ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চলতি বছরে ডিম উৎপাদন কমে গেছে ২৫ থেকে ৩০ লাখ ;###;লোকসান কাটাতে ব্যাংক ঋণের সুদে রেয়াত চান খামারিরা

ডিম বিক্রিতেও সিন্ডিকেট ॥ মহাসঙ্কটে পোল্ট্রি শিল্প ২

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ডিম বিক্রিতেও সিন্ডিকেট ॥ মহাসঙ্কটে পোল্ট্রি শিল্প ২

রহিম শেখ ॥ খামারিরা ডিম উৎপাদন করে যা মুনাফা করছেন তার চেয়ে বেশি মুনাফা তুলছেন মধ্যস্বত্বভোগীরা। প্রতি ডিমে দুই টাকা পর্যন্ত লাভ করছেন খুচরা বিক্রেতা ও আড়তদাররা, যেখানে খামারিদের লাভ হচ্ছে সর্বোচ্চ ৫০ পয়সা থেকে এক টাকা। কিন্তু কিছুদিন আগেও এই মুনাফার ছিটেফোঁটাও তুলতে পারেননি প্রান্তিক খামারিরা। ফলে অনেক খামারি ডিম উৎপাদন থেকে সরে এসেছেন। এই অবস্থায় চলতি বছরের শুরুর তুলনায় মাঝামাঝিতে এসে ডিমের উৎপাদন কমে গেছে অন্তত ২৫-৩০ লাখ। খামারিদের দাবি, এই মুহূর্তে একদিনের বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারি মালিকদের সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। তা না পারলে এই লোকসান ঠেকানো সম্ভব নয়। কমাতে হবে মুরগির খাবার ও ওষুধের দাম। লোকসান ঠেকাতে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ চান খামারিরা। বাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিন্ডিকেট করে খুচরা বিক্রেতাদের বেশি মুনাফা করার প্রবণতার কারণে ভোক্তাকে বাড়তি দাম দিয়ে ডিম কিনতে হচ্ছে। খামারি ও আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে প্রতিটি ডিম উৎপাদনে খামারিদের খরচ হচ্ছে সাড়ে পাঁচ থেকে সাড়ে ছয় টাকা পর্যন্ত। খামারিরা প্রতিটি ডিম বিক্রি করছেন সাত টাকা পর্যন্ত দামে। আড়তদাররা পাইকারি বিক্রি করছেন সর্বোচ্চ সাড়ে সাত টাকায়। খুচরা বাজারে প্রতি হালি বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৩৮ টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি ডিমের দাম পড়ছে সাড়ে ৯ টাকা। মিরপুর ৬ নম্বর বাজারের মুদি দোকানি ইব্রাহিম মোল্লা বলেন, ডিমের বাজার চড়া। যে কারণে বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, আড়তদাররা বাড়তি দামে ডিম বিক্রি করলে আমাদেরও বাড়তি দামে বিক্রি করতে হয়। তবে তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মোঃ হানিফ মিয়া বলেন, খুচরা বাজারে বেশি দামে বিক্রি হলে আমাদের কী করার আছে? এর জন্য মনিটর করতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ বছরের শুরুর দিকে উৎপাদন খরচ কমাতে না পারায় এবং লাভ না হওয়ার কারণে অনেকেই ডিমের উৎপাদন থেকে সরে এসেছেন। তেমনি একজন মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের খামারি আবদুল কুদ্দুস। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ২০১০ সালে ৫০০ লেয়ার মুরগি দিয়ে খামার চালু করেছিলেন। এরপর ডিম বিক্রি করে ভাল লাভ পাওয়ায় খামার বড় করে ধীরে ধীরে তিনি ৩ হাজার মুরগি তোলেন। তিনি জানান, এক বছর ধরে তিনি ক্ষতির মুখে পড়েছেন। একদিকে মুরগির খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের ডিম উৎপাদনের খরচও বেড়ে গেছে। কিন্তু বাজারে ডিমের দাম কম থাকায় তিনি ক্ষতির মুখে পড়েন। আবদুল কুদ্দুস বলেন, আগে প্রতি বস্তা মুরগির খাবারের দাম ছিল ১ হাজার ৪০০ টাকা, বর্তমানে হয়েছে ১ হাজার ৭০০ টাকা। আমার খামারে প্রতিদিন গড়ে চার বস্তা খাদ্যের প্রয়োজন হয়। ক্ষতির কারণে আমি খামার থেকে দুই হাজার মুরগি বিক্রি করে দিয়েছি। এখন খামারে এক হাজার মুরগি আছে। ধীরে ধীরে আমি খামার বন্ধ করে দেয়ার চিন্তা করছি। গাজীপুরের খামারি মাসুদুর রহমান রুমান জনকণ্ঠকে বলেন, গত চার বছর ডিম বিক্রি করে মোটামুটি ভালই চলছিল। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে মুরগির খাবারের দাম বস্তাপ্রতি ৪০০-৫০০ টাকা বেড়ে যায়। এতে উৎপাদন খরচ বাড়লেও ডিমের দাম বাড়েনি। তিনি বলেন, বিভিন্ন কোম্পানি সিন্ডিকেট করে মুরগির খাদ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু ডিম বিক্রি করে আমাদের লাভ হয় না। তিনি বলেন, আমরা যদি সরাসরি ঢাকায় ডিম বিক্রি করতে পারতাম তাহলে অনেক লাভ হতো। আমি নিজেও সেই চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারিনি। ঢাকার কাওরান বাজারের কোন ব্যবসায়ী আমাদের কাছ থেকে সরাসরি ডিম কিনতে আগ্রহী নন। তাই বাধ্য হয়েই স্থানীয় আড়তদারদের মাধ্যমেই ডিম বিক্রি করতে হচ্ছে। জেলার অপর খামারি আশরাফ হোসেন বলেন, বছরের শুরুর দিকে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে, কখনও কখনও খরচের সমান দামে ডিম বিক্রি করতে হয়েছে। তিনি বলেন, এক শ্রেণীর মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীর কারণে আমরা ডিম বিক্রিতে প্রকৃত মুনাফা পাই না। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) এক হিসাব বলছে, চলতি বছরের শুরুর তুলনায় মাঝামাঝিতে এসে ডিমের উৎপাদন কমে গেছে অন্তত ২৫-৩০ লাখ। আগে যেখানে প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি ৮০ লাখ ডিম উৎপাদন হতো এখন সেটা প্রায় দুই কোটি ৫০ লাখের আশপাশে নেমে এসেছে। উৎপাদন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিম ও মুরগির দাম আরও কমিয়ে আনা যেত, যদি খাদ্যের দাম কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। জানা গেছে, খামারে ব্রয়লার মুরগির খাদ্য উপাদানের মধ্যে অন্যতম সয়াবিন মিল। চাহিদার একটা অংশ পাওয়া যায় অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে। পুরো চাহিদা মেটাতে দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা হয় বড় একটা অংশ। গত তিন বছরে দেশী সয়াবিন মিলের দাম বেড়েছে ৩১.২৫ শতাংশ। আমদানি করা সয়াবিন মিলের দাম বেড়েছে ৪৩.২৪ শতাংশ। মুরগির খাদ্য উপাদানের মধ্যে আরও রয়েছে ভুট্টা, রাইস পলিস, রাইস ব্র্যান অয়েল, সয়াবিন অয়েল, মিট এ্যান্ড বোনমিল বা প্রসেস প্রোটিন ও ফুল ফ্যাট সয়া। গত তিন বছরের বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিটি খাদ্য উপাদানের দামই উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০১৬ সালে ভুট্টা কিনতে খামারিদের খরচ করতে হয়েছে প্রতি কেজি ১৮ টাকা। চলতি বছরে প্রতি কেজি ভুট্টা কিনতে হচ্ছে ২০ টাকা ৫০ পয়সায়। একইভাবে দেশী সয়াবিন মিল ৩২ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০-৪২ টাকা এবং আমদানি করা সয়াবিন মিল ৩৭-৩৮ টাকা থেকে তিন বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩ টাকায়। এ ছাড়া রাইস পলিস ১৯ টাকা থেকে বেড়ে ২২ টাকা, রাইস ব্র্যান অয়েল ৭০ টাকা থেকে বেড়ে ৮৫ টাকা, সয়াবিন অয়েল ৮২ থেকে বেড়ে ৮৮ টাকা, মিট এ্যান্ড বোনমিল বা প্রসেস প্রোটিন ৩৫ টাকা থেকে বেড়ে ৫৫-৫৮ টাকা এবং ফুল ফ্যাট সয়া ৪০-৪২ টাকা থেকে বেড়ে ৪৬-৪৮ টাকা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরাা জানান, ব্রয়লার মুরগির খাদ্য উপাদানের অর্ধেক স্থানীয় উৎস এবং বাকি অর্ধেক আমদানি করে চাহিদা পূরণ করা হয়। স্থানীয়ভাবে যেসব পণ্য পাওয়া যায় সেগুলোর দাম খুব একটা ওঠানামা করে না। আমদানি করে আনা পণ্যগুলোর দরদাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে ওঠানামা করে। তবে সেখানেও রয়েছে সিন্ডিকেট। আন্তর্জাতিক বাজারে যদি কোন পণ্যের দাম ২ শতাংশ বাড়ে, তবে দেশীয় বাজারে সেটার দাম বাড়ানো হয় ২০ শতাংশ। এর প্রধান কারণ আমদানিকারকের সংখ্যা হাতে গোনা। তারা যেভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সেভাবেই চলে। বিপিআইসিসি ও ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ এ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (এফআইএবি) সভাপতি মশিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, মুরগির খাবারের বাজারে সিন্ডিকেটের কারণে খামারিরা উৎপাদন খরচ কমাতে পারে না। গত ১০ বছরে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে সেভাবে ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়েনি। অন্যদিকে ডিমের ক্ষেত্রে খামারিরা কম দামে বিক্রি করলেও সেটার সুফল যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ জনকণ্ঠকে বলেন, বিষয়টি সরকারের নজরে এসেছে। খামারিরা যেন লোকসানের মুখে না পড়েন, সে বিষয়ে সরকার সচেতন রয়েছে। পরিস্থিতি এমন থাকবে না। শীঘ্রই এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলেও আশ্বস্ত করেন তিনি।
×