ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ॥ অধ্যাপক গুস্তাভ এফ পাপানেক

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ॥ অধ্যাপক গুস্তাভ এফ পাপানেক

গুস্তাভ এফ পাপানেক যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ও আমার স্ত্রী সিতারার শিক্ষক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা ও অনুমোদনক্রমে ১৯৭৪ সালে উন্নয়ন অর্থনীতিতে এম এ পর্যায়ের উচ্চতর শিক্ষার জন্য আমি ও ড. সৈয়দ আব্দুস সামাদ (বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত) বাংলাদেশের প্রথম দুই বাঙালী সুশীল সেবক হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোর্ড ফাউন্ডেশনের বৃত্তি নিয়ে উন্নয়ন অর্থনীতি পড়তে যাই। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন অর্থ ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে যথা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অফিসার বাংলাদেশ সরকারের বড় প্রয়োজন। তিনি বলেছিলেন পাকিস্তান আমলে এই দুই ক্ষেত্রে বাঙালী সুশীল সেবকদিগকে তখনকার কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পিত বৈষম্যমূলক কার্যক্রম অনুযায়ী পেছনে রাখার জন্য কোন দায়িত্ব দেয়া হতো না বলে এক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তাদের জ্ঞান ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী আমার অনুগমনে আমার স্ত্রী সিতারা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন অর্থনীতির ছাত্রী হয়েছিলেন। তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশনের সুশীল সেবকদের উচ্চতর শিক্ষার প্রতিকূলে অযৌক্তিক অবস্থান আমার স্ত্রী হিসেবে তাকে আমার সঙ্গে যাওয়া ও থাকার জন্য খোরপোষমূলক সহায়তা কিংবা কোন বৃত্তি পাওয়ার অনুকূল হয়নি। সে বছর থেকে অর্থনীতির শিক্ষার ক্ষেত্রে অধ্যাপক পাপানেক আমাদের দু’জনের কাছে আজীবন শিক্ষক ছিলেন। আমাদের পরিম-লে আমরা পাপানেককে মার্কিনী প্রথা অনুগামী তার প্রথম নামের সংক্ষেপিত অবয়ব গাস বলে সম্বোধন করতাম। গুস্তাভ এফ পাপানেক ১৯২৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ৫০ বছর ধরে তিনি অর্থনীতির শিক্ষক ও ব্যবহারবিদ হিসেবে আমাদের- তার ছাত্র ও সহযোগীদের কাছে বরণীয় ছিলেন। পাপানেক কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৭ সালে কৃষি অর্থনীতিতে স্নাতক হন। ১৯৪৯ সালে বিশ্ববিখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর এম এ হন এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২ বছরের মধ্যে ১৯৫১ সালে অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ ডিগ্রী পিএইচডি অর্জন করেন। অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জনের পথে তিনি হার্ভার্ডে প্রবীণ অধ্যাপকদের গবেষণা ও শিক্ষা সহযোগী হিসেবে কাজ করে পড়াশোনার ব্যয় নির্বাহ এবং পেশার ব্যতিক্রমী বিকাশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই সময়ে তার সহপাঠী ও বান্ধবী ছিলেন হানা কায়সার। ইহুদী বংশোদ্ভূত গুস্তাভ ও হানা নাজিদের অত্যাচার হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য ১৯৪০ সালে ইউরোপ হতে যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেন। ১০ বছর পর বান্ধবী হানা গুস্তাভ পাপানেকের প্রিয়তম স্ত্রী হন। হানা সামাজিক সম্পর্ক বিষয়ে পড়াশোনা করে হার্ভার্ড থেকে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। গুস্তাভ পাপানেক ১৯৫১-৫৩ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে কর আরোপণ ও উন্নয়ন বিষয়ে পরামর্শক, ১৯৫৪-৫৭ সালে পাকিস্তানের পরিকল্পনা কমিশনের উপদেষ্টা, ১৯৭১-৭৩ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নয়নকামী এশীয়, আফ্রিকান ও লাতিন আমেরিকার সরকার এবং উন্নয়ন সংস্থায় প্রেষণে প্রেরিত উন্নয়ন উপদেষ্টাগণের পরিচালক ছিলেন। ১৯৭১-৭৩-এ তিনি ইন্দোনেশিয়ার সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের উপদেষ্টা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭-৭৮ সালে তিনি বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে এশীয় উন্নয়ন সমীক্ষণ কার্যক্রমের পরিচালক ছিলেন। তারপর ১৯৭৪ সালে তিনি বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান হন। এই সময়ে তার সঙ্গে আমাদের পরিচয় এবং তার তত্ত্বাবধানে আমাদের উন্নয়ন অর্থনীতিতে পড়াশোনা। আমাদের অনুসরণ করে ১৯৭৫ সাল উন্নয়ন অর্থনীতিতে বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত কার্যক্রমের আওতায় শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের খ্যাতিমান সুশীল প্রশাসক মনোয়ারুল ইসলাম (আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রবীণ নির্বাহী হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত), মোহাম্মদ ফরাসউদ্দীন (বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ও ঢাকার ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা), মোহাম্মদ হারুনুর রশীদ (বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত) ও শাহ মোহাম্মদ ফরিদ (বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সচিব) যোগ দেন। আমার স্ত্রী সিতারাও এদের সঙ্গে অধ্যাপক পাপানেকের উৎসাহ এবং সহযোগিতায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন অর্থনীতি পড়তে সুযোগ পান। অধ্যাপক পাপানেক সিতারার পড়াশোনার আর্থিক প্রয়োজন মেটাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রাপ্ত তার অর্থনীতিতে এম এ ডিগ্রীর বিবেচনায় তাকে তার শিক্ষা সহকারী হিসেবে নিযুক্তি দেন। তার এরূপ সহৃদয় সহায়তা ছাড়া সিতারা কোন আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নয়ন অর্থনীতিতে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা ¯œাতকোত্তর এম এ ডিগ্রীধারী হতে পারতেন না। শ্রেণীকক্ষে পাপানেক বিভিন্ন দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ওপর সহজ ও সরল ভাষায় তার কথাগুলো অন্য উন্নয়ন বিশ্লেষকদের অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণসহ বলতেন এবং এসব কথার প্রেক্ষিতে অবাধ ও পারস্পরিক আলোচনায় আমাদের, ছাত্রদের জ্ঞান ও উপলব্ধির পথে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করতেন। তার ছাত্র হিসেবে আমাদের বাইরে পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ঘানা ও সোমালিয়া হতে আগত সুশীল সেবক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কর্মরত তরুণ শিক্ষকরা ছিলেন। সেমিনারে এসব বিষয়ে ছাত্র-ছাত্রী, পার্শ্ববর্তী হার্ভার্ড ও ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) অধ্যাপকদের আলোচনা এবং বিতর্কের মাধ্যমে তিনি বস্তুনিষ্ঠভাবে উন্নয়ন তত্ত্বের জ্ঞান ও প্রয়োগের অভিজ্ঞতা সকলের সামনে তুলে ধরতেন। তাকে এক্ষেত্রে সহযোগিতা করতেন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক- নাম : শেন হান্ট, রোজেনস্টাইন রোডান, মিলার্ড লং, মাইকেল ম্যানভ ও জন হ্যারিস। এদের মধ্যে অধ্যাপক রোজেনস্টাইন রোডান তখনকার দিনের উন্নয়নের বহুল আলোচিত সুসম ও অসম প্রবৃদ্ধি তত্ত্বের উদ্ভাবক পরিচিতিতে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের লাতিন আমেরিকান উন্নয়ন কেন্দ্রের পরিচালকও ছিলেন। জন হ্যারিস তাত্ত্বিক ছিলেন না, ছিলেন মূলত ব্যবহারবিধ এবং এর অভিজ্ঞান নিয়ে পরিচালনা করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আফ্রিকান উন্নয়ন সমীক্ষণ কেন্দ্র। পাপানেক আমাকে এমআইটিতে অধ্যাপনারত অর্থনীতির তৎকালীন সিংহপুরুষ অধ্যাপক পল স্যামুয়েলসনের শ্রেণীকক্ষের বক্তৃতায় উপস্থিত থাকতে সুযোগ করে দিয়েছিলেন। ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সহানুভূতিশীল, মুক্ত আলোচনা ও আনুষ্ঠানিকতাবিহীন ব্যবহারে তিনি আমাদের সকলের মন জয় করেছিলেন। আগে ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের এক শুনানিতে তিনি পাকিস্তানের অংশ হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার বিবরণ উপস্থাপন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অনিবার্য পরিণতি হিসেবে তাত্ত্বিক, ব্যবহারিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে পূর্র্ণাঙ্গ সমর্থন দিয়েছিলেন। ক্রমান্বয়ে তৎকালীন পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার উন্নয়ন প্রক্রিয়ার অন্যতম প্রধান বিশ্লেষক হিসেবে তিনি তার পরিচিতি ভাস্বর করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তার অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে তিনি তৎকালীন চীনের দৃষ্টান্ত অনুযায়ী শ্রম নিবিড় শিল্পায়ন ও রফতানি প্রসারের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণের মতবাদ সংশ্লিষ্ট সকল আলোচনায় উপস্থাপিত করতেন। সকাল ৭:৩০-এর মধ্যে তিনি লেকসিংটনের তার নিবাস হতে সাইকেলে চড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে আসতেন এবং তার সচিব অন্যদের অসন্তোষ সত্ত্বেও রাত ৮টার আগে ফিরে যাওয়ার জন্য আবার সাইকেলে চড়তেন না। লেকসিংটনে তার ছবিসম ছোট গৃহে বাঙালী প্রথিতযশা শিল্পী জয়নুল আবেদিনের এক বিশাল শিল্পকর্ম দেখে আমি ও সিতারা অভিভূত হয়েছি। তার গৃহে আলাপচারিতার মাধ্যমে তার স্ত্রী হানার আহরিত জ্ঞান ও ব্যবহার আমাদের মুগ্ধ করেছে। আগেই বলেছি হার্ভার্ডে শিক্ষাকালীন সময়ে হানার সঙ্গে পাপানেকের পরিচয় ও পরিণয় ঘটে। দিনের শেষে খাবার টেবিলে তিনি কয়েকবার তার সেই যৌবনের প্রেমকথা আমাদের বলতেন এবং হাসিমুখে অন্যদের মধ্যে সিতারার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটস্থ আমাদের ছোট নিবাসে কয়েকবার তিনি বাংলাদেশের সাদা ভাত, মুরগি ও মাছের ঝোল এবং ডাল খেয়ে অযাচিত প্রশংসা করেছিলেন। তিনি সব সময় আমাদের তার গুস্তাভ নামের সংক্ষিপ্ত অবয়ব গাস বলে সম্বোধন করতে উৎসাহিত করতেন। ব্যবহার ও বিশ্লেষণে তিনি ইহুদী বংশোদ্ভূত মানুষ হিসেবে তার পরিচয় কখনও প্রকাশ করেননি এবং ধর্মান্ধতাকে অর্থনীতির বিশ্লেষণে স্থান দেননি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ে তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন এবং এই ঘটনার পরে আমরা সকল বাংলাদেশী ছাত্র বিমর্ষ হয়ে অনিশ্চয়তার শিকার যাতে না হই তার জন্য পরম সহানুভূতিশীল উপদেশ-অনুশাসন দিয়েছিলেন। এই সময়ে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সমর্থক এডওয়ার্ড কেনেডীর সঙ্গে তিনি আমার পরিচিতি তুলে ধরেছিলেন এবং তার সঙ্গে আমার সখ্যের সূচনা করেছিলেন। বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন অর্থনীতিতে ¯œাতকোত্তর বা এমএ হওয়ার নির্ধারিত সময় ছিল ৩ বছর। এর বিপরীতে ১ বছর ১০ মাসে আমি ¯œাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষা সমাপন করার প্রক্রিয়ায় পিএইচডি পর্যায়ের প্রয়োজনীয় পাঠক্রম শেষ করে শেষোক্ত ডিগ্রী পাওয়ার জন্য নির্ধারিত পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। স্ত্রী সিতারাও এই সময়ে সৌভাগ্যবসত উন্নয়ন অর্থনীতিতে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করতে সমর্থ হন। তারপর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে অনুসৃত দ্বিখাতভিত্তিক উন্নয়নের মডেলের অনুশীলনে বাংলাদেশের অর্থনীতির সংশ্লিষ্ট উপাত্তাদি অন্তর্ভুক্ত করে কম্পিউটারে বাংলাদেশে অনুসরণীয় একটি মডেলের রূপরেখা উদ্ভাবন করে তার আলোকে পিএইচডি পর্যায়ের উপস্থাপনীয় অভিসন্দর্ভ-প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ অধ্যাপকদের যাচাই কমিটির কাছে উপস্থাপন করি। কমিটি অভিসন্দর্ভের এই প্রস্তাব অনুমোদন করে আমাকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনের পথে উপস্থাপিত প্রস্তাবের রূপরেখা অনুযায়ী অভিসন্দর্ভ পরিমার্জিত ও প্রক্ষেপিত অবয়বে সমাপন করার জন্য অনুশাসিত করে। এই পর্যায়ে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সরকার আমাকে দেশে সত্বর ফিরে আসার নির্দেশ দেয় এবং ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়কে আমার অনুকূলে অতিরিক্ত সময়কালের জন্য প্রয়োজনীয় বৃত্তি বন্ধ করার জন্য বলে পাঠায়। ফলত আমি স্ত্রী সিতারা ও ছেলে জালালকে নিয়ে দেশে ফিরে এলে সরকার আমাকে যশোরে জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়িত করে। জালালের বয়স তখন ৬ বছর। পরবর্তী জীবনে জালাল যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করে বোস্টনস্থ ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেয়। আমাদের সঙ্গে অধ্যাপক পাপানেকের সাহচর্য তাকে শিক্ষকদের জীবন বেছে নিতে হয়ত উৎসাহিত করেছিল। দুর্ভাগ্য, ২০১১ সালে এক ষড়যন্ত্রমূলক দুর্ঘটনায় থাইল্যান্ডের ফুকেট সমুদ্র তীরে আমাদের ছেলে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়। ২ বছরের কম সময়ে পিএইচডি পর্যায়ে অভিসন্দর্ভ লেখার প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরল ছিল। এই প্রেক্ষিতে অধ্যাপক পাপানেক আমাকে বাংলাদেশ থেকে ফিরে গিয়ে অভিসন্দর্ভ লেখা সমাপন করার জন্য বারবার তাগিদ দেন। তৎকালীন স্বৈরতান্ত্রিক সরকার এই লক্ষ্যে আমাকে শিক্ষা ছুটি দিতে অস্বীকার করে। পরে ১৯৭৭ সালে অধ্যাপক পাপানেক বাংলাদেশে এসে ঢাকা থেকে আমার কর্মস্থান যশোরে উপস্থিত হয়ে আমাকে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যেতে বলেন। সবুজ বিপ্লবের সম্প্রসারণ কর্মীর প্রত্যয় নিয়ে যখন তাকে আমি দিগন্ত বিস্তৃত উফশী ধানের চোখ জুড়ানো মাঠ দেখিয়েছি তখন তিনি বলেন যে, বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় আমার অভিজ্ঞান সমৃদ্ধ অভিসন্দর্ভ লেখার জন্য প্রয়োজনীয় বৃত্তির ব্যবস্থা করবে। তার কথার রেশ ধরে আমি তৎকালীন সরকারের কাছে ৬ মাস শিক্ষা ছুটির জন্য আবেদন করে বলি যে, আবেদিত শিক্ষাছুটি না পেলে আমি সরকারী চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হব। ফলত সরকার ৬ মাসের জন্য আমাকে শিক্ষাছুটি দেয় এবং আমি স্ত্রী সিতারাকে নিয়ে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসি। ছাত্রের শিক্ষা সমাপন সম্পূর্র্ণ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোন অধ্যাপক তার কর্মস্থল থেকে পৃথিবীর অপর প্রান্তে এভাবে ছুটে গিয়েছিলেন কিনা আমার জানা নেই। আমার ও সিতারার প্রতি তার এই সহৃদয়তা চোখের পানিতে আপ্লুত হয়ে আমরা মনে রেখেছি। অধ্যাপক পাপানেকের তত্ত্বাবধানে দিনরাত খেটে প্রায় ৫ মাস পর আমি আমার পিএইচডি অভিসন্দর্ভ সমাপ্ত করে তা পরীক্ষা করার জন্য সংশ্লিষ্ট পরীক্ষা কমিটির কাছে জমা দেই। এরপর অধ্যাপক পাপানেক এশিয়ার বিশেষ করে দূরপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে সেসব এলাকার বিভিন্ন দেশের সরকারসমূহকে পরামর্শ দিতে আসা-যাওয়ার পথে যখনই ঢাকা হয়ে যেতেন তখনই তার সঙ্গে আমাদের দেখা হতো। আমরা কয়েকবার এদেশে তার ছাত্র হিসেবে ফিরে আসা সুশীল সেবক, শিক্ষক ও পরামর্শকদের নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতাম, রাতে খাওয়ার ফাঁকে তার কাছ থেকে উন্নয়ন অর্থনীতির সমসাময়িক বিবর্তন বিষয়ে অবহিত হতাম আর সপ্রশংসভাবে অর্থনীতির এই শিক্ষক, প্রবক্তা এবং ব্যবহারবিদের জন্য আন্তরিক প্রশংসা ধারণ করে পৃথিবীর স¦ল্পসংখ্যক ভাল মানুষের মাঝে অধ্যাপক পাপানেককে স্থান দিতাম। বাংলাদেশের প্রতি তার কুণ্ঠাবিহীন টান ছিল। মাঝে মাঝে তিনি তার সঙ্গে এক সময়ে সহযোগী হিসেবে কাজ করা এখনকার অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত এবং আমাদের প্রয়াত সহকর্মী ও এককালীন মন্ত্রী আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান এবং বাংলাদেশ সরকারের দ্বিতীয় অর্থ সচিব মতিউল ইসলামের কথা বলতেন। বাংলাদেশে রেল দুর্ঘটনায় পা হারানো সিরাজউদ্দৌলা চৌধুরীকে তিনি বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিষয়ে এমএ ডিগ্রী অর্জনে সহায়তা করে তাকে জাতিসংঘের এক অঙ্গ সংগঠনে লাভজনক কর্মে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি আমাকে উগান্ডায় স্বৈরশাসক ইদি আমীনের পতনের পর উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের সুযোগ পেতে আমার অজান্তেই সহযোগিতা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন এবং এদেশেরই কতিপয় নরাধম কর্তৃক তার নির্মম হত্যাকা- মনে করে নীরব হয়ে আলাপচারী অভ্যাগতদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতেন। আর আমরা শ্রদ্ধাভরে তাকিয়ে থাকতাম বাংলাদেশের এই অকৃত্রিম বন্ধুর দিকে। অধ্যাপক পাপানেক ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন এবং এই পদে থাকাকালীন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের এশীয় উন্নয়ন সমীক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে এই কেন্দ্রটিকে পৃথিবীব্যাপী পরিচিতি ও মর্যাদা দিয়েছেন। সক্রিয় অধ্যাপকের পদ থেকে অবসর নিয়ে তিনি ১৯৯২ থেকে ২০১৮ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমিরেটাস অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৮৭ সালে তিনি উন্নয়ন অর্থনীতির জন্য বোস্টন ইনস্টিটিউট নামে একটি অসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে তার বিষয়ের জ্ঞান ও বিশেষজ্ঞতা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংগঠন এবং এশীয়, লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশসমূহে প্রয়োজন অনুযায়ী কাল নিরবধি লভ্য করার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো উন্নয়ন অর্থনীতিবিদদের উপহার হিসেবে দিয়ে গেছেন। ১৯৯৬ সালে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় যখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গণতান্ত্রিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে আসার জন্য সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী দেয় তখন অধ্যাপক পাপানেক সন্তোষের আনন্দে আপ্লুত হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। জীবনভর অধ্যাপক পাপানেক ৮টি বই লিখেছেন বা সম্পাদনা করেছেন, তার ৫০টি প্রবন্ধ বিভিন্ন স্বীকৃত আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এবং ৫২টি অন্যান্য প্রকাশনা তার ৫০ বছরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সমীক্ষণের সাধনার অববাহিত রূপ হিসেবে গণতান্ত্রিক দেশসমূহে সমাদৃত হয়েছে। ২০১৬ সালে তিনি ইন্দোনেশিয়া থেকে ঢাকায় এসে সিঙ্গেলস-এ আক্রান্ত হয়েছিলেন। রোগাক্রান্ত অবস্থায়ও তিনি তার হোটেল কক্ষে আমাকে ও সিতারাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। তার সঙ্গে আমার ও সিতারার ঐ ছিল শেষ দেখা। ২০১৮ সালের ১৪ জুন আমাদের কাছে লেখা তার শেষ চিঠিতে তিনি জানিয়েছিলেন যে, ডঃ সাদিকের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতি বিষয়ক একটি নিবন্ধ লিখছেন। একই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তার বিবেচনায় বাংলাদেশ কিসিঞ্জারের ঝুড়ির পর্যায় থেকে উঠে এসে সারা পৃথিবীর কাছে উন্নয়নের সফল গাথায় রূপ নিয়েছে। এই প্রেক্ষিতে সকল মেধা, অধ্যবসায় ও আনুগত্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সর্বাত্মক সমর্থন এবং সহযোগিতা দেয়ার আহ্বান তিনি বারবার আমাদের জানিয়ে গেছেন। উন্নয়ন অর্থনীতির নিরবচ্ছিন্ন সাধক হিসেবে তিনি পরামর্শকের ভূমিকায় কাজ করেছেন ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ভারত, মাইক্রোনেসিয়া, মালয়েশিয়া, মিসর, দক্ষিণ কোরিয়া, নেপাল, ইরান, ঘানা, গ্রীস, কলম্বিয়া, সাইবেরিয়া, গিনি, ইথিওপিয়া, ভেনিজুয়েলা ও আর্জেন্টিনায়। দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষত ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশ ছিল তার গবেষণা এবং উপদেশনের প্রিয় ভূম-ল। দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়নের পথে অর্থব্যবস্থা বিমুক্তকরণ ছিল তার অধ্যাপনা ও উপদেশনার মৌল ক্ষেত্র। তার ইন্দোনেশীয় ছাত্রী সাদিকা হামিদের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৮৭ বছর বয়সে তিনি ইন্দোনেশিয়ায় গিয়ে সেদেশের দরিদ্রদের আয় হ্রাসের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলেছিলেন যে, এক্ষেত্রে ইন্দোনেশিয়ার অনুসৃত নীতি কেবল অনৈতিকই নয়, উপরন্তু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও অগ্রহণীয়। ২০১৭-এর ১৬ ডিসেম্বর ৫০ বছর বিবাহিত জীবন তার সঙ্গে কাটানোর পর তার স্ত্রী হানা পরলোকগমন করেন। তারপর নিঃসঙ্গ হয়ে তিনি এক বছরের চেয়ে বেশি বাঁচেননি। তারা দু’জন তাদের উত্তরসূরি হিসেবে রেখে গেছেন এক পুত্র টম (ডরিস ওয়েলস পাপানেক) ও এক কন্যা জোয়ানকে (জোয়ান পাপানেক ওরলান্ডো)। আর আমরা তার গুণমুগ্ধ ছাত্র ও সহযোগীরা ছড়িয়ে আছি এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও যুক্তরাষ্ট্রে। জয়তু অধ্যাপক গুস্তাভ পাপানেক। লেখক : সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা
×