ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কী নামে ডাকা যেতে পারে ওদের-

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

কী নামে ডাকা যেতে পারে ওদের-

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ ক্ষুদ্র হলেও রোহিঙ্গা-একটি জাতিগোষ্ঠীর নাম। এরা মিয়ানমারের স্থায়ী বাসিন্দা। নাগরিকত্ব ছিল। কেড়ে নেয়া হয়েছে। মিয়ানমার সরকার ওদেরকে বাঙালী এবং বাংলাদেশ থেকে তাদের দেশে অবৈধভাবে গিয়ে বসতি গাড়া বলে আখ্যায়িত করে থাকে। রোহিঙ্গা নামটি মিয়ানমার সরকারের কাগজে পত্রে কোথাও রাখা হয়নি। অথচ, সাবেক আরাকান (বর্তমানে রাখাইন রাজ্য) প্রদেশে অতীতে দশকের পর দশকজুড়ে রোহিঙ্গা নামেই এদের রাজনীতি, নির্বাচন, পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্বকরণসহ যাবতীয় কর্মকা- পরিচালিত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের অতীত কার্যক্রম এখন শুধুই ইতিহাস। মিয়ানমার সরকার এখন এ জাতিগোষ্ঠীর নামটিও মুছে ফেলতে উঠেপড়ে লেগেছে। যে কারণে সুচি সরকার নিজ দেশে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় রোহিঙ্গা নামটি উচ্চারণ করে না। একটি সত্যকে ঢেকে দেয়ার প্রয়াসে মিয়ানমার সরকার তাদের প্রণীত নীলনক্সা অনুযায়ী গত বছরের আগস্ট মাসে যে বর্বর ঘটনা ঘটিয়েছে তা বিশ্বজুড়ে রোহিঙ্গা নিধন ও গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে রোহিঙ্গা নামেরই ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলের মতে বাংলাদেশেও মিয়ানমারের এই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গা নামেই স্বীকৃত। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও উগ্রবাদীদের নগ্ন হামলার শিকার হয়ে এই জাতিগোষ্ঠীর অগণন সদস্য বলি হয়েছে। আর প্রাণ বাঁচাতে গত এক বছরে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে লাখে লাখে। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে। সে নিবন্ধনের আওতায় এসেছে ১১ লাখ ১৮ হাজার ৬৭৫ জন। তবে বিক্ষিপ্তভাবে। এরা উখিয়া-টেকনাফের ৩০ শিবিরে আশ্রিত হয়ে আছে। প্রত্যাবাসন প্রশ্নে ইউএনএইচসিআর-এর সহযোগিতায় এখন চলছে পরিবারভিত্তিক নিবন্ধন কার্যক্রম। এই নিবন্ধন কার্যক্রমে এদেরকে আখ্যায়িত করা হচ্ছে ‘বলপূর্বক বাস্তচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক।’ কিন্তু রোহিঙ্গারা দাবি তুলেছে, নতুন নিবন্ধন কার্ডে তাদেরকে রোহিঙ্গা নামে লিপিবদ্ধ করার জন্য। অপরদিকে, মিয়ানমারের পক্ষ থেকে এদেরকে রোহিঙ্গা নামে আখ্যায়িত না করার পাশাপাশি বলপূর্বক বাস্তচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক নামে লিপিবদ্ধ করার প্রক্রিয়ায়ও আপত্তি জানিয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রিত মিয়ানমারের এসব নাগরিকদের কি নামে আখ্যায়িত করা হবে তা বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ বিষয়। অথচ, মিয়ানমার পক্ষ এ নিয়েও নাক গলাতে শুরু করেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিভিন্ন সূত্র বলছে, বিষয়টি সম্পূর্ণ অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। বাংলাদেশে এরা ভিনদেশী হলেও তারা যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে এসেছে এটাকে কোন অস্বীকার করার উপায় নেই এবং সে দেশের ক্ষুদ্র যেসব নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে তাদেরই একটি। যে জাতির নাম রোহিঙ্গা। উখিয়া-টেকনাফে ৩০ আশ্রয় শিবিরের প্রতিটি শেডে ও ব্লকে ইউএনএইচসিআর-এর প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গাদের পরিবারভিত্তিক যে নিবন্ধন কাজ শুরু করেছে তাতে প্রতি রোহিঙ্গা পরিবার প্রধানের স্থানীয় নাম, রাখাইন রাজ্যের তাদের গ্রামের নাম, পেশা, অফিসিয়াল নাম, নাগরিক হিসেবে পরিচিতি, টাউনশিপের নাম, পারিবারিক ছবি ও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের তারিখ উল্লেখ করা হচ্ছে। প্রতিটি পরিবারকে দেয়া এক একটি কার্ড। এ কার্ডে লেখা হচ্ছে ‘বলপূর্বক বাস্তচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক।’ ইতোপূর্বে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে যে নিবন্ধন সম্পন্ন করা হয়েছে তাতে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধনের জন্য যারা লাইনে দাঁড়িয়েছে তাদের নাম লিপিবদ্ধ হয়েছে। যা পরিবারভিত্তিক ছিল না। প্রত্যাবাসন প্রশ্নে পরিবারভিত্তিক বিষয়টি উঠে আসায় এখন ইউএনএইচসিআর সে কাজ শুরু করেছে। ইউএনএইচসিআর-এর এক কর্মকর্তা শনিবার জানিয়েছেন, পরিবারভিত্তিক তালিকা না হলে এদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম সম্পন্ন দূরের কথা, শুরুই করা যাবে না। ওই কর্মকর্তা জানান, যেহেতু রোহিঙ্গা নামে ডাকা হলে মিয়ানমার তা মানবে না তাই তাদের বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবেই কার্ডে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। কিন্তু এতেও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে আপত্তি এসেছে। কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম জানিয়েছেন, পরিবারভিত্তিক তালিকা তৈরির কাজে ইউএনএইচসিআরকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এতে মিয়ানমারের কোন প্রতিক্রিয়া নেই। কিন্তু বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে তালিকা তৈরির প্রক্রিয়ায় মিয়ানমারের আপত্তি রয়েছে। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে প্রেরিত ফরমে প্রত্যাবাসনে আগ্রহী রোহিঙ্গা সদস্যদের গ্রুপ ছবি এবং পরিবার প্রধানের পাসপোর্ট সাইজের ছবি সংযুক্ত করতে বলা হয়েছে। নমুনা ফরমে রোহিঙ্গাদের স্বাক্ষর, দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ এবং বাংলাদেশে কোন ক্যাম্পে কে অবস্থান করছে তা উল্লেখ করার প্রস্তাব রয়েছে। ফরমে পরিবার প্রধানের নাম, পেশা, জন্ম তারিখ, জেন্ডার, জন্মস্থান, মিয়ানমারের পূর্ণ ঠিকানা, শনাক্তকরণ চিহ্ন, পিতামাতার নাম ও তাদের ঠিকানা, স্বামী-স্ত্রীসহ সকলের নাম এবং তাদের ঠিকানাও উল্লেখ করতে বলা হয়েছে। এ কাজ অত্যন্ত দুরূহ। এরপরও করতে হচ্ছে। রাখাইন থেকে পালিয়ে আসার পর এদের অনেকে আছে দলবদ্ধভাবে। অনেকে আছে পরিবারভিত্তিক। অনেকে আছে চিকিৎসা শিবিরে, অনেকে রয়েছে অনাথ শিবিরে। আবার মুসলিম নয় ভিন্ন ধর্মের অথচ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছে এমন যারা রয়েছে তাদেরকে রাখা হয়েছে ভিন্ন শিবিরে। সব মিলিয়ে পরিবারভিত্তিক নিবন্ধন শুরু হলেও এটা ঠিক কবে নাগাদ শেষ হবে তা বলা মুশকিল। আর এ কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এবং তা পরবর্তীতে মিয়ানমারের হাতে পৌঁছানোর পর তা সঠিক কিনা তা যাচাই বাছাই করে ফিরতি জবাব না আসা পর্যন্ত প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ঝুলে থাকবে বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা। এদিকে প্রত্যাবাসন শুরু না হয়ে থমকে থাকায় দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গারা। তারা কথায় কথায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটাচ্ছে। উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্পে দুই রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করেছে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা। অপর ঘটনায় ক্ষুব্ধ মাতাল স্বামী হত্যা করেছে তার স্ত্রীকে। বুধবার মধ্যরাতে উখিয়ার কুতুপালং ডি-৫ ব্লকে ও বালুখালী ক্যাম্পের বি-৪৩ ব্লকে এ দু’টি হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। নিহত সাবেকুন্নাহার প্রকাশ নুর ফাতেমার পিতা ইজ্জত আলী জানান, কায়সার নামে এক রোহিঙ্গা যুবক নিজেকে অবিবাহিত দাবি করে ৩ মাস পূর্বে তার মেয়েকে বিয়ে করে। বিয়ের পর থেকে তার পূর্বের স্ত্রীর প্ররোচনায় মাদকাসক্ত কায়সার প্রতিরাতেই নুর ফাতেমাকে মারধর, মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করে আসছিল। বুধবার রাতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ইয়াবা সেবন নিয়ে তর্কবিতর্কের পর নুর ফাতেমা ঘুমিয়ে পড়ে। পরে তাকে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ মিলেছে। উখিয়ার বালুখালী বি-৪৩ রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বদিউজ্জামানের পুত্র মোঃ ইসলাম নামে এক যুবককে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা পিটিয়ে হত্যা করে। নিহত যুবক মোঃ ইসলাম মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন হওয়ার আশা ব্যক্ত করলে সন্ত্রাসী রোহিঙ্গারা বুধবার রাত আড়াইটার এ ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় তার ভগ্নিপতি আহম্মদ হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ৪-৫ জনকে আসামি করে উখিয়া থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছে। উখিয়া থানার ওসি জানান, দু’টি ঘটনায় গুরুত্ব সহকারে তদন্ত ও আসামিদের ধরতে পুলিশ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্প থেকে অপহৃত সেই রোহিঙ্গা হামিদুল হককে উদ্ধার করেছে পুলিশ। শুক্রবার ভোরে অভিযান পরিচালনা করে হোয়াইক্যং উলুবনিয়ার জনৈক কালুর বসতবাড়ি থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। ওই সময় অপহরণকারী ফায়সালকে আটক করা হয়। এর আগে ১৯ সেপ্টেম্বর (বুধবার) সকালে বালুখালী থেকে অপহৃত হন হামিদুল হক (৬০)। অপহৃত হামিদুল হক বালুখালী বি-১ ক্যাম্পের জি- ৬ ব্লকের আশ্রিত রোহিঙ্গা। অপহৃতের প্রতিবেশীরা জানান, বুধবার সকাল ১০টায় বাছের নামক রোহিঙ্গা হামিদুল হককে ফোন করে ডেকে নেয়। এরপর তাকে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে এনে অপেক্ষমাণ সিএনজি বেবিটেক্সিতে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। অপহৃত হামিদুল হকের পারিবারিক সূত্র জানায়, অপহরণের পর ফোন করে ৯ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে সন্ত্রাসীরা। এরপর উখিয়া থানার পুলিশ অভিযান পরিচালনা করে। এলাকাবাসী জানান, অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা বিভিন্ন অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। চুরি-ডাকাতি, বন উজাড় ও অপহরণসহ এদের দ্বারা বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। মিয়ানমার সফরে গিয়ে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেছেন ॥ রোহিঙ্গা গণহত্যায় জড়িত ব্যক্তিদেরকে মিয়ানমার শাস্তি দিতে ব্যর্থ হলে আইসিসিতেই এদের বিচার হওয়া উচিত বলে ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা গণহত্যায় দায়ী ব্যক্তিদের যদি আইসিসিতেও বিচার করা সম্ভব না হয় তাহলে এর জন্য আমরা নতুন কিছু চিন্তা করছি। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমার সফরকালে এ কথা বলেন। বিশ্বব্যাংকের অনুদান ॥ স্বাস্থ্যখাতে সহায়তা দেয়ার পরপরই রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা প্রদানে বাংলাদেশকে আড়াই কোটি ডলার অনুদান দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক এ সংস্থাটি সহায়তা দেবে বলে ঘোষণা দেয়। শুক্রবার সংস্থাটির ঢাকা অফিস থেকে প্রেস বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য আড়াই কোটি ডলার অনুদান অনুমোদন করেছে বিশ্বব্যাংক। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২০০ কোটি টাকারও বেশি। চলমান প্রকল্পে এ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। এখানে কানাডার পক্ষ থেকে দেয়া ৪০ লাখ ডলার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
×