ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিকশিত হচ্ছে টার্কি পালন

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বিকশিত হচ্ছে টার্কি পালন

উৎপাদন ব্যয় কম এবং স্বল্প বিনিয়োগে কম সময়ে অধিক মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনা থাকায় বাংলাদেশেও দ্রুত বিকশিত হচ্ছে টার্কি পালন। মুরগির মতো দেখতে কিন্তু আকৃতিতে অনেক বড় গৃহপালিত পাখিটির নাম টার্কি। মেলিয়াগ্রিস পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এক ধরনের বড় আকৃতির পাখি এটি। গৃহপালিত টার্কিও মূলত এ প্রজাতিরই। বাচ্চা অবস্থায় এগুলো দেখতে অনেকটাই মুরগির বাচ্চার মতো। দুইভাবে টার্কি পালন করা যায়- ১. মুক্ত চারণ পালন পদ্ধতি ও ২. নিবিড় পালন পদ্ধতি। গ্রামাঞ্চলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বাড়িতে টার্কির খামার করে সাফল্য অর্জনের খবর ফলাও করে গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। এর ফলে সর্ব সাধারণের মাঝে টার্কি নিয়ে বেশ আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। বিচ্ছিন্নভাবে বিকশিত খামারিরা টার্কির মাংসের বাজার সম্প্রসারণে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, নতুন এই শিল্প সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে বেকারত্ব দূরীকরণ এবং দারিদ্র্য বিমোচন হওয়ার পাশাপাশি আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় জোরালো অবস্থান করে নেবে টার্কির মাংস। জনপ্রিয় হচ্ছে টার্কি পালন বাংলাদেশের অনুকূল আবহাওয়া ও পরিবেশে পশুপাখি পালন অন্যান্য দেশের তুলনায় সহজ। টার্কিও সে রকম একটি সহনশীল পাখির জাত, যারা যে কোন পরিবেশ দ্রুত মানিয়ে নিতে পারে। এরা বেশ নিরীহ ধরনের পাখি, মুক্ত অথবা খাঁচা উভয় পদ্বতিতে পালন করা যায়। তাই দেশে খামার বিকাশের নতুন সম্ভাবনা দেখাচ্ছে টার্কি। টার্কি পাখির খাদ্য সবুজ ঘাস, শাক, লতাপাতা বাংলাদেশে সহজলভ্য। এই সুবাদে দেশে গড়ে উঠতে পারে অসংখ্য ছোটবড় টার্কির খামার। আশার খবর হচ্ছে- টার্কি পালনে তরুণ সমাজে ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। তারই প্রতিফলন হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি দেশে ব্যক্তি উদ্যোগে তরুণরা ছোট-মাঝারি খামারে টার্কি পালন করছেন। অনলাইন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারের ফলে শিক্ষিত তরুণরা টার্কি পালনে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। ঢাকার সাভার, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নওগাঁ, খুলনা, চট্টগ্রাম, যশোর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, ফেনীসহ বিভিন্ন জেলায় ছোট ছোট খামারের পাশাপাশি বড় খামারগুলোতে সফলভাবে টার্কি লালন-পালন করছেন খামারিরা। খামারিদের সফলতা দেখে নতুন নতুন অনেক উদ্যোক্তা এ নিয়ে উৎসাহ দেখাচ্ছেন। টার্কি পালনে অধিক লাভ টার্কি পালনে লাভ বেশি। ঝামেলাহীনভাবে দেশী মুরগির মতো পালন করা যায়। একটি ছাগলের তুলনায় একটি টার্কি থেকে বেশি মাংস পাওয়া সম্ভব। টার্কির মাংস সুস্বাদু এবং মাংস উৎপাদন ক্ষমতাও ব্যাপক। এক বছরেই একটি টার্কির ওজন হয় ১২-১৪ কেজি হয়। আবার অন্যান্য পাখির তুলনায় টার্কির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। ব্রয়লার মুরগির চেয়েও অনেক দ্রুত বাড়ে। এরা দানাদার খাদ্যের পাশাপাশি শাক, ঘাস, লতাপাতা খেতেও পছন্দ করে। তাই তুলনামূলক টার্কি পালনে খরচ বেশ কম। কারণ গৃহপালিত মুরগির মতোই মুক্ত অবস্থায় টার্কি পালন করা যায়। আর আমাদের দেশে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে ঘাস আর লতাপাতার অভাব নেই। টার্কি মুরগি মাত্র ৬ মাসে ডিম দেয়। বিশ্বে জনপ্রিয় টার্কির মাংস জানা গেছে, পোলট্রির ১১টি প্রজাতির মধ্যে টার্কিও একটি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টার্কির মাংস বেশ জনপ্রিয় ও দামি খাদ্য। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই টার্কি গৃহপালিত পাখি হিসেবে পালন করা। তবে প্রথম গৃহে টার্কি পালন শুরু হয় উত্তর আমেরিকায়। পরে ১৫৫০ সালে ইউলিয়াম স্টিকলেন্ট নামে এক ইংরেজ নাবিক প্রথম তুরস্ক থেকে এই জাতের মুরগি মধ্য ইউরোপে নিয়ে আসেন। ফলে তুরস্কের নাম অনুসারে এ পাখিটির নামকরণ করা হয় টার্কি। ক্রমান্বয়ে পাখিটি ইউরোপসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশে ছড়িয়ে পড়ে। টার্কি পালন বেশি জনপ্রিয় যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড ও ব্রাজিলে। পাখির মাংস হিসেবে টার্কির মাংস মজাদার এবং কম চর্বিযুক্ত, সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। সারা বিশ্বে এখন টার্কির মাংস বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। যদিও বাংলাদেশে টার্কির মাংস এখনও জনপ্রিয়তা পায়নি। অনেকে ধারণা করছেন, পোলট্রির পাশাপাশি টার্কির মাংস দেশে আমিষের চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখতে পারে। টার্কি পাখির খাবার বন্য টার্কি সাধারণত বনভূমিতে পানির কাছাকাছি এলাকায় থাকতেই বেশি পছন্দ করে। ফসলের বীজ, পোকামাকড় এবং মাঝে মাঝে ব্যাঙ কিংবা টিকটিকি খেয়েও এরা জীবনধারণ করে। অন্যান্য পাখির তুলনায় টার্কির জন্য বেশি ভিটামিন, প্রোটিন, আমিষ, মিনারেলস দিতে হয়। মাটিতে খাবার সরবরাহ করা যাবে না। সবসময় পরিষ্কার পানি দিতে হবে। খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গৃহপালিত বা খামারে যারা টার্কি পালন করেন, তারা মোট খাবারের ৫০ ভাগ সবুজ ঘাস, শাক (পালং, সরিষা, কলমি, হেলেঞ্চা, সবুজ ডাঁটা, কচুরিপানা দিতে পারেন)। তবে শাক অবশ্যই কীটনাশকমুক্ত হওয়া আবশ্যক। একটি আদর্শ খাদ্য তালিকা দেয়া হলো : ধান ২০ শতাংশ, গম ২০ শতাংশ, ভুট্টা ২৫ শতাংশ, সয়াবিন মিল ১০ শতাংশ, ঘাসের বীজ ৮ শতাংশ, সূর্যমুখী বীজ ১০ শতাংশ, ঝিনুক গুঁড়া ৭ শতাংশ, মোট ১০০ শতাংশ। নিবিড় পদ্ধতিতে ড্রাই ম্যাশ হিসেবে মোট খাদ্যের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত সবুজ খাবার দেয়া যায়। সব বয়সের টার্কির জন্য টাটকা লুসার্ন প্রথম শ্রেণির সবুজ খাদ্য। এ ছাড়া খাবারের খরচ কম করার জন্য ডেসম্যান্থাস ও স্টাইলো কুচি করে টার্কিদের খাওয়ানো যেতে পারে। কৃত্রিম প্রজননের কৌশল উদ্ভাবন টার্কি মুরগির কৃত্রিম প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন করেছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাটেরিনারি শিক্ষার্থী শেখ মোহাম্মদ শাহীন। টার্কি মুরগি উৎপাদনের জন্য বাজার থেকে তিনি ৮টি ডিম ২ হাজার টাকা দিয়ে কেনেন। এই ৮টি ডিম থেকে ৫টি বাচ্চা হয়েছে। বাকি তিনটি নষ্ট হয়ে গেছে। কেন এ ডিম নষ্ট হলো, তা নিয়ে তিনি বিভিন্ন খামারির সঙ্গে কথা বলেন। নিজে একজন ভ্যাটেরিনারিয়ান হিসেবে তার শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় কয়েক মাস ধরে সমস্যা সমাধানে নিরলস গবেষণা করে অবশেষে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে টার্কি মুরগির উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন করেন। উদ্ভাবক শাহীনের মতে, কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে একটি পুরুষ টার্কির সিমেন নিয়ে ৮ থেকে ১০টি স্ত্রী টার্কিকে দেয়া যায়। ফলে অল্প সময়ে দ্রুত টার্কির বৃদ্ধি বাড়াবে, কমাবে উৎপাদন খরচ। তাছাড়া প্রোটিনের নতুন আরেকটি উৎস হিসেবে টার্কি মুরগির হতে পারে বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত। সহযোগিতায় কেন্দ্র্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশে টার্কি পালনে আগ্রহীদের জন্য সুখবর দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বেশ লাভজনক এ পাখি পালনের জন্য আগ্রহীদের এখন থেকে ঋণ দেয়া হবে। খামারিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কৃষি ও পল্লীঋণের নতুন নীতিমালায় এ পাখি পালনে ঋণ দেয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালাটি প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, টার্কি পালনে উন্নত অবকাঠামো দরকার হয় না। তুলনামূলক খরচও কম।
×