ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

৩২ ধারা বহাল রেখেই ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল পাস

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮

৩২ ধারা বহাল রেখেই ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল পাস

সংসদ রিপোর্টার ॥ সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠনসহ বিভিন্ন মহলের আপত্তি সত্ত্বেও বহুল আলোচিত ৩২ ধারা বহাল রেখে জাতীয় সংসদে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল-২০১৮’ পাস হয়েছে। বুধবার ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বিলটি পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। রাষ্ট্রপতি বিলটিতে অনুমোদন দিলেই তা আইন হিসেবে কার্যকর হবে। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হওয়া অধিবেশনে বিলটি পাসের আগে জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা। কিন্তু তাদের সেই প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। এছাড়া বিরোধীদলীয় সদস্যরা বিলের বিভিন্ন ধারায় সংশোধনী প্রস্তাব দিলে সেগুলোও কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। তবে বিলের ৪৩ ধারায় জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমামের আনা একটি সংশোধনী গ্রহণ করা হয়। এই সংশোধনী গৃহীত হওয়ার ফলে পরোয়ানা ব্যতিরেকে তল্লাশি, জব্দ কিংবা গ্রেফতারের ক্ষেত্রে মহাপরিচালকের কোন অনুমোদন লাগবে না। বিলটির বিরোধিতা করে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র কয়েকজন সংসদ সদস্য বলেন, গণমাধ্যমের বাক স্বাধীনতা হরণ করতে আনা এই বিলটি খুবই উদ্বেগজনক। এটি একটি নিবর্তনমূলক আইন। স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকার ক্ষুণœ হবে। ৩২ ধারার অপপ্রয়োগের ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অনেকাংশ বৃদ্ধি পাবে। সংবিধানের মূল চেতনা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিঘœ ঘটবে। গণমাধ্যমের ভূমিকা সংকুচিত হবে, ভীতির মধ্যে থাকতে হবে। গণমাধ্যমের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করে বিলটি পাসের উদ্যোগ গ্রহণ কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। গণমাধ্যম কিংবা জনগণকে ক্ষেপিয়ে কোন কাজ করা উচিত হবে না। জবাবে মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, সংবাদপত্র দমন বা নিয়ন্ত্রণের জন্য এই আইন নয়। মতামত প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই, শুধু ডিজিটাল অপরাধ দমনে বিলটি আনা হয়েছে। কারণ ডিজিটাল অগ্রযাত্রা যেমন হচ্ছে, তেমনি ডিজিটাল অপরাধের মাত্রাও বাড়ছে। ভবিষ্যতে বিশ্বে বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ হবে না, যুদ্ধ হবে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে। আগামী দিনে ডিজিটাল প্রযুক্তি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। ছাত্র আন্দোলনের নামে, রামুতে, বগুড়াতে কী ঘটনা ঘটছিল? ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে গুজব রটিয়ে কী অবস্থার সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল? তিনি বলেন, গণমাধ্যম ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের মতামতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছি, ব্যাপক সংশোধনী এনেছি। যারা এ বিলের বিরোধিতা করছেন, তাঁরা হয়তো সংসদীয় কমিটিতে এসে কী বলেছিলেন তা বোধহয় ভুলে গেছেন। এই বিল ৫৭ ধারা বাতিল করেছে। ৩২ ধারায় গুপ্তচর বৃত্তির কথা উঠিয়ে দিয়ে অফিসিয়াল সিক্রেসি এ্যাক্ট আনা হয়েছে। আমরা লাইন বাই লাইন সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেছি, তাদের সকল মতামত নিয়ে সংশোধনী আনা হয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থেই বিলটি আনা হয়েছে। রাষ্ট্রকে আমরা বিপন্ন হতে দিতে পারি না। এই আইন বিশ্বের অনেক উন্নত দেশকে অনুসরণ করতে হবে। যেমন সবার আগে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলেছি, তেমনি বিশ্বের মধ্যে আমরাই প্রথম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেছি। বিলের ৩২ (১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি অফিসিয়াল সিক্রেসি এ্যাক্টের আওতাভুক্ত অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করতে সহায়তা করেন তাহলে তিনি অনধিক ১৪ বছরের কারাদ- বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। ৩২ (২) ধরায় বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি উপধারা-১ এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনরায় সংঘটন করেন, তাহলে যাবজ্জীবন কারাদ- বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। বিলের ২৫ ধারার (ক) উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোন তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলে জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোন ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্ত বা হেয় প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে কোন তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন, বা খ) রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণœ করার, বা বিভ্রান্তি ছড়াতে বা তদুদ্দেশ্যে অপপ্রচার বা মিথ্যা বলে জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও, কোন তথ্য সম্পূর্ণ আ আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে ওই ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হবে একটি অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি অনধিক ৩ বছরের কারাদ- বা অনধিক ৩ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়বার বা পুনরায় অপরাধের জন্য ৫ বছরের কারাদ- ও ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। বিলের ২১ ধারায় নতুন বিধান যুক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘যদি কোন ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোন প্রকার প্রপাগন্ডা ও প্রচার চালানো বা উহাতে মদদ প্রদান করেন, তাহলে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুরূপ কার্য হবে একটি অপরাধ।’ এই অপরাধের শাস্তি অনধিক ১০ বছরের কারাদ- বা অনধিক ৩ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়বার বা পুনরায় অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদ- ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপকল্প ২০২১ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মিাণের লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ও নিরাপদ ব্যববহার আবশ্যক বর্তমান বিশ্বে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে এর সুফল ভোগের পাশাপাশি অপপ্রয়োগও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে সাইবার অপরাদের মাত্রাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে বলা হয়েছে, জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও ডিজিটাল অপরাধসমূহের প্রতিকার, প্রতিরোধ, দমন, শনাক্তকরণ, তদন্ত এবং বিচারের উদ্দেশ্যে এ আইন প্রণয়ন অপরিহার্য। সাইবার তথা ডিজিটাল অপরাধের কবল থেকে রাষ্ট্র এবং জনগণের জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান এ আইনের অন্যতম লক্ষ্য। আরো বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নকে প্রকারান্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলার পুনর্জাগরণ বলা যেতে পারে। এই মহান স্বপ্নদ্রষ্টার সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে তারই যোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রূপকল্প ২০২১ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মিাণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
×