ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়ন

প্রকাশিত: ০৭:০০, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়ন

রাজনীতিতে নারীর সরাসরি ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সার্বিক ব্যবস্থার পুরো অবয়ব। সুতরাং একটি সমাজ যে কোন মানুষের অবস্থান, তার ভূমিকা, সময়ের সঙ্গে তাল মেলানোর প্রয়োজনীয় সুযোগ সর্বোপরি তার সামগ্রিক জীবন ও কর্মপরিধি নির্ধারণ করে দেয়। এ কেবল তাৎক্ষণিক কিংবা হঠাৎ করে গড়ে ওঠা বিষয় নয়। এর একটি সুসংবদ্ধ ধারাবাহিক পর্যায় আছে, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও উপেক্ষা করা যাবে না তদুপরি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সচেতনতা, ইচ্ছা, আশা, আকাক্সক্ষার জোরালো প্রত্যয় থাকাও বাঞ্ছনীয়। সুতরাং বাংলাদেশের নারীদের রাজনৈতিক অঙ্গনে পা রাখাটাও তেমনই একটি ক্রমবিকশিত ধারা যেখানে তারা আজকের অবস্থানে নিজেদের জায়গা করার অধিকার পেয়েছে। কতখানি অর্জন করেছে সে প্রসঙ্গে না গিয়েও বলা যায় নতুন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারে নারীরা আজ কোনভাবেই পিছিয়ে নেই। প্রগতির জোয়ারে নারীরা আজ তাদের যোগ্য প্রমাণ করার বিভিন্ন সূচকে অংশীদারিত্ব জোরদার করেছে। তার পরেও প্রশ্ন থেকেই যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন আর সহিংসতাকে কতখানি রোধ করতে সক্ষম হয়েছে। শ্রেণী বিভক্ত সমাজে শুধু নারী-পুরুষের বৈষম্য নয় মানুষে মানুষের ফারাক নির্দেশিত হয় অর্থ, বিত্ত আর ক্ষমতার মাপকাঠিতে। সে সমাজে একটি পুরুষ শ্রমিক আর নারী কর্মীর মূল্য সমান হলেও দুঃখজনকভাবে এখানে তারতম্য এসে যায় মজুরি নির্ধারণে। অর্থাৎ অবহেলিত, অপেক্ষাকৃত দুর্বল অর্ধাংশ নারী সমাজ সর্ব ক্ষেত্রেই শোষণ আর বঞ্ছনার শিকার হয়। কিন্তু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে নারীরা এত অসহায়, দুর্বল কিংবা ক্ষমতা বিবর্জিত ছিল না। ইতিহাস বলে পৃথিবীতে প্রথম যে পরিবারটি বন্য মানুষের সংহতিতে গড়ে ওঠে তা হলো মাতৃতান্ত্রিক। অসভ্য, বর্বর, বন্য মানুষরা সৃষ্টির ঊুষালগ্ন থেকেই নারীর অধিকার, ক্ষমতা এবং মর্যাদার ব্যাপারে কোন ধরনের হীনম্মন্যতা প্রকাশ করেনি। তার প্রধানতম কারণ ছিল অবাধ স্বেচ্ছাচারে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সমস্ত কৃতিত্ব বর্তাত মায়ের ওপর। পিতার কোন পরিচয়ই ছিল না। মায়ের জঠর থেকে সন্তান আসত বলে পারিবারিক সমস্ত ক্ষমতা ছিল জন্মদাত্রীর। বংশপঞ্জী থেকে আরম্ভ করে সম্পদের মালিকানা সবই হিসাব করা হতো মায়ের দিক থেকে। যাযাবর জীবনে এই মাতৃতান্ত্রিক পরিবারই ছিল সমস্ত ক্ষমতা আর আধিপত্যের উৎস। কিন্তু সভ্যতা সূর্য তার আলো যখন সারা পৃথিবীতে বিকিরণ করে এবং পিতৃত্বের পরিচয়ও চিহ্নিত হয়ে যায় তখন নারীরা তাদের সমস্ত কর্তৃত্ব আর অধিকার হারিয়ে ফেলে। বস্তুবাদী সমাজ নির্দেশক এঙ্গেলস মনে করেন সমাজের ব্যক্তিগত মালিকানার উৎপত্তি ও বিকাশ নারী জাতির ঐতিহাসিক পরাজয়। শুধু তাই নয় একক পরিবারের ভিত্তিতে পিতৃত্বের পরিচয় যখন স্বীকৃত হলো তখন ক্ষমতাবান পুরুষরা সব ধরনের অধিকার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। যা আজ অবধি নারীরা জয় করতে পারেনি। পরাভূত নারীরা পরবর্তী ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনের ধারায় অধিকারহীন তাই শুধু নয় লাঞ্ছনা, বঞ্চনা আর নিপীড়নের শিকার হয়ে পশ্চাদপদ জীবনযাপনকেই মেনে নিতে বাধ্য হয়। ক্ষমতাবান নারীর সংখ্যা ইতিহাসে খুব বেশি নেই। তারাও সিংহভাগ নারীর ভাগ্যোন্নয়নে তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। কৃতিত্বের সীমানা যখন কোন নারীকে অপরাজেয় করে দেয় সেখান থেকে তাকে পেছনে ফেলা কঠিন হয়ে যায়। সেভাবে অনেক নারী ইতিহাসের, সময়ের মাইলফলক হয়েছে। তবে এসব ব্যক্তিক ক্ষমতায় পুরো নারী জাতিকে জাগানো সম্ভব হয়নি। কারণ সমাজের ভেতর থেকে যদি মুক্তির বারতা অবারিত না হয় কিংবা সামনে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশিক তৈরি না হলে কোন বৃহৎ গোষ্ঠীকে নতুন আলোর মুখ দেখানো সম্ভব হয় না। আমরা যদি আমাদের বাংলাদেশের সমাজ বিশ্লেষণে তৎপর হই তা হলে দেখা যাবে মুষ্টিমেয় সফল নারীরা কখনও বৃহত্তর আঙিনার দ্বার উন্মোচন করতে পারেনি। ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণে সিদ্ধ পুরুষরা যখন অনুভব করলেন নারীদের যুগের উপযোগী করতে হবে, শিক্ষায় অংশগ্রহণ ছাড়া তাদের মুক্তি আসবে না তখনই অবিভক্ত বাংলার নারী সমাজ রুদ্ধ দ্বারে করাঘাত শুনল। অবরোধবাসিনীরা বাইরে আসার সুযোগ পেল। বিদ্যাসাগরের অনুপ্রেরণা আর কর্মযোগে নারী শিক্ষার দ্বার উন্মোচিত হলো। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নিজেদের যোগ্যও প্রমাণ করল। এর পরেও তা হাতে গোনার মতো। শুধু তাই নয় ইতিহাসের মাইলফলক হয়ে থাকলেন ১৮৮০ সালে জন্ম নেয়া নারী জাতির অগ্রদূত বেগম রোকেয়া। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে প্রায়ই বঞ্চিত বেগম রোকেয়া অসম সাহস আর দৃঢ় মনোবলে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সৃজন ভা-ারেও নিজেকে সমর্পণ করলেন। এর পরেও তিনি এখনও দিশারী। সর্বস্তরের নারী জাতিকে সেভাবে জাগাতেও পারেননি। অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে আজও নারী প্রগতির বার্তাবাহক। ফলে শিক্ষায় নারীরা বিংশ শতাব্দীতে অনেক এগিয়ে গেলেও সংখ্যায় নিতান্ত কম। পারিবারিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন একে অপরের সহায়ক ও পরিপূরক। সবচেয়ে কঠিন এবং দুর্লভ ক্ষমতা অর্জন রাজনীতির আঙিনায়। নারীদের জন্য আরও পর্বত প্রমাণ প্রাচীর। ঔপনিবেশিক শাসনের করাল গ্রাসে নিপতিত বিংশ শতকীয় অবিভক্ত ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গন যেভাবে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে সেখানে সচেতনতা আসাটাও ছিল এক প্রকার দায়বদ্ধতা। ফলে নারীরা আসল বিক্ষুব্ধ রাজনীতির আঙিনায়। স্বদেশী আন্দোলনের নেত্রী প্রীতিলতা-কল্পনা দত্তের নাম ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে যারা সম্মুখ সমরে ব্রিটিশ রাজশক্তির মোকাবেলা করেছেন। এরপর আমরা পাই চল্লিশের দশকে কৃষক দরদী নেতা ইলা মিত্রকে। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের গৌরবোজ্জ্বল কাহিনীর সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে শাসক শ্রেণীর সীমাহীন অত্যাচার আর নিপীড়ন। তিনিও ইতিহাসের নায়িকা। আজও আমাদের উদ্দীপ্ত করে যাচ্ছেন। সাধারণ মেয়েদের প্রভাবিত করেছেন শুধুমাত্র উদাহরণ হিসেবে। সুতরাং নারীরা আধুনিক হলেও এখনও সেভাবে রাজনীতি সচেতন হতে পারেনি। এটা সম্ভবত সারা পৃথিবীর সমস্যা। কোন এক অজানা প্রচ্ছন্ন কারণে সিংহভাগ নারীর মধ্যে রাজনৈতিক বোধ গড়ে ওঠে না। পুনরুক্তি করছি। গুটিকয়েক নেতৃস্থানীয় নারী পুরো জাতির প্রতিনিধি নয়। আমাদের ভাষা ও স্বাধীনতা সংগ্রামেও নারীদের অংশগ্রহণ নজর কাড়া হলেও সংখ্যায় অনেক কম ছিল। এখনও নারীরা সেভাবে রাজনীতির আঙিনায় প্রবেশ করতে দ্বিধান্বিত। আমাদের জাতীয় নির্বাচনে নারীরা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে আসন পাওয়ার সংখ্যাও খুব বেশি নয়। সংরক্ষিত আসনে প্রত্যক্ষ ভোটের কোন সুযোগ থাকে না। দলই নির্ধারণ করে দেয়। নারীরা সর্বক্ষেত্রে নিজেকে প্রমাণ করছে। কিন্তু রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এখনও সেভাবে দৃশ্যমান হয়নি। অথচ গত ২৮ বছর ধরে নারী সরকার প্রধান দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত আছেন। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের ক্ষমতাধর নারীদের আসনে শক্তভাবে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। কিন্তু আমাদের দেশের নারীরা শেখ হাসিনাকে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কর্ণধার মনে করলেও নিজেদের মধ্যে সে ধরনের সচেতনতা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। জাগরণ যদি সর্বমানুষের দ্বারে পৌঁছাতে না পারে তাহলে সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক প্রভাব পড়ে না। জনসংখ্যার অর্ধেক নারী কিন্তু রাজনীতিতে তার অংশগ্রহণ এতই নগণ্য উল্লেখ করার মতো নয়। পাল্লা দিয়ে পুরুষের সমান হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু এই বিশেষ অঙ্গনটিতে তাদের পদচারণা এতই ক্ষীণ আর সংখ্যায় কম ভবিষ্যত রাজনীতিতে এর সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়া অসম্ভব কিছু নয়। অপরাজিতা প্রতিবেদক
×