ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল লতিফ সিদ্দিকী

বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে গোয়েন্দা প্রতিবেদন ॥ এক বৈষম্যহীন মানবপ্রেমের দলিল

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে গোয়েন্দা প্রতিবেদন ॥ এক বৈষম্যহীন মানবপ্রেমের দলিল

(শেষাংশ) যে উচ্চকণ্ঠ পাকিস্তানের ২৩ বছরে নীরব হয়নি অর্থাৎ শাসকশ্রেণীর শ্রেণীচরিত্র ও মনোভাব পাল্টায়নি। আজও মানুষ সরকারী অফিসের দরজায় হোঁচট খায়, ভেতর থেকে অবজ্ঞার আঘাতে দিশেহারা হয়ে জনপথে ঘুরে মরে। মুজিবকে ইতিহাসের ছকে ফেলে ভাংলে সব স্বচ্ছভাবে বেরিয়ে আসবে। ১৯৫৫ সালে মুজিব অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির সূচনা করেন দলের মাথা থেকে মুসলিম শব্দটি ছেঁটে ফেলে, শুধু কি তাই? ওই বছরের ২৫ আগস্ট গণপরিষদে কী বলেন তা একবার দেখে নেয়া যাক- ÒSir, you will see that they want to place the words ÔEast PakistanÕ instead of ÔEast BengalÕ. We have demanded so many times that you should make it Bengal (Pakistan). The word “Bengal” has a history, has a tradition of its own. You can change it only after the people have been consulted. If you want to change it then we will have to go back to Bengal and ask them whether they accept it. So far as the question of one-Unit is concerned it can come in the Constitution. Why do you want it to take up just now? What about the State Language, Bengali? What about joint electorate? What about autonomy? The people of east Bengal will be prepared to consider one-Unit with all these things. So I appeal to my friends on that side to allow the people to give their verdict in any way, in the form of referendum or in the form of plebiscite. Let the people of Frontier say that they want one-Unit. At the moment they say that they are against it...All right, if they are in favour let a referendum be held and let the people decide themselves and we will accept it. As far as Karachi is concerned, there should be no referendum in Karachi because it is the Federal Capital...We have no right to take Karachi from the people of Karachi and from the people of East Pakistan. It belongs to us also as it belongs to other parts of Pakistan. We have spent so much money for its development. Why do you want to make another capital and spend hundreds and thousands of rupees and for which you will require at least 50 years. For these reasons, I appeal to my friends ÔZulum mat karo BhaiÕ (Do not be so cruel). If you will force it upon us then we have to adopt unconstitutional means. You must proceed constitutionally. If you do not allow the people to follow constitutional ‘means, ‘they will perforce’ adopt unconstitutional means. That is what has happened all over the world and it can be seen from the history of world. So I appeal to them: if you love Pakistan; though unfortunately after the achievement of Pakistan, you are at the helm of affairs and those people who fought for its establishment are no more with us. So, I will appeal to you, although you have got force at your disposal, that for the sake of Pakistan, for the sake of democracy, for the sake of humanity, for the sake of Quaid-e-Azam, go to the people, let the people give their verdict and we will accept it.” ২৫ আগস্টে মুজিবের গণপরিষদ বক্তৃতাটি মনোযোগ দিয়ে পাঠ ও বিশ্লেষণ করলে নতুন কিছু খোঁজার প্রয়োজন পড়ে না। সংক্ষেপে কিন্তু মূল বিষয়টি স্পষ্টতই বলেছেন। পূর্ববঙ্গকে পূর্ব পাকিস্তান করার তীব্র প্রতিবাদ করে ‘বাংলা’ নাম রাখার দাবি উত্থাপন করেছেন। যুক্তি হিসেবে বলেছেন, জনগণের মতামত ছাড়া গণতান্ত্রিক দেশে কোন কিছু করা যায় না। গণরায়ের জন্য গণভোটের দাবি তুলেছেন। মুজিব পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের চার প্রদেশকে এক ইউনিটে পরিণত করার তীব্র বিরোধিতা করেছেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলার জোরালো দাবি করেছেন। যুক্ত নির্বাচন যে গণতন্ত্রের প্রধান শর্ত তা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। রাজধানী করাচীর উন্নয়নে অতিরিক্ত খরচের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে পূর্ববঙ্গকে বঞ্চনার কথাটি জোরালোভাবে পরিষদে তুলে ধরেছেন। তিনি ‘জুলুম মাত কর ভাই’ বলে দৃঢ়তার সঙ্গে চমৎকারভাবে অসাংবিধানিক অত্যাচার বন্ধ করতে পরামর্শ দিয়েছেন। সর্বশেষ তাঁর চরিত্র-বৈশিষ্ট্যানুযায়ী বলেছেন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে নিপীড়িতরা রুখে দাঁড়াবে। পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে শক্তি আছে বলেই শক্তি প্রয়োগ শুভ ফল দেবে না। সর্বশেষ, পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির খাতিরে, গণতন্ত্র রক্ষার খাতিরে, মানবতার খাতিরে, এমনকি কায়েদ-এ-আজমের খাতিরে পূর্ব বাংলায় শোষণ-বঞ্চনা-নির্যাতন বন্ধ করতে মুজিব হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। আমরা যদি এই ভাষণের আলোকে ৬ দফা- বাঙালীর মুক্তিসনদ, ’৭০-এর নির্বাচন, আর ৭ মার্চের মহাকাব্যিক ভাষণকে মিলিয়ে পাঠ করি তখন কি আর কোন দ্বিধা-সংশয় থাকে যে, মুজিবই বাঙালীর মর্মমূল থেকে উৎসারিত রাষ্ট্রপিতা? ইসলামের ইতিহাসে মদিনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর রাষ্ট্রের রাজধানী মক্কায় ঘোষণা করা হয়নি। কেউ প্রশ্ন তুলবেন, মক্কা তখন কুরাইশদের অধীন ছিল। কুরাইশমুক্ত মক্কাও ইসলামী রাষ্ট্রের রাজধানী কখনও হয়নি, যদিও পবিত্র কাবাঘর মক্কাতেই অবস্থিত। প্রতিবছরই হজব্রত পালন করতে নবী মুহম্মদ (স.) মক্কায় গিয়েছেন। যে ভাষাটিতে কোরান নাজিল হয় এবং ইসলাম প্রচার হয় সে ভাষাটি কুরাইশ এবং বিধর্মীদের হলেও তাকে বাতিল করে নতুন ভাষার আবাদ নবী মুহম্মদ (স.) করেননি। ভাষা বিতর্কটি নতুন নয়। ১৯৩৭ সাল থেকেই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যুবেরী মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে রাষ্ট্রভাষা কী হবে সে ব্যাপারে উর্দুর পক্ষে জোর প্রচারণা চালালেও মুসলিম লীগ নেতৃত্ব ভাষা প্রশ্নে কোন মতামত দিয়েছেন বলে ইতিহাসের কোন তলানিতে খুঁজে পাওয়া যায় না। পাকিস্তান কেন, ভারতও এই ভাষা সমস্যায় বিপন্ন হয় এবং এখনও আছে। ভারতবর্ষ নানা ভাষাভাষীর দেশ। ভারতবর্ষের যে অংশ নিয়ে পাকিস্তান সেই অংশেও বহুভাষী জনগোষ্ঠীর বাস। জাত্যাভিমানের কারণে একভাষী অন্যভাষীর ভাষার আনুগত্য মানতে চায় না। রাজতান্ত্রিক পৃথিবীতে রাজার রাজত্বে রাজভাষাই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পরিগণিত হতো। প্রজাপুঞ্জ রাজাদেশ পালনে বাধ্য হতো। গণতন্ত্রে এমনটি হওয়ার সুযোগ খুবই কম। সুযোগ থাকলে অধিকার হরণ কেউ মেনে নিতে চায় না। পাকিস্তানের এই অধিকার হরণ দুঃস্বপ্নের মধ্যে নিপতিত হয়। দুর্ভাগ্যক্রমে পাকিস্তান রাষ্ট্র পরিচালনে যারা ব্যাপৃত হয়, হয় তারা উর্দুভাষী, নয় তারা উর্দু ভাষায় পারঙ্গম ছিলেন। শুধু তাই নয়, তারা ইংরেজীতে স্বপ্ন দেখতেন, কল্পনার জাল বুনতেন, ইংরেজী ভাষাতেই কার্যনির্বাহ করতেন। পরিকল্পিত অভিসন্ধি থেকেই তারা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে উদ্যোগী হন। বাংলাভাষী পূর্ববঙ্গ অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ, শিক্ষাক্ষেত্রে ভীষণভাবে পিছিয়ে পড়া পূর্ববঙ্গ, পূর্ববঙ্গের জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রভাষা উর্দুর ঘোষণায় বিস্মিতই শুধু হয়নি, একই সঙ্গে আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে পড়ে। কৃষক প্রজা আন্দোলন ও মুসলিম লীগ আন্দোলনে সামান্য যে কয়জন উঠতি মধ্যবিত্ত সবেমাত্র মাথা উঁচু করতে চেষ্টা করছিল তারা কেউ শের-ই বাংলার অনুগামী, কেউ শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর অনুসারী। সবাই প্রমাদ গুনে। এই প্রেক্ষাপটই শেখ মুজিবের ঢাকায় আগমন ও তৎপরতার সূচনা। কথার আগে কথা আছে। শেখ মুজিবুর রহমান ’৪৮-এর আগে ঢাকার সঙ্গে খুব একটা পরিচিত ছিলেন না। ঢাকা বলব কেন, পূর্ববঙ্গের সঙ্গেই পরিচিত ছিলেন না। বৃহত্তর ফরিদপুরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ থাকলেও কলকাতাই ছিল তাঁর কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্র। ভারত বিভক্ত হলে সিলেট জেলা পূর্ববঙ্গে যুক্ত হবে না অসমের সঙ্গে থাকবে এই সিদ্ধান্তে জনমতের দ্বারস্থ হয় ব্রিটিশ রাজ। এই সিলেট নিয়ে গণভোটে শেখ মুজিব প্রথম পূর্ববঙ্গে তাঁর তৎপরতা শুরু করেন। এই দলিলের কোথাও সিলেটে শেখ মুজিবের সেই তারুণ্যদীপ্ত তাৎপর্যপূর্ণ কর্মতৎপরতার কোন ইঙ্গিতের খবর নেই। থাকতেও পারে না। ঘটনাটি ঘটে ১৯৪৭-এর ৬ ও ৭ জুলাই। দলিলটার শুরুই ’৪৮-এ। ইতিহাস যতটুকু সাক্ষ্য দেয়, সিলেট যে আজকে বাংলাদেশের অংশ তার অন্যতম নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর উদ্যোগী ও উদ্যমী ব্যক্তিত্বে আকৃষ্ট হয়ে হাজার হাজার মুসলিম তরুণ সেদিন পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিতে গণমানুষকে উদ্বুুদ্ধ করে। এই তরুণদের অন্যতম ছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। তিনি তাঁর স্মৃতিচারণে বারবার বঙ্গবন্ধুর সংগঠন প্রতিভার প্রখরতা ও নিরলস পরিশ্রমের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতেন। ওই গণভোটেই টাঙ্গাইলের আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা তোফাজ্জল হোসেন মুকুল, শামসুর রহমান খান শাহজাহান ও বদিউজ্জামান খান মুজিব অনুরক্ত হন। সেদিনের ওই প্রতিবেদন ঢাকায় পাওয়া সম্ভব নয়, সেটা কলকাতার ‘নবান্নে’ (রাইটার্স বিল্ডিংয়ে) পাওয়া সম্ভব। পুনরায় রাষ্ট্রভাষার কথায় ফিরতে হয়। রাষ্ট্রভাষা সমস্যার অভিঘাতে পাকিস্তান দুলে ওঠে এবং হেলে পড়ে। এর মধ্যে কেউ কেউ ষড়যন্ত্র খোঁজেন, আমি খুঁজি অভিসন্ধি, বাঙালীকে বশীভূত রাখার অভিসন্ধি। কিছুটা অনভিজ্ঞতা, কিছুটা দাম্ভিকতা, কিছুটা শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক গরিমা থেকে পাকিস্তানী রাষ্ট্রনায়করা ওই কুকীর্তিটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত হলেও মুসলিম লীগ নেতৃত্ব কখনই সাধারণ জনগোষ্ঠীর সুখ-দুঃখের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। সাধারণ মানুষের ছোট ছোট সুখ-দুঃখের অভিব্যক্তি সম্পর্কে উঁচুবর্গের এই নেতাদের কোন ধারণাই ছিল না। নায়েব-গোমস্তারা যা বলত তাই তারা জানত। তারা নায়েব-গোমস্তাদের যা আদেশ দিত তাই পালিত হতো। ভারতও প্রথমত হিন্দীকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চালু করতে তৎপর হয়, কিন্তু দক্ষিণ ভারতের জনগোষ্ঠীর তীব্র প্রতিবাদের মুখে তারা শান্তিপূর্ণভাবে সম্মানের সঙ্গে পিছু হঠে ইংরেজীকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। মজার বিষয়, ঔপনিবেশিক শাসকের ভাষা স্বাধীন ভারতে মেনে নেয়া যায়, জ্ঞাতিগোষ্ঠীর ভাষা স্বীকার করা কোনমতেই সম্ভব নয়। পাকিস্তানও এই পন্থাটি সহজেই অবলম্বন করতে এবং সংঘাত এড়িয়ে যেতে পারত। পাকিস্তানী শাসকরা বুঝতে পারেনি উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে বাঙালী উঠতি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মূর্খে পরিণত হবে। কিন্তু পাকিস্তানী নব্য শাসকগোষ্ঠী আত্মাভিমানে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পূর্ববঙ্গের বাংলাভাষীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ দাঁড় করানোর হীন মনোবৃত্তির প্রকাশ ঘটায়। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব যারা করেছিলেন তারা কিন্তু উর্দুকে বাতিল করেননি। তারা বলেছিলেন উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। জেদ পরিত্যাগ করে সরলভাবে ভাবলে প্রস্তাবটি যে যুক্তিসঙ্গত তা যে কেউ মানবেন। এখানেই আসে রাষ্ট্র দর্শনের প্রশ্নটিÑ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দর্শনের কথা। পাকিস্তান কোন রাজ্য নয়, একটি রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। এই জনগণ ধনবান না ধনহীন, শিক্ষিত না অশিক্ষিত, শক্তিমান না দুর্বল, খানজাদা-নওয়াবজাদা-সৈয়দজাদা না হারামজাদা তা বিচারের কোনই সুযোগ নেই। সকল নাগরিকের অধিকার সমান। এই সমান অধিকার যে-ই অস্বীকার করবে সে-ই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দর্শনের সড়ক থেকে পিছলে পড়বে। তাই দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়করা জনতন্ত্রী ছিলেন না, ধর্মানুরাগী যে ছিলেনই না সেটা তো তাদের ব্যক্তিগত আচার-আচরণেই প্রতীয়মান। যত নষ্টের গোড়া রিপাবলিক (জবঢ়ঁনষরপ) শব্দটি। এই শব্দটির অর্থ এবং প্রয়োগ অনুভব ও অনুধাবনে যত জটিলতা। প্রজাতন্ত্র, গণরাজ্য, গণরাষ্ট্র, সাধারণতন্ত্র যে কোনভাবেই অনুবাদ করা যায়, সকলভাবেই বোঝাবে ড়ভ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, ভড়ৎ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব, নু ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব. কোনমতেই ঔপনিবেশিক বা সাম্রাজ্যবাদী রাজতান্ত্রিক ‘প্রজা’ (ঝঁনলবপঃ) বোঝাবে না। সহজেই অনুমেয় পাকিস্তান গণরাজ্য না হয়ে, গণরাষ্ট্র না হয়ে, সাধারণতন্ত্র না হয়ে অভিজাততন্ত্রের কবলে নিপতিত হয়। এক সময় এই অভিজাততন্ত্র সেনাপতিতন্ত্রের ক্রীড়নকে পর্যবসিত হয়। পাকিস্তানের প্রথম যুগে অভিজাত ভূস্বামী, বিশাল ব্যবসায়ী, ছিন্নমূল মোহাজের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিজেদের স্বার্থরক্ষায় সেনাপতিদের সাহায্য নিত। এখন সেনাপতিতন্ত্র ইমরান খানদের প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে পাকিস্তানকে কুক্ষিগত করে রেখেছে। যে উর্দুকে নিয়ে এত হাঙ্গামা-হুজ্জত, সে উর্দু না ইসলামী ভাষা, না পাকিস্তানের কোন অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর ভাষা। মুসলমান শক্তি ভারত দখল করলে স্থানীয় ও আঞ্চলিক বহুভাষী সৈনিকবৃত্তির কারণে একই ব্যারাকে বাস করতে থাকে। তাদের নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করতে গিয়ে যে ভাষাটির উদ্ভব সেই খিচুড়ি ভাষাই উর্দু। আসলে উর্দু ভাষাটির উৎপত্তির ইতিহাস এমনই। যদিও পরবর্তী সময় অনেক শক্তিশালী লেখক ও কবির আবির্ভাবের ফলে ভাষাটি বেশ সমৃদ্ধ হয় এবং এখনও ভারতের সাড়ে নয় কোটি লোক উর্দুভাষী। আসলে আমরা শেখ মুজিব এবং তাঁর সম্পর্কে পাকিস্তানের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা করছি। এই আলোচনায় শেখ মুজিবের কর্মক্ষেত্র এবং কর্মকাল উঠে আসবে। শেখ মুজিব এমন একটি চরিত্র যার সম্পর্কে বলতে গেলে গণবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে, জনস্বার্থের অনুকূলে সর্বক্ষেত্রেই শেখ মুজিব সগৌরবে দীপ্যমান। এই ডকুমেন্টটি সে কথাই বারবার বলছে। বাংলাদেশের আরও খ্যাতিমান ও দীপ্র রাজনীতিকদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিলে দেখতে পাওয়া যাবে তাদের ব্যাপারেও তথ্য কম নয়। যদিও শেখ মুজিবের সঙ্গে তা তুলনীয় নয়। টীকা-টিপ্পনি কেটে, তথ্য-উপাত্ত তালাশ করে শেখ মুজিবের কীর্তিগাথা প্রচারের কোন কার্যকারণ নেই। কারণ কোনভাবেই এক লেখায় বা এক বইয়ে বা ১৫ খণ্ডে সরকারী দলিল-নথিতে পুরো মুজিবকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। মুজিবের জীবন যেমন বৈচিত্র্যপূর্ণ তেমনি বহুমাত্রিকতায় ভাস্বর। মুজিবের জীবনবৈচিত্র্য ও বহুমাত্রিকতা শুধু জ্ঞান-তথ্য ও দালিলিক নথি দ্বারা গড়া সম্ভব নয়। মুজিবকে ভাংতেই যদি না পারা গেল গড়া যাবে কী করে? মুজিবকে খুঁজতে হবে সবুজ বাংলার শ্যামল ফসলের খেতের আলে বসা মাথাল মাথায় ধূমপানরত কৃষকের কাছে, সে বলবে ‘শেখের ব্যাটা’ কী করে জাগিয়ে তোলে তাদের বুকে তুফানের কাঁপন। বন্দুকের সামনে সিনা চেতিয়ে দাঁড়ানোর ভয়হীন দুরন্ত প্রাণশক্তি। কী বিরাট ঝুঁকি! কোথায় প্রতিষ্ঠিত নেতা ওয়াহিদুজ্জামান? কোথায় তরুণও নয়, কিশোর শেখ মুজিবুর রহমান? গোপালগঞ্জ মুসলিম লীগ গঠন নিয়ে বেধে গেল ধুন্ধুমার। ভদ্রলোকটি পেছনের দরজা দিয়ে মুজিবকে কুপোকাত করতে চাইলেন। অকুতোভয় মুজিব, অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী মুজিব, সত্য-সুন্দরের আরাধ্যকারী মুজিব, কোন ভ্রƒকুটিকে পরোয়া না করে গোপালগঞ্জে মুসিলম লীগ গঠনে এগিয়ে গেলেন। কী অবাক কাণ্ড! ছাত্রনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই মুসলিম লীগ নেতা বনে গেলেন। মজার আরও ইতিহাস আছে। এই মুজিবের কাছেই ওয়াহিদুজ্জামান ১৯৫৪-এর নির্বাচনে জনভোটে গোহারা হারলেন। টুঙ্গিপাড়ার মুজিব, গোপালগঞ্জের মুজিব বাংলার মুজিবে রূপান্তরিত হন। কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকালে মুজিব নিজের জীবনের কথা ভাবলেন না, ভাবলেন না ধর্মের কথা, শুধুই ভাবলেন মানবতার কথা। ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয় মুজিব ধর্মানুরাগী ছিলেন না। সম্পূর্ণ অর্থে ধর্মানুরাগী ছিলেন, কিন্তু তাঁর ধর্ম ছিল শান্তির, সাম্যের, বৈষম্যহীন মানবপ্রেমের। খণ্ডটির ৩১৬ নম্বর নথিটি একটি সংবাদের কাটিং। ১২.১২.১৯৫০ সালে গোপালগঞ্জ থেকে প্রেরিত ‘ঞযব চধশরংঃধহ ঙনংবৎাবৎ’-এর স্থানীয় সংবাদদাতা জানিয়েছেন বন্দী মুজিবকে গোপালগঞ্জ কোর্টে উপস্থিত করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে মহকুমা হাকিম কর্তৃক বলবত ১৪৪ ধারা ভঙ্গের অভিযোগে দণ্ডবিধির ১৪৩/১৮৮ ধারায় মামলা হয়। সেই মামলায় তাঁকে হাজির করা হয়েছে। সংবাদ সূত্রে জানা যায়, ১৮.০৭.৪৯ তারিখে মহকুমা হাকিম গোপালগঞ্জ শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ‘দুষ্টু’ মুজিব, ‘সেরের ওপর সোয়াসের’-এর মুজিব সভায় উপস্থিতিদের নিয়ে একটি মসজিদে ‘জোহর’ নামাজ আদায় করে মিলাদ পাঠ শুরু করেন এবং বক্তৃতা করেন। এই সমাবেশকে বেআইনী ঘোষণা করা হয় এবং মামলা রুজু হয়। সেই মামলায় মুজিবকে ফরিদপুর জেল থেকে গোপালগঞ্জ কোর্টে হাজির করা হয়। স্রেফ হয়রানি ছাড়া একে কী বলা যাবে। ১৯৫০ সালে ফরিদপুর-গোপালগঞ্জ যাতায়াতে ৪ দিন লাগত। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পাঠ করলে যাতায়াতের ভয়াবহতা অনুধাবন করা যাবে। এই মানবপ্রেমিক মুজিবকে আমাদের খুঁজে পেতে হবে। এই মুজিবকে খুঁজতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেতে হয়। অনেকেই ইতিহাসকে অনুসরণ না করে, ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে যার যার মনের মাধুরী মিশিয়ে বারবার বলে যাচ্ছেন পূর্ববাংলার মুসলমানরা ধর্মের প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিয়ে যত অশান্তি ঘটিয়ে গাঙ্গেয় বদ্বীপটিকে স্থায়ী অশান্তির জনপদে পরিণত করেছে। তারাই মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলন আঁকড়ে ধরাকে বাঙালীর ‘মোহ’ বলে চালাতে চান। আমি এই প্রবণতা ও ধারণা প্রচারের ঘোর বিরোধী। ভারত বিভক্ত না হলে খুব ভাল হতো- ধর্মভিত্তিক ভারত ভাগের পেছনে ব্রিটিশের স্বার্থ ও ষড়যন্ত্রই বেশি দায়ী বলে আমার বিবেচনা। অন্যভাবে বললে শিক্ষিত ও বর্ণ হিন্দুরাই এ জন্য পুরোমাত্রায় দায়ী। বাঙাল-মুসলমানরা ধর্ম বুঝত না, তারা তার গ্রামের কর্তাদের বুঝত। যে কোন কার্যকারণেই বড় কর্তা, মেজ কর্তা, ছোট কর্তা, দা-বাবুর কাছে হাতজোড় করে দাঁড়াত। হাতজোড় করায় আপত্তি ছিল না, সমস্যার সমাধান হলেই খুশি ছিল। কিন্তু কর্তাবাবুরা তাদের অনুগৃহীতদের প্রতি সদয় আচরণ করেননি। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা-অবহেলা সব সময় প্রকাশ পেত তাদের আচার-ব্যবহারে। ক্ষুব্ধ হতো, নিজেকে ধিক্কার দিত, কিন্তু নিরুপায় হয়ে বারবার ঘুরেফিরে বাবুকর্তাদের কাছেই যেতে হতো। প্রথম কৃষক প্রজাপার্টি, পরে মুসলিম লীগ এই বাবুকর্তা বিরোধী কথা বলতে শুরু করে। দারিদ্র্যপীড়িত আদম সন্তানরা তাদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ পেয়ে সকল বিষ উগরে দেয়। একে ‘মোহ’ বলে হাল্কা করার কোন সুযোগ নেই। গণমানুষ লোভের মোহে পড়ে না, ক্ষোভ-দুঃখে অনেক সময় বিভ্রান্ত হয়। সহজ করে বলা যায়, ১৯৪৬-এর নির্বাচনে এই ক্ষোভ ও বিভ্রান্তি জয়ী হয়, সত্য ও সমস্যা ধামাচাপা পড়ে। ক্রমেই এই ক্ষোভ মাথাচারা দিয়ে ওঠে এবং ১৯৭১-এ বিস্ফোরণ ঘটায়। কিন্তু বিস্ফোরণ যত ধ্বংস করে তত গড়ার ব্যাপক আয়োজন করতে পারেনি। এখান থেকেই ভাবতে হবে মুজিব মোহগ্রস্ত ছিলেন না, তাঁর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল- গাঙ্গেয় বদ্বীপের স্বাধীনতা। মুজিব মোহগ্রস্ত না হলে গাঙ্গেয় বদ্বীপের বাঙালী মুসলমানরাও যে মোহগ্রস্ত ছিলেন না, তা মানতেই হবে। মুজিব তাঁর জনতার স্বাধিকার চান, চান স্বাধীনতা, কণ্টকমুক্ত স্বাধীনতা। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ঢাকা লেখক : প্রবীণ রাজনীতিক ও সাবেক মন্ত্রী
×