ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অনুবাদ সাহিত্যের প্রসারিত দিগন্ত

প্রকাশিত: ০৬:৫৭, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

অনুবাদ সাহিত্যের প্রসারিত দিগন্ত

সাহিত্যের মাধ্যমে মানুষের মানবিক ও শৈল্পিক অনুভব শক্তিকে ব্যপ্ত করার একটি প্রয়াস ‘অনুবাদ’। ভাষান্তরের বাঁধা পেরিয়ে, ভৌগোলিক দূরত্বকে জয় করে বিশ্বমানবের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ এনে দেয় অনুবাদ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, ‘দেহে দেহে জীব স্বতন্ত্র; পৃথকভাবে আপন দেহ রক্ষায় প্রবৃত্ত, তা নিয়ে প্রতিযোগিতার কোন শেষ নেই।’ বিশেষ করে বিশ্বায়নের ফলে সবাই যখন উদগ্রীব পৃথিবীর কোথায় কি ঘটছে, নতুন কি ভাবনা এলো, কি আবিষ্কার হলো জানার জন্য। অথচ মানুষের উদ্ভাবনী কল্পনা এমন কোন সাংকেতিক প্রকাশ মাধ্যম গড়ে তুলতে পারেনি যা বিশ্ব জোড়া সব মানুষেরই বোধগম্য। ভাষার উদ্ভাবন ও তার প্রসার মানব ইতিহাসের সবচেয়ে অন্যতম আদিম ঘটনা কিন্তু তার মূলে সমবেত শক্তির যে যে সৃজনী প্রতিভার বিস্ময়কর প্রকাশ লুকিয়ে তা কোন শক্তিই আবিষ্কার করে উঠতে পারেনি। তাহলেও অচেনা ভাষার অপরিচয় থেকে চেনা ভাষার রূপান্তরের মধ্য দিয়ে মানবাভিজ্ঞতার যে বৈচিত্রের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তা কিন্তু প্রমাণ করে মানবসৃষ্ট সাহিত্য দেশকালোত্তীর্ণ। আর এখানেই অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা। তার সাহায্য নিতেই হয়। সুতরাং এটা সত্য যে মানব সৃষ্ট সাহিত্য যতদিনের অনুবাদও প্রায় ততদিনের। পাশ্চাত্য সাহিত্যের ইতিহাসে সম্ভবত প্রথম অনুবাদ গ্রন্থ হল ‘বাইবেল’ ও ‘হোমার রচনাবলী’ এবং অনুবাদের প্রবক্তা হলেন রোমানরা। অনুবাদ তত্ত্ব নিয়ে প্রথম আলোচনা করেন সম্ভবত সিসেরো ( খ্রিস্টপূর্ব ১০৬ -৪৩ ) এবং হোরেস। অনুবাদ প্রসঙ্গে হোরেস বলেছিলেন, ‘ অং ঃযব ড়িড়ফ পযধহমব ঃযবরৎ ভড়ষরধমব রিঃয ঃযব ফবপষরহব ড়ভ বধপয ুবধৎ ধহফ ঃযব বধৎষরবংঃ ষবধাবং ভধষষ ,ংড় ড়িৎফং ফরব ড়ঁঃ রিঃয ড়ষফ ধমব ধহফ ঃযব হবষিু নড়ৎহ ড়হবং ঃযৎরাব ধহফ ঢ়ৎড়ঢ়বৎ লঁংঃ ষরশব যঁসধহ নবরহমং রহ ঃযব ারমড়ঁৎ ড়ভ ুড়ঁঃয’। অর্থাৎ বিষয় পুরনো হলেও তা নতুন এবং ¯্রষ্টার আপন সম্পদ হয়ে উঠতে পারে যদি অনুবাদক সেই বিষয়টার মাত্রাজ্ঞান সম্পর্কে সচেতন থাকেন। যেমন ইংরেজীতে বাইবেল অনুবাদ হয়েছিল গ্রীক থেকে। আর গ্রীক গ্রন্থখানি হীব্রু গ্রন্থ অবলম্বনে লিখিত। ইংরেজীতে ঐবষষ শব্দের মানে নরক কিন্তু হিব্রুতে যে শব্দের অনুবাদ নরক বা ঐবষষ বলে করা হয়েছে তার অর্থ নরক নয় বরং তা ঐবধষ শব্দের কাছাকাছি, যার মানে আরাম হওয়া। যেমন ক্ষত আরাম হবার চামড়া জন্মে গেলে ঠিক তেমনি মৃত মানুষের আরামের, নিশ্চিন্তে অবস্থানের জায়গা ঐবষষ .শব্দ বিভ্রাটে মানেটাই পালটে গেছে। রোমান ক্লাসিসিজমের অন্যতম ব্যক্তি লনজাইনাস ও আক্ষরিক অনুবাদের অন্ধ অনুকরণ না করার পক্ষেই মত দিয়েছিলেন। লক্ষণীয় এই স্তরে অনুবাদের বিষয় কাব্য সাহিত্যের পাশাপাশি ধর্মগ্রন্থ । খ্রিস্টধর্মের প্রসার ও প্রচার উপলক্ষে বাইবেল অনুবাদ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এবং এই সময় থেকেই অনুবাদ আক্ষরিক না ভাবানুবাদ হবে তা নিয়ে বিতর্কও চলতে থাকে। আর তার থেকে যে বিষয়টি উঠে আসে সেটি হলো সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির একটা অবদান আছে, তাই যে ভাবেই হোক না কেন অনুবাদ গ্রহণযোগ্য। চতুর্দশ শতাব্দীর পরবর্তী সময় থেকে বেশ সচেতন ভাবেই অনুবাদ কাজ শুরু হয় ইউরোপে। ফরাসী তাত্ত্বিক এতিয়েন দোলে, বা হোমার অনুবাদক জর্জ চ্যাপমান, বা পেত্রাকের অনুবাদের দিকে লক্ষ্য রাখলে দেখা যায় এ সময় তাঁরা মূল বিষয় (কনটেণ্ট) সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ও আক্ষরিক অনুবাদ না করে কিছুটা স্বাধীনতা নিয়েছেন অনুবাদে। রেনেসাঁর প্রভাব শুধু সাহিত্যে কবিতায় বা গদ্যে পড়েনি, তার প্রভাব অনুবাদেও। তারই ফলশ্রুতি জার্মান সাহিত্যিক গ্যেটে। তাঁর ফাউস্ট নাটকের নায়ক ফাউস্ট সেন্টজনের এর গসপেল অনুবাদ করতে গিয়ে যে সমস্যায় পড়েছিলেন তার মধ্যে দিয়ে গ্যেটের অনুবাদ নিয়ে মনোভাবের পরিচয় মেলে। একই জিনিস দেখা গেল শেক্সপিয়রের অনুবাদ করার সময়ও। এই প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘ওহ ঃৎধহংষধঃরড়হ ড়হব সঁংঃ ঢ়ৎড়পববফ ঃড় ঃযব াবৎু ষরসরঃং ড়ভ ঃযব ঃৎধহংষধঃধনষব ড়হষু ঃযবস ড়হব নবপড়সবং ধধিৎব ড়ভ ঃযব ভড়ৎবরমহ হধঃরড়হ ধহফ ঃযব ভড়ৎবরমহ ঃড়হমঁব’ . উল্লেখ্য যে, তিনি একই সময়ে ও একই ভাষার থেকে অনূদিত প্রতিটি সাহিত্যকেই ঠিকঠাক পেশ করার জন্য অনুবাদককে তিনটি স্তর অতিক্রম করতে হয়, এই কথাও বলে মূলত অনুবাদকের ভাবানুবাদকে কিছুটা মূল্য দিলেন, এবং তারই ফলশ্রুতি গাউস্টের অনুবাদ। গ্যেটের বক্তব্যকেই ক্রম প্রসারিত করে ফ্রেডারিক শ্লেগেল বললেন, কোন ভাষা বা সাহিত্যের অনুবাদ শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, তা চেতনারও এক বিন্যাস। আসলে পাশ্চাত্যে এই সময় এত অনুবাদ নিয়ে আলোচনার কারণ হলো, অনুবাদের ক্ষেত্রে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিকের সক্রিয় অংশগ্রহণ। ফলে একদিকে তারা নিজেদের লেখা যেমন অন্য ভাষায় তুলে ধরছেন ঠিক তেমনি অন্য ভাষার সাহিত্যকেও সমানভাবে অনুবাদ করছেন পাঠকের জন্য। এর ফলে অনেকক্ষেত্রে মূল লেখার কিছুটা পরিবর্তন হলেও লাভবান হচ্ছে পাঠকই। অন্যদিকে অষ্টাদশ শতকে লাতিন আমেরিকায় অনুবাদ এত না হলেও উনিশ শতক জুড়েই অনুবাদ সাহিত্য বদলে দিচ্ছে সাহিত্যের চেনা গ-ি। এই পর্বে বলা যায় অনুবাদকের ভূমিকা লাতিন আমেরিকার সাহিত্য বিশেষ করে ম্যাজিক রিয়্যালিজম জনপ্রিয় হবার পেছনে অনস্বীকার্য। উনিশ থেকে বিংশ শতক- এই সময় বোরহেস, কোরতাযার, মারিও ভারগাস সোসা, গারসিয়া মারকেজ, ফুয়েন্তেজের লেখার অনুবাদ শুধু যে নিছক সাহিত্য নয়, তা যে সমস্ত লাতিন আমেরিকার ভৌগোলিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক এবং স্বতন্ত্র এক আইডেন্টিটি তাও বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত হলো অনুবাদকদের হাত ধরেই। প্রাচীন যুগ থেকে ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধ অব্দি পাশ্চাত্য ও লাতিন আমেরিকা অনুবাদ ও অনুবাদ কিভাবে হওয়া উচিত এই নিয়ে এত আলোচনা ও বাদানুবাদ করেছে এবং তাতে জিজ্ঞাসা এতটাই বেড়ে চলেছে যে বিংশ শতাব্দীর শেষে এই শতকে অনুবাদতত্বের শীর্ণকায় নদীটি ক্রমশই স্ফীতকায়া হয়ে উঠে বর্তমানে সাহিত্যের একটি অন্যতম ধারা রূপে স্বীকৃত হয়েছে । অন্যদিকে অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে সামান্যতম আলোড়ন ও পরিলক্ষিত হয়না প্রাচ্য তথা ভারতীয় সাহিত্যে। অথচ প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে বা প্রাদেশিক সাহিত্যে যে অনুবাদ অপরিচিত ছিল এমন নয়, বরং রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য বা ধর্মীয় গ্রন্থ যে অনূদিত হয়েছে বিভিন্ন কালেই। অনেকেই মনে করেন, ‘রামায়ণে’র সঙ্গে ‘ ইলিয়ড’ ও ‘ ওডিসি’ মহাকাব্যের মিল আছে। শুধু তাই নয় ,খ্রিস্টোত্তর প্রথম শতকের রোম নিবাসী গ্রীক কবি দিয়ন ক্রিসোস্তোম এমন একটি হিন্দু কাব্যের অস্তিত্ব জানতেন যা হোমার থেকেই ‘অনূদিত’ বা ‘অপহৃত’ বলে মনে করা হয় । এটি কোন কাব্য তা সঠিকভাবে নির্ধারিত না হলেও কাহিনীর বিন্যাস ও উপকরণ থেকে তা রামায়ণ বলেই অনুমান করেন অনেকে। অর্থাৎ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এই মিল ঘটেছিল সাহিত্যের মাধ্যমেই তা স্বীকার করে নেয়াই যায়। তা হলেও কিন্তু এখানে অনুবাদ চর্চা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। অনার্য অধ্যুষিত বাংলাদেশ খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দী থেকে গুপ্ত সা¤্রাজ্যের অধীনে আসার পর আর্য প্রভাবের যে ক্রম বিস্তার ঘটেছিল, আরও পরে দ্বাদশÑ ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি বিজয়ের ফলে বিধর্মীয় রাজশক্তির প্রভাব ঠেকাতে এবং প্রতিষ্ঠিত আর্থ-সামাজিক স্থিতাবস্থার ভাঙন এড়াতে সমাজ শক্তির নেতৃত্ব স্থানীয় প্রতিনিধিরা হাতিয়ার করলেন অনুবাদ সাহিত্যকে। যার ফলে ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ ‘কাশীদাসী মহাভারত’ বা মালাধর বসুর ‘ভাগবতানুবাদ’। কারণ এছাড়া নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার উপায় ছিল না। বাংলায় আর্য রাজন্যবর্গ, অভিজাত সম্প্রদায়, পুরহিততন্ত্রের আচার বিচার শাস্ত্র শাসিত শাষণে অবদমিত সাধারণ মানুষের সামাজিক প্রত্যাশার মাধ্যম হিসেবে মঙ্গল সাহিত্য কাব্য গড়ে উঠলে তারই বিপরীতে উচ্চ শ্রেণীর প্রতিভূরা নিয়ে এলেন অনুবাদ সাহিত্য। ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে বলেছেন ‘বাঙালী সমাজের পুনর্গঠনের জন্য এবং বাঙালী ঐতিহ্যের সর্ব ভারতীয় প্রাণধারার সঙ্গে যোগস্থাপনের জন্য রামায়ণ মহাভারতের অনুবাদশ্রয়ী প্রভাবের ও প্রয়োজন ছিল’। কিন্তু এই অনুবাদ প্রক্রিয়া কতটা বা তার শব্দ প্রয়োগ কতটা সঠিক ছিল তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মহাভারতের পূর্ণ অনুবাদ বাংলায় সর্বজনগ্রাহ্য গ্রন্থ কালীপ্রসন্নর মহাভারত। বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘মহাভারতের কথা’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন সেই অনুবাদের কিছু শব্দের মানে কিভাবে বদলে গিয়ে নতুন শব্দ এসছে, তিনি এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, কুন্তীর প্রতি ব্যাসদেবের একটি উক্তি, ‘সন্তি দেবনিকায়শ্চ সংকল্পাজ্জনয়স্তি যে/বাচ্যা দৃষ্টা তথা স্পর্শাৎ সংঘর্ষেনতি পঞ্চধা’। দেবতারা পাঁচ উপায়ে প্রজজন করে থাকেন। সংকল্প, দৃষ্টি, বাক, স্পর্শ ও সংঘর্ষ’Ñ এখানে ‘সংঘর্ষ’ মানে স্পষ্টতই ইন্দ্রিয় মিলন- নীল কণ্ঠও বলেছেন সংঘর্ষণরত্যা। কিন্তু কালীপ্রসন্নে আছে ‘প্রীতি উৎপাদন’ । অর্থাৎ অনুবাদক এখানে মূলে না গিয়ে শব্দের মানেই বদলে দিয়েছেন। যদিও তাঁর অনুবাদই সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য। মনে করা হয় মধ্যযুগে সাহিত্যের একটা কালোযুগ চলেছিল। কিন্তু সেখানেও দেখা যাচ্ছে অনুবাদ হচ্ছে। এবং সেই অনুবাদের পৃষ্ঠপোষক বাইরে থেকে আসা সুলতানরা। তথ্য বলছে মহাভারত প্রথম বাংলায় অনুবাদ করেন কবীন্দ্র পরমেশ্বর এবং তাঁকে এ কাজে উৎসাহ যোগান সুলতান হোসেন শাহের সেনাপতি পরাগল শাহ যা পরাগলী মহাভারত নামে পরিচিত। অন্যদিকে রামায়ণের অনুবাদক কৃত্তিবাস হলেও প্রথম মহিলা অনুবাদক চন্দ্রাবতী। আবার ভাগবতের বারোটি খ- ও ৬২০০০ শ্লোকের বাংলা অনুবাদ করছেন মালাধর বসু। এরও পৃষ্ঠপোষক বাদশাহ রুকনউদ্দিন বরবক শাহ। এবং এই কাজের পুরস্কারস্বরূপই তিনি গুণরাজ খান উপাধি লাভ করছেন। আবার এই সময়ই অনুবাদ হচ্ছে ইরানের কবি ফেরদৌসির শাহনামা , বাংলা অনুবাদক মোজাম্মেল হক, তারই রোমান্সধর্মী প্রণয় উপাখ্যান ইউসুফ জোলেখার অনুবাদ করছেন শাহ মুহম্মদ সগীর, আবদুল হাকিম, গরীবউল্লাহ। এই পর্বে অবশ্য বেশিরভাগ অনুবাদ হচ্ছে সংস্কৃত (রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত) হিন্দী ও আরবী ফারসী সাহিত্য থেকে। ফারসী থেকে লায়লা মজনু অনুবাদ করছেন দৌলত উজির বাহরাম খান। গরীবউল্লাহ ফারসি থেকে অনুবাদ করছেন জঙ্গনামা। ফারসি হাতেম তাই অনুবাদ করছেন সাদতুল্লাহ, সৈয়দ হামজা। আলাউল যিনি মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি তিনি একের পর এক অনুবাদ করছেন সপ্ত পায়কর, সিকান্দার নামা, তোহফা। শুধু তাই নয়, হিন্দী কবি মালিক জায়সীর রচিত পদুমাবত থেকে পদ্মাবতীও লিখছেন তিনি। আবার এই সময়ই ময়মনসিংহ গীতিকা ২৩টি ভাষায় অনূদিত হয়। অর্থাৎ অনুবাদ সাহিত্য মধ্যযুগের ভারতে ও বাংলায় যথেষ্ট পরিচিত একটি বিষয়। অনুবাদের মান কেমন ছিল সে বিষয়ে মতান্তর থাকলেও এটা পরিস্কার বিশ্ব সাহিত্য বিশেষ করে ফারসি, আরবী ও ভারতীয় সাহিত্যের মেলবন্ধন ঘটাবার জন্য সে যুগের সুলতান ও বাদশাহরা যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। এবার আসি আধুনিক বাংলা সাহিত্যে অনুবাদের প্রভাব কেন এলো এই বিষয়ে। মনে রাখতে হবে এই সময় ভারত ব্রিটিশদের অধীনে। কাজেই অনুবাদ কাজের পেছনেও উদ্দেশ্য ছিল। এক্ষেত্রে মূলত দুটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে অনুবাদের কাজ হয়। প্রথমত- উপনিবেশিক শাসনের সুবিধার্থে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের প্রয়োজনে, পাঠ্যবইয়ের অনুবাদ বা রাষ্ট্রশাষনের জন্য অপরিহার্য আইন কানুন, রীতিনীতি, নির্দেশনামা প্রভৃতির অনুবাদ কিংবা ধর্ম গ্রন্থের অনুবাদ সংঘটিত হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় ঊনবিংশ শতকের প্রবাদপুরুষ প-িত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর কৃত ‘কথা মালা’র বিজ্ঞাপনটি- ‘রাজা বিক্রমাদিত্যের পাঁচ ছয় শত বছর পূর্বে গ্রীস দেশের ইসপ্ নামে এক প-িত ছিলেন। তিনি কতকগুলো নীতিগত গল্পের রচনা করিয়া আপন নাম চির স্মরণীয় করিয়া গিয়াছেন। ঐ সকল গল্প ইংরেজী প্রভৃতি নানা য়ুরোপীয় ভাষায় অনুবাদিত হইয়াছে এবং য়ুরোপের সব প্রদেশেই অদ্যাপি আদরপূর্বক পঠিত হইয়া থাকে ...। এই নিমিত্ত, শিক্ষা কর্ম্মাধক্যশ্রীযুক্ত উইলিয়ম গর্ডন ইয়ং মহোদয়ের অভিপ্রায় অনুসারে, আমি ঐ সকল গল্পের অনুবাদে প্রবৃত্ত হই। কিন্তু এতদ্দেশীয় পাঠকবর্গের পক্ষে সকল গল্পগুলো তাদদৃশ মনোহর বোধ হইবেক না। এজন্য ৬৮টি মাত্র আপাতত নুবাদিত ও প্রচারিত হইল’। অর্থাৎ এই সময় শাসক শ্রেণীর সচেতন প্রয়াসে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অনুবাদ হয় যার ফলশ্রুতি শ্রীরামপুর মিশন বা ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের প্রতিষ্ঠা। কেরী অনুবাদকে ধর্ম প্রচারের প্রধান উপায় বলে মনে করতেন এবং যে কারণে তিনি নিজে বা তাঁর নেতৃত্বে ৪০টি এশীয় ভাষায় আংশিক বা সম্পূর্ণ বাইবেল অনূদিত প্রকাশিত হয়েছিল । দ্বিতীয়ত, এদেশের শিক্ষিত শ্রেণী অনুবাদকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন, তার অন্যতম কারণ রেনেসাঁর পরবর্তী বিশ্ব সাহিত্যকে জানার প্রয়াস। অর্থাৎ এই পর্যায়ে ‘ঞৎধহংষধঃরড়হ ঃযবহ ফঁৎরহম ঃযরং ঢ়বৎরড়ফ, যধফ ধ ফঁবষ ৎড়ষব ,ংবৎারহম ঃযব রহঃবৎবংঃং ড়ভ নড়ঃয পড়ষড়হরুবৎ ধহফ পড়ষড়হরুবফ।’ অবশ্য এই সময় ইংরেজী, ফরাসি ও জার্মান থেকেই বেশি অনুবাদ হচ্ছে। তার কারণও এই উপনিবেশবাদ। এই পর্যায়ে সমগ্র বিশ্বের কাব্যরুপকে বাংলায় অনুবাদ করেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। তীর্থ সলিল, তীর্থ রেণু, মণিমঞ্জুষা, প্র প্র প্রকাশিত তিনটি কাব্য গ্রন্থ শুধু অনুবাদ কবিতারই সংকলন। কিন্তু কবি-অনুবাদকের এই বিশ্ব প্রীতির মূলে কি কেবলই তাঁর বিশিষ্ট আত্মসত্তা বা পাঠক সত্তার অভিপ্রকাশ নাকি সমকালীন প্রাচ্য পাশ্চাত্য সাহিত্যের পারস্পরিক সম্পর্কজনিত অন্তর্দ্বন্দ্বেরও বহির্প্রকাশ, যার জন্য তিনি অনুবাদকে হাতিয়ার করলেন। মনে রাখতে হবে সময়টাকে যে সময় উপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একধারে প্রতিরোধ অন্যধারে আত্ম সত্তা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। এই সময়ই সত্যেন্দ্রনাথ বাঙালিত্বের সীমায়িত গ-ি ভেঙে বিশ্ব মানবত্বে উত্তীর্ণ হতে চাইছেন প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিলন ঘটিয়ে। তাই তিনি বারবার অনুবাদ করছেন। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে তিনি একাধিক ভাষা জানতেন। তাই তাঁর অনুবাদ কালোত্তীর্ণ। এছাড়াও এই সময় যারা অনুবাদ চর্চায় মন দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জ্যোতিরিন্দ্র ঠাকুর, মধুসূদন দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার। যদিও জ্যোতিরিন্দ্র ঠাকুর মূলত ফরাসি সাহিত্যেই উৎসাহী ছিলেন, যার প্রমাণ পিয়ের লোতির ‘ল্যাঁদ সাঁজাংলে’র অনুবাদ। এই অনুবাদ শুধু ভাষা জ্ঞানে বা ভাষান্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তা তাঁর আপন মানসিকতার রঙে ও সজ্জিত। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন -‘ত্রিবাঙ্কুরে লোতি ভারতীয় সঙ্গীত শুনে বিস্ময়ের উচ্ছ্বাসে সে সঙ্গীতের বর্ণনাতে কত না স্বর কত না ধ্বনি মিশিয়ে দিয়েছেন; জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বাংলা সে-সব সে-ধ্বনি অবিকল বাজিয়ে চলেছে...। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের লেখনী লোতির বিহ্বল ভয়ার্ত হৃদয়ের প্রতি কম্পন প্রতি স্পন্দন ধরে নিয়ে যেন বীণাযন্ত্রের চিকন কাজের সঙ্গে মৃদঙ্গের নিপুণ বোল মিশিয়ে দিয়েছেন।’ এই সময়ের আরেক উল্লেখযোগ্য অনুবাদক হেমচন্দ্রের সম্পর্কে সাময়িক পত্রিকায় {১৩১০ বঙ্গাব্দ, ২য় বর্ষ, নবম সংখ্যা) বলা হলো - ‘হেমচন্দ্রের রচনায় অধিকাংস অনুবাদ ও অনুকরণ মাত্র ও তাহাতে মৌলিকতার অভাব একথা বলিয়া আমরা তাঁহার নিন্দে করিতেছি না। মনুষ্য কালের সৃষ্টি, ¯্রষ্টা নহে। যে যুগে হেমচন্দ্রের আবির্ভাব তাহা অনুবাদ ও অনুকরণের যুগ ...। বলিতে কি, অনুবাদ ও অনুকরণ না হইলে মৌলিকতার বিকাশ হইতে পারে না। হল্যান্ডের প্লিনি ও নর্থের প্লুটার্ক না হইলে বোধহয় আমরা হুকারও রজার আশ্যামের এর গদ্য ও বোধহয় ফেয়ারি কুইন ম্যাকবেথ ও লীয়ের দেখিতে পাইতাম না। ... অনুবাদকেরা ভাষা গঠিত করিয়া মৌলিকতার পথ পরিষ্কার করিয়া দেন। সে জন্য সাহিত্য জগতে তাঁহারা বিশেষ ক্তৃজ্ঞতার ভাজন।’ এবার আসি রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর অনুবাদ চর্চায়। রবীন্দ্রনাথ নিজে এক সময় প্রচুর অনুবাদ করলেও তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন অনুবাদ করলে মূল সাহিত্যের গুণ বজায় থাকে না। সেই কারণেই তিনি পরিণত মানসিকতায় দীর্ঘ জীবনব্যাপী সাহিত্য চর্চার অনুবাদের তুলনায় ভাষা শিক্ষার ওপর অধিক জোর দেন। কারণ তিনি মনে করতেনÑ “দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাষার মধ্যে কথায় কথায় অনুবাদ চলতেই পারে না। ইংরেজী ও বাংলা দুই ভাষার প্রকাশের প্রথা স্বতন্ত্র এবং পরস্পরের মধ্যে শব্দ ও প্রতিশব্দের অবিকল মিল পাওয়া অসম্ভব। এই কথাটি তর্জমা করতে গিয়ে যতই আমাদের কাছে ধরা পড়ে, ততই উভয় ভাষার প্রকৃতি স্পষ্ট করে তুলতে পারি। এই জন্যই অনুবাদ যোগে বিদেশী ভাষা শিক্ষার প্রণালীকে আমি প্রশস্ত বলে মনে করি’। এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে তাঁর লেখা ‘ গোরা’র অনুবাদ নিবেদিতা করলেও তাঁর কিন্তু পছন্দ হয়নি অথচ নিবেদিতার অনুবাদের মাধ্যমেই তাঁর লেখা প্রথম বাইরে প্রকাশিত হয়। আসলে একই ভাষা হইতে অন্য ভাষায় কোন একটি ভাব ব্যক্ত করা বড়ই কঠিন। ভাষার ঠিক ব্যবহার না জানলে কি হতে পারে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিষবৃক্ষ উপন্যাসটি তার প্রমাণ। এই লেখাটি ইংরেজীতে অনুবাদ হয় “চড়রংড়হ ঞৎবব” নামে। যিনি অনুবাদ করেন তিনি বঙ্গীয় সমাজের বিষয়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। স্বভাবতই তাঁর অনুবাদে ভুল হওয়াই স্বাভাবিক। উদাহরণ, গ্রন্থে এক জায়গায় রয়েছে ‘কোথাও বা গোপাল উড়ের যাত্রা হইতেছে।’ অনুবাদক অনুবাদ করলেন , ‘ওঘ ংড়সব ঢ়ষধপবং ঃযবৎব বিৎব ঃযব লড়ঁৎহবু ড়ভ ঃযব ভষুরহম এড়ঢ়ধষ”। অর্থাৎ পুরো লাইনটার মানেই বদলে গেল। এখানে লক্ষণীয় যে ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে বা বিংশ শতকের অধিকাংশ অনুবাদকই কিন্তু সচেতনতা নিয়ে অনুবাদ কার্যে নিরত হননি। তাই অনেকক্ষেত্রেই উৎস সম্পর্কে নীরব থেকেছেন অনুবাদকরা। কখনো কোন সাহিত্য মানে কোন ভাষা থেকে অনুবাদ করছেন তা উল্লেখ করাই যথেষ্ট মনে করেছেন, আবার কখনো বা লেখকের নাম উল্লেখ করলেও তিনি কোন ভাষার সেটার কিছুই জানাননি। ফলে সেই অনুবাদ আদৌ মূলের সঙ্গে কতটা সম্পর্ক যুক্ত তা বোঝা দুষ্কর। এই ধরনের অজ্ঞতায় ভারাক্রান্ত বিংশ শতকের প্রথম দশক। এর ফলশ্রুতিতে অনুবাদের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। বুদ্ধদেব বসু নিজে একাধিক অনুবাদ করলেও অনুবাদ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, লেখা যত ভাল অনুবাদকের বিঘ্ন তত বেড়ে যায়। আসলে সাহিত্য হল জীবনধর্মী। দেশ কাল স্থান পাত্র পরিবেশ অনুযায়ী সাহিত্য রচিত হয়। লেখক তার জানা উপকরণ দিয়ে তার সৃষ্টিকে সাজান। সেই সৃষ্টি যখন আরেক দেশের ভাষায় অনুবাদ হয় তখন কি অনুবাদক একই চিন্তাধারায় একই শব্দ গন্ধ দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন নাকি সেটা সম্ভব! শেষ করার আগে নিজের কিছু অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিচ্ছি। ‘অনুবাদ পত্রিকা’র সম্পাদক হবার সূত্রে একাধিক দেশী বিদেশী লেখা পড়ার সুযোগ পাই। নিজেও অনুবাদ করি বলে সবসময় মূল ভাষা না জানলেও ইংরেজীটা দেখার চেষ্টা করি। অনেকক্ষেত্রেই দেখি ইংরেজীর সঙ্গে অনুবাদের অমিল অনেকটাই। অনেকেই আবার খানিকটা অংশ বাদ দিয়ে নিজের সুবিধামতো অংশ অনুবাদ করেছেন। আবার কেউ শব্দটাই বদলে ফেলেছেন পুরো। যার ফলে অনুবাদ মূল থেকে একবারেই সরে গিয়ে স্বতন্ত্র লেখা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যিনি ইংরেজী থেকে অনুবাদ করছেন তিনিই যখন এত মানে বদলে ফেলছেন, তখন মূল থেকে অনুবাদ যিনি করছেন তিনি কি করেছেন সেটাও কিন্তু বিবেচ্য। একই গল্প একজন ইংরেজী থেকে আরেকজন মূল থেকে দিলে দেখেছি কত পার্থক্য দুটোর। মূল ভাষা না জানার এই বিভ্রাট। তা হলে কি অনুবাদের কোন গুরুত্ব নেই! না। অনুবাদ করতেই হবে। সব ভাষাই যুগের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে। নতুন শব্দ যোগ হচ্ছে, পুরনো অনেক শব্দ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। সেটা মাথায় রেখেই ভাবতে হবে বিশ্ব সাহিত্যকে জানতে গেলে অনুবাদ ছাড়া বিকল্প নেই। তাতে যদি কিছু বাক্যের বদল ঘটে তবু অনুবাদককে সেই স্বাধীনতা দিতেই হবে। ‘আশ্বিনের নবান্নের ঘ্রাণ’ তাতে না থাকলে ক্ষতি নেই, তবু এটা তো নিশ্চিত ‘আশ্বিন’ ও ‘নবান্ন’ দুটিই আছে। তার ঘ্রাণ ও ঠিক পাওয়া যাবে। আর সেটা পাওয়ার জন্য অনুবাদকদের কদর বাড়ছে সারা পৃথিবী জুড়েই। আসলে ভিন্ন ভিন্ন সময় ও সমাজ ভিন্ন চিহ্নায়ন প্রক্রিয়া তৈরি করে। অনুবাদ তার সঙ্গেই নিজেকে যোগ করে নতুন হয়ে উঠছে। এরকম হতে পারছে কারণ মানব চেতনার সমস্ত স্তর ও উপকরণক্যা ছুঁয়ে যাচ্ছে অনুবাদ, তা এখন প্রমাণিত। ভাষার অজ¯্র বিভঙ্গের মাঝে প্রবাহিত হচ্ছে অখ- মানব চেতনা। আর এখানেই অনুবাদকের প্রাপ্তি ও স্বার্থকতা।
×