ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ফখরুলদের ওপর আস্থা নেই খালেদা তারেকের

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

ফখরুলদের ওপর আস্থা নেই খালেদা তারেকের

বিভাষ বাড়ৈ ॥ বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চান না সরকারবিরোধী জোটের নেতৃত্বে আসুক বিএনপির কোন শীর্ষ নেতা! তাই আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ড. কামাল হোসেন ও ডাঃ বি চৌধুরীর ওপর নির্ভর করেই আওয়ামী লীগবিরোধী জোটকে এগিয়ে নিতে চায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। দলের নেতৃত্ব চিরদিনের জন্য হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ড. কামাল হোসেন ও ডাঃ একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর হাতেই আন্দোলনের নেতৃত্ব রাখতে চান খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। পরিস্থিতি বিব্রতকর হলেও বিএনপির শীর্ষ নেতারা ওপরের নির্দেশ মেনে ধর্ণা দিচ্ছেন ড. কামাল ও বি চৌধুরীর ঘরে। দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল কেন তৃণমূলের আপত্তি উপেক্ষা করে হলেও নামসর্বস্ব কয়েকটি দলের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে? রাজনৈতিক মহলে এমন প্রশ্ন চাউর হলেও বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি নেতারা কেবল চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশ মেনে কাজ করছেন। তারা দুজনই চান বিএনপির কেউ হবেন না সরকারবিরোধী জোট জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় শীর্ষ নেতা। দলের শীর্ষ নেতাদের নেতৃত্বে সরকারবিরোধী আন্দোলন করে নির্বাচনে গেলে দলের নেতৃত্বও চিরদিনের জন্য হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। দলের শীর্ষ নেতাদের কাউকেই তারা বিশ^াস করতে পারছেন না বলেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি বলে ধারণা করছেন নেতারা। তবে জেলখানায় বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা করে বিএনপি নেতারা আদেশ অনুসারে কাজ করার ওয়াদা দিলেও বলেছেন, ড. কামাল ও বি চৌধুরীর নেতৃত্বে নির্বাচন করে ১৫১ টি আসন নিশ্চিত করতে পারলে কিছুদিনের মধ্যেই তাদের দুজনকে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দেবেন। এছাড়া আরও বেশ কিছু পরিকল্পনার কথাও তুলে ধরেছেন নেতারা। গত শনিবার রাজধানীতে সমাবেশেই স্বাধীনতাবিরোধী, উগ্রবাদী দল ও সংগঠন একাকার হয়ে গেছে। যেখানে এক এগারোর কুশীলবদের নিয়ে সক্রিয় হয়েছে বিএনপিও। তথ্য মিলছে বিএনপি-ড. কামালের ৭ দফা গোপন চুক্তিরও। এক অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে কি ‘বড় কিছু’ পাওয়ার আশায় ড. কামাল স্বাধীনতাবিরোধী দল ও এক এগারোর কুশীলবদের নিয়ে সক্রিয় হয়েছেন? দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল হয়ে বিএনপিই কেন হঠাৎ নামসর্বস্ব কয়েকটি ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র দলের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ডাঃ একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং ড. কামাল হোসেনের ওপর নির্ভর করেই আওয়ামী লীগবিরোধী জোটকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে বিএনপি। বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া জেলে রয়েছেন এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়ে দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে লন্ডনে রয়েছেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আশঙ্কায় আছেন তারেক রহমান। এতদিন দলের সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর এবং স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের মতো প্রবীণ নেতাদের ওপর নির্ভর করে বিএনপি এগিয়ে চলেছে। কিন্তু বেগম জিয়া এবং তার পুত্র চান না বিএনপির হয়ে ‘আওয়ামী লীগবিরোধী’ জোটকে নেতৃত্ব দিক ফখরুল অথবা মওদুদ। কারণ, তাদের এই মুহূর্তে সরকারবিরোধী জোটের নেতা হিসেবে তুলে ধরার অর্থ প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবেও তাদেরকে সামনে রেখে নির্বাচনে লড়া। তাই বেগম জিয়া ও তারেক রহমান চাচ্ছেন দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডাঃ একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং প্রাক্তন মন্ত্রী ড. কামাল হোসেনই এই জোটের নেতৃত্ব দিন। সূত্রগুলো বলছে, বেগম জিয়ার রণকৌশল হচ্ছে, যদি বি চৌধুরী কিংবা ড. কামাল হোসেন জোটের নেতৃত্ব দেন তাহলে আওয়ামী সরকার ক্ষমতা থেকে চলে গেলে এদের মধ্যে থেকে একজন প্রধানমন্ত্রী হবেন। তারপর তারা খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলাগুলো খারিজের ব্যবস্থা করবেন। এরপর বেগম জিয়া এবং তারেক নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে প্রবেশ করবেন। তখন বি চৌধুরী বা ড. কামাল হোসেনকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত করা হবে। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীত্বের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন এবং তারেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্বে আসবেন। মা খালেদা জিয়া অসুস্থ তাই তারেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলেও দেশের শাসনভার তার ওপরই থাকবে বলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দলটি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির শীর্ষস্থানীয় এক নেতা বলছিলেন, জিয়া পরিবারের কেউ বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকে এখন খুব একটা বিশ্বাস করেন না। কারণ তাদের অনেককেই গোপনে বর্তমান শাসক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন বলে মনে করছেন। শাসক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রাখার অভিযোগে মওদুদ আহমেদকে তারেক রহমান তীব্র ভর্ৎসনা করেছেন এমন খবরও এসেছে গণমাধ্যমে। এ অবস্থায় জিয়া পরিবার মনে করছে, বিএনপির কোন শীর্ষ নেতাকে সরকারবিরোধী জোটের নেতৃত্বে না রাখার বিষয়ে তারেক রহমান দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কারণ, কোন কারণে যদি ওই নেতার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়, তাহলে তাকে প্রধানমন্ত্রী না করাটা সত্যিই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এমন পরিস্থিতিতেই গেল সপ্তাহে বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাসা বারিধারায় যেতে বাধ্য করা হয় বিএনপি নেতাদের। শনিবারের জাতীয় ঐক্যর সমাবেশের আগে দলীয় সমর্থনের কথা তাকে তারা জানিয়ে আসেন। বিএনপির অনেক নেতা এমনকি তাদের পরামর্শক বুদ্ধিজীবীরাও মনে করছেন, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান নির্বাচন করতে না পারলে দলের নেতৃত্ব চিরদিনের জন্য হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। দলের শীর্ষ নেতাদের নেতৃত্বে সরকারবিরোধী আন্দোলন করে নির্বাচনে গেলে দলের নেতৃত্বও সেই নেতাদের হাতে চলে যাবে বলে মনে করছেন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। তবে বিএনপির বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী মনে করেন, ঐক্যের ভবিষ্যত পরিষ্কার না হলেও এটি বিএনপির জন্য কিছুটা হলেও সুবিধাজনক অবস্থা তৈরি করতে পারে। ঐক্যজোটের যারা নেতা আছেন, তারা জনগণের কাছে খুব পরিচিত। কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে তারা কতটুকু ভোটার টানতে পারবেন তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবে এ রাজনৈতিক ঐক্য হলে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি ‘পায়ের তলায় মাটি পাবে’ বলে উল্লেখ করেন দিলারা চৌধুরী। তার ধারণা একদিকে মাঠ পর্যায়ে বিএনপির সমর্থন এবং নেতা-কর্মী আছে, অন্যদিকে ড. কামাল হোসেন এবং বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পরিচিতি আছে। এ দুটো বিষয় একত্রিত হলে বিএনপির জন্য রাজনৈতিক সুবিধা হবে বলেই মনে করেন দিলারা চৌধুরী। এদিকে বিএনপি নেতারা খালেদা জিয়ার কাছে বার্তা পাঠিয়েছেন তারা শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশ অনুসারেই কাজ করবেন। তবে ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথাও তারা খালেদা জিয়াকে জানিয়েছেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনা কি? জানা গেছে, খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বিএনপির অনেক নেতাই একমত হয়েছেন ড. কামাল ও বি চৌধুরীর নেতৃত্বে নির্বাচন করে সরকার গঠনের মতো ১৫১ টি আসন নিশ্চিত করতে পারলে কিছুদিনের মধ্যেই তাদের দুজনকে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দেবেন। প্রয়োজনে ড. কামালের হাতে দুবছর ক্ষমতা। ঐক্যের নেতৃত্বের হাত ধরেই নির্বাচনের পথে যাবে বিএনপি। সরকার গঠন হলে সরকারের প্রধানও হতে পারেন ড. কামাল হোসেন। মাহমুদুর রহমান মান্নার প্রস্তাব অনুযায়ী অন্তত প্রথম দুবছরের সরকার পরিচালনার ভার বৃহত্তর জোটের নেতাদের হাতেই থাকবে। এই পরিকল্পনা নিয়েই তারা এগোতে চান। খালেদা জিয়ার ও বিএনপি নেতারা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একমত বলে জানা গেছে। তবে পরিকল্পনা যাই হোক, জানা গেছে আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি কার নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করবে? নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং সরকার পতনের আন্দোলনের দিক নির্দেশনা কে দেবেন? খালেদা জিয়া কারাগারে- তারেক রহমান বাইরে এ পরিস্থিতিতে সরকার গঠন হলে নেতৃত্বের চাবি কার হাতে থাকবে? এ নিয়ে উভয় সঙ্কটে এখন বিএনপি। দলের কিছু শীর্ষ নেতা মনে করছেন, রাজনীতিতে ‘শেষকথা’ বলতে কিছু নেই। একটি অংশ খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে না যাওয়ারও পক্ষে। অপর একটি অংশ ড. কামাল ও বি চৌধুরীর সঙ্গে না যাওয়ার পক্ষে।
×