাংক ঋণের সুদহার যাচাইয়ে নেমেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ব্যাংক ঋণের সুদহার যাচাইয়ে নেমেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

রহিম শেখ ॥ ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার ৬ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনলেও ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনেনি। এ অবস্থায় দেশের কার্যরত সরকারী-বেসরকারী ব্যাংকগুলো ঘোষিত সুদহার মানছে কি-না তা যাচাইয়ে পরিদর্শনে নেমেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বেসরকারী খাতের প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। একই সঙ্গে আমানতে কী পরিমাণ সুদ দিচ্ছে তাও যাচাই করা হচ্ছে। কোন ক্ষেত্রে ঋণের তুলনায় আমানতে বেশি সুদ ঘোষিত থাকলে ওই ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছে তার কারণ জানতে চাওয়া হচ্ছে। সার্বিক বিষয় তুলে ধরে শীঘ্র গবর্নরের কাছে এ বিষয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে। সে আলোকে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমানো ছাড়া ঋণের সুদহার কমানো সম্ভব হবে না। কেননা, কম সুদে আমানত মিলছে না। পরিচালন ব্যয়ও রাতারাতি কমানো সম্ভব হবে না। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবিরের নির্দেশনার আলোকে প্রাথমিকভাবে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোতে পরিদর্শন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পরিদর্শক দলের মূল লক্ষ্য ঋণে ব্যাংকগুলো সিঙ্গেল ডিজিট সুদ কার্যকর করছে কি-না তা যাচাই করা। আবার এক রকম ঘোষণা দিয়ে আরেক রকম সুদ নিচ্ছে কি-না তাও দেখা হচ্ছে। এ জন্য শাখা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলছে পরিদর্শক দল। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ক্রেডিট কমিটিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। একই সঙ্গে আমানতে কী পরিমাণ সুদ দিচ্ছে তাও যাচাই করা হচ্ছে। কোন ক্ষেত্রে ঋণের তুলনায় আমানতে বেশি সুদ ঘোষিত থাকলে ওই ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাছে তার কারণ জানতে চাওয়া হচ্ছে। সার্বিক বিষয় তুলে ধরে শীঘ্র গবর্নরের কাছে এ বিষয়ে প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হবে। সে আলোকে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরিদর্শন-সংশ্লিষ্ট কয়েক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ ব্যাংক এখনও সব ক্ষেত্রে সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ বিতরণ শুরু করেনি। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, সিঙ্গেল ডিজিট সুদের ঘোষণা হঠাৎ করে আসায় তা কার্যকরে সময় লাগছে। কেননা মাঝে দুই অঙ্ক সুদে ৬ মাস, ৯ মাস, এক বছর বা এ রকম বিভিন্ন মেয়াদের আমানত নিয়েছে অনেক ব্যাংক। এসব আমানতের মেয়াদপূর্তি না হওয়ায় প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো এখনই সুদহার কমাতে পারছে না। তবে ইসলামী ব্যাংকগুলোর মুনাফার বিষয়টি বাজারভিত্তিক হওয়ায় রাতারাতি এসব ব্যাংকের কমাতে কোন বাধা নেই। এসব কারণে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো কিছুটা সময় নিয়ে এক অঙ্ক সুদে ঋণ বিতরণ কার্যকর করতে চাইছে। তা না করলে লোকসানের আশঙ্কা রয়েছে। গত ২০ জুন ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবির এক বৈঠকে ১ জুলাই থেকে সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ বিতরণের ঘোষণা দেয়া হয়। পরে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিরা আলাদাভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানান, অধিকাংশ ব্যাংক গত জুলাই থেকে উৎপাদনশীল খাতে এক অঙ্ক সুদে ঋণ বিতরণ শুরু করেছে। তবে বাস্তবে অধিকাংশ ব্যাংক তা কার্যকর না করায় পরে গত ২ আগস্ট অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গবর্নরসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সব ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিদের নিয়ে এক বৈঠক হয়। সেখানেও জানানো হয়, অধিকাংশ ব্যাংক উৎপাদনশীল খাতে সুদহার এক অঙ্কে নামিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত জুলাই শেষে আমানতের গড় সুদহার নেমেছে সাড়ে ৫ শতাংশে। কিন্তু ঋণের গড় সুদহার প্রায় দশ শতাংশ (৯ দশমিক ৭১ ভাগ)। এর মধ্যে ৩২টি ব্যাংকের ঋণের গড় সুদহার ১১ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত রয়েছে। বিপরীতে ২৫টি ব্যাংকের আমানতের গড় সুদহার ১ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ। অন্য প্রায় সব ব্যাংকের আমানতের গড় সুদহার ৬ শতাংশের নিচে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার ৬ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনলেও ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনেনি। এদিকে ঋণের সুদহার না কমালেও প্রতিটি ব্যাংকই আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। মতিঝিল পাড়ায় ঘুরে দেখা যায়, সব ব্যাংকই আমানতের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে এনেছে। কিন্তু ঋণের সুদহারের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে কয়েকটি ব্যাংক জানিয়েছে ঋণের সুদহার কমানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ বিষয়ে একটি ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, বিএবির এ ঘোষণায় ব্যাংকগুলো বরং লাভবান হয়েছে। কারণ গত কয়েক বছর ধরে যেসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, বিশেষ করে বড় বড় শিল্পগ্রুপ ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করছে না। ফলে প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণ বেড়ে গেছে। যে পরিমাণ খেলাপী ঋণ দেখাচ্ছে প্রকৃতপক্ষে বেশিরভাগ ব্যাংকের তার চেয়ে বেশি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংকের যথাযথভাবে পরিদর্শন করলে এ চিত্র বের হয়ে আসবে। খেলাপী ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোর তহবিলের বড় একটি অংশ গ্রাহকদের কাছে আটকা পড়ে গেছে। এতে ব্যাংকগুলোর বেশি হার প্রভিশন সংরক্ষণ করতে গিয়ে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি এবং অন্যান্য কারণে ব্যাংকিং খাতে কিছুটা আস্থাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বেশিরভাগ ব্যাংকেরই তারল্য সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এ তারল্য সঙ্কটের কারণে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছিল। গত ৬ মাস ধরে ব্যাংকিং খাতের এ পরিস্থিতিতে অনেকেই প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে আমানত সংগ্রহ করতে গিয়ে আমানতের সুদহার কোন কোন ক্ষেত্রে ১১ শতাংশে উঠে গিয়েছিল। এতে বেড়ে যায় অস্থিরতা। এ পরিস্থিতিতে বিএবি ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে এবং তিন মাস মেয়াদী আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয়। এ সুযোগে সব ব্যাংকই একযোগে আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। কিন্তু ঋণের সুদহার এখনও সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনা হয়নি। চতুর্থ প্রজন্মের একটি ব্যাংকের উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, ঋণের সুদহার অবশ্যই কমানো হবে। তবে তা রাতারাতি সম্ভব হবে না। কারণ, তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমানোর জন্য ব্যাংকগুলোকে সময় দিতে হবে। ইতোমধ্যে স্বল্প সুদে কিছু আমানত পাওয়া যাচ্ছে। অন্য পরিচালন ব্যয় কমানোর চেষ্ট চলছে। যেমনÑ বেতন-ভাতা, বাড়ি ভাড়া, ইউটিলিটি বিল ইত্যাদি খাতে ব্যয় কমানোর চেষ্টাও করা হচ্ছে। নতুন লোকবল না নিয়ে বিদ্যমান লোকবল দিয়ে নতুন শাখায় কাজ করা হচ্ছে। এভাবে পরিচালন ব্যয় কমিয়ে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি মনে করেন, এভাবে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কমিয়ে ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে কয়েক মাস সময় লেগে যেতে পারে। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্যাংকের এমডি জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, বিএবির এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা ব্যাংকগুলোর জন্য মোটেও সম্ভব হবে না। কারণ বিএবির সিদ্ধান্ত মোতাবেক বেশির ভাগ ব্যাংক আমানতের সুদহার কমালেও অনেক আমানতের সুদহার কমানোর ফলে এখন কাক্সিক্ষত হারে আমানত আসছে না। অনেক গ্রাহক বেশি মুনাফার আশায় ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিয়ে জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন। এটাই ব্যাংকগুলোর কাছে সবচেয়ে বড় শঙ্কার বিষয়। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনে বিনিয়োগ করার মতো তহবিলই তাদের হাতে থাকবে না।
×