ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

॥ পর্ব- সাত ॥ প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সেক্টর কমান্ডারগণ, তাদের পরিচালনাধীন সেক্টরে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সামরিক কর্মকর্তা, সৈনিক, তৎকালীন ইপিআর, পুলিশ ও সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা। স্বল্পতম অস্ত্রশস্ত্র, গোলাগুলি ও অন্যান্য যুদ্ধসামগ্রী নিয়ে তারা পাকিস্তানের মতো অন্যতম একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যে সামরিক নৈপুণ্য ও বীরত্ব প্রদর্শন করে ক্রমাগতভাবে দেশের ভেতরে বিভিন্ন অঞ্চলকে হানাদার বাহিনীমুক্ত করেছিলেন, সে সব বীরত্বগাথার অনেক ইতিহাস কিন্তু এখনও সঠিকভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে কি-না সে বিষয়ে অনেকের সন্দেহ রয়েছে। তবে মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে আমরা যারা সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতাম তাদের কিন্তু বিষয়টি স্মরণে ছিল সব সময়। আমার সহপাঠী ও বন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপসচিব হিসেবে কর্মরত আকবর আলি খানের পরামর্শে এবং প্রতিরক্ষা সচিবের সম্মতি নিয়ে জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে অনুষ্ঠিত সেক্টর কমান্ডারদের সভায় উপস্থিত বেশ কয়েক সেক্টর কমান্ডারের সঙ্গে আমরা আমাদের পরিচালিত সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ে আলাপ আলোচনা করি এবং তাদের শলাপরামর্শ গ্রহণ করি বিশেষ করে আরও কিভাবে তাদের স্ব-স্ব সেক্টরের অধীনে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালিত হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের সহযোগীদের বাঙালীদের নিধন করার ও অত্যাচার-অবিচার পরিচালনার অভিযান প্রতিহত করার বীরত্ব কাহিনী বিশ্ববাসীকে অবহিত করা যায় সে বিষয়ে। তাই সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে আলোচনার পূর্বেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক তৎকালীন কর্নেল ওসমানী এবং উপপ্রধান তৎকালীন গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকারের সঙ্গেও আলাপ করি এ বিষয়ে। উল্লেখ্য, গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারের টেবিলে বসেই প্রতিরক্ষা সচিবসহ আমরা সবাই অফিস করতাম এবং আমাদের কারও আলাদা কোন বসার টেবিল-চেয়ার ছিল না। সেক্টর কমান্ডারদের দু’দিনব্যাপী সভা চলাকালীন সময়ে আমরা যাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার সুযোগ পেয়েছিলাম তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ, তৎকালীন উইং কমান্ডার খাদেমুল বাসার, মেজর এম মনজুর, মেজর সিআর দত্ত এবং মেজর কাজী নুরুজ্জামান। মেজর কে এম শফিউল্লাহ আমাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য সময় দিতে পারেননি। তবে সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে তাদের স্ব-স্ব সেক্টরের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তৎপরতা ও অপারেশন বিষয়ে কথা বলার জন্য সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানীর অনুমতি আমরা পূর্বেই নিয়েছিলাম। কর্নেল এমএজি ওসমানী কর্নেল ওসমানীর (কর্নেল এমএজি ওসমানী) সঙ্গে কথা বলার জন্য তার তৎকালীন এডিসি ক্যাপ্টেন নূরের (বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী) সঙ্গে আলাপ করে সময় নিয়েছিলাম। তিনি আমাদের এক ঘণ্টা সময় দিয়েছিলেন। আমার সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন আমার একজন সহকর্মী কবি আল মাহমুদ। সম্ভবত কর্নেল ওসমানী কবিতা খুব পছন্দ করতেন। কারণ, তিনি কবি আল মাহমুদের সঙ্গে আলাপ করতে পেরে খুব খুশি হয়েছিলেন। তিনি আমাদের দু’বার চা খাইয়েছিলেন। একবার সাধারণ আপ্যায়ন এবং পরেরবার কবি আল মাহমুদের সম্মানে। তিনি কবি আল মাহমুদকে তার সঙ্গে সময় করে আবারও একবার দেখা করার জন্য আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন। তিনি প্রথমেই সেক্টর কমান্ডারদের সবার খুব প্রশংসা করে বললেন যে, তারা সবাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসার ছিলেন এবং সবারই খুব দক্ষ ও যোগ্য অফিসার হিসেবে সুনাম ছিল। তিনি আলাদাভাবে উইং কমান্ডার এম কে বাসারের নাম উল্লেখ করে আমাদের জানালেন যে উইং কমান্ডার বাসার পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অন্যতম একজন বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং উচ্চতর পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য মনোনীত অফিসার ও পদাতিক বাহিনীর কমান্ডার হিসেবেও তিনি তার যোগ্যতা ও পারদর্শিতা প্রদর্শনে সমধিক কৃতিত্ব দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। যেহেতু আমরা সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ে আলাপ করার জন্য তার সাক্ষাতকার চেয়েছিলাম। তাই আমাদের সাক্ষাতের পূর্বেই তিনি এ বিষয়ে কিছু হোমওয়ার্কও করেছিলেন এবং তিনি নিজ হাতে লিখে কয়েকটা পয়েন্টের একটা কাগজও আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। তার দেয়া পরামর্শের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল যে, আমাদের বিভিন্ন সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের প্রতিহত করার বীরত্বগাথা এবং শিশু ও মহিলা হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের কাহিনী যতটা ব্যাপকভাবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী, বিবিসি ও অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ করা হবে, মুক্তিযোদ্ধারা তত বেশি অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ হবে এবং বিদেশী সাহায্য ও সমর্থন আমাদের জন্য আরও বেশি ব্যাপক হবে। তিনি অবশ্য মুজিবনগর সরকারের দৈনন্দিন কর্মতৎপরতা এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক অর্থাৎ তার নিজের অফিসের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ বিষয়ে গণমাধ্যমকে অবহিত করার পরামর্শও দিলেন আমাদের। তার তৎকালীন জনসংযোগ কর্মকর্তা সাংবাদিক নজরুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন এই সাক্ষাতকার গ্রহণের সময়। গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকারের সঙ্গে যখন পূর্ব নির্ধারিত সাক্ষাতকার অনুষ্ঠিত হয় তার অফিসে, তখন প্রতিরক্ষা সচিব সামাদ সাহেবও সৌভাগ্যক্রমে উপস্থিত ছিলেন সেখানে। চলবে...
×