ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

বিএনপি নেতাদের বিদেশে ঝটিকা সফর

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বিএনপি নেতাদের বিদেশে ঝটিকা সফর

বিএনপি নেতাদের বিদেশে ঝটিকা সফর শেষ হয়েছে। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছেন। এই সমুদ্র যাত্রায় তারা কি পেয়ে ফিরলেন তা নিয়ে সংবাদপত্রে জল্পনা-কল্পনা পড়ছি। এই ঝটিকা সফর ছিল মহাসিন্ধুর ওপারে। মার্কিন মুল্লুকে। নেতৃত্বে ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল নিজে। সঙ্গের দুজন সম্ভবত তার সুটকেস বহন করেছেন। দলের শীর্ষস্থানীয় তেমন কেউ নন। তবে পদে ভারি। মির্জা ফখরুল দাবি করেছেন, তার ঝটিকা সফর সফল। তিনি হাসিনা সরকার সম্পর্কে অভিযোগ জানিয়ে জাতিসংঘ এবং মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট দু’য়েরই মন গলিয়ে এসেছেন। তার কথাবার্তা শুনে মনে হয়। হাসিনা সরকারের আর রক্ষা নেই। তাদের মাথার উপরে ডেমোক্লিসের তরবারি ঝুলছে। শুধু মাথায় পড়ার বাকি। যুগপৎ তাদের দিল্লী অভিযানও চলছিল। দিল্লীতে ঝটিকা সফরে বিএনপির হোমরা-চোমরা কেউ যাননি। কিন্তু তাদের বিশিষ্ট ‘লবিস্টরা’ কাজ করছেন। লন্ডনে তারেক রহমান নানা ধরনের ‘গোপন বৈঠক’ করছেন বলেও বাজারে গুজব। তবে মাঝখানে দিল্লী অভিযানে একটু বাধা পড়ে গেছে। বিএনপি ও ঢাকার সুশীল সমাজের একজন অঘোষিত লবিস্ট প্রখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার বয়সাধিক্যে মারা গেছেন। তার শূন্যস্থান পূরণ করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই-কমিশনার পিনাক রজন চক্রবর্তী। তিনি তার লেখায় হাসিনা সরকার যে আগামী নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হবে, সে ভবিষ্যদ্বাণীও করে ফেলেছেন। বিএনপির জন্য ভাগ্যের পরিহাস, এখন শোনা যাচ্ছে, ভারত সরকার নাকি বলেছেন, পিনাক বাবুর অভিমত তাদের অভিমত নয়। তাহলে কি বিএনপির দিল্লী অভিযান ব্যর্থ? মার্কিন মুল্লুকে মির্জা ফখরুলের ঝটিকা সফর সম্পর্কে নিউইর্কের একটি বাংলা সাপ্তাহিকের সাংবাদিক আমাকে ঠাট্টা করে বলেছেন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে মুসোলিনি বহু আড়ম্বর করে আফ্রিকা অভিযানে বেরিয়েছিলেন। য়্যাল আমিনের যুদ্ধে প্রচ- মরুঝড়ে তার বাহিনী মুখ থুবড়ে পড়ে। আর দাঁড়াতে পারেনি। এখন মার্কিন মুল্লুকেও বিএনপির ঝটিকা সফর মুখ থুবড়ে পড়েছে। সফল হয়নি। মির্জা ফখরুল প্রচুর অর্থ ব্যয়ে শক্তিশালী লবিস্ট নিয়োগ করেও জাতিসংঘের মহাসচিবের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। দেখা করতে পেরেছিল একজন সহকারী মহাসচিবের সঙ্গে। তিনি পদমর্যাদায় একজন আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলেরও পরে। ঢাকার একটি মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে। ‘ফখরুলের এই সফর জাতিসংঘের মহাসচিবের আমন্ত্রণে হয়েছে বলে বিএনপি নেতাদের পক্ষে থেকে দাবি করা হলেও বিশ্ব সংস্থাটির দফতরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে বিএনপির উদ্যোগেই এই বৈঠক হয়েছে।’ ‘শাক দিয়ে যে মাছ ঢাকা যায় না,’ এটা তার প্রমাণ। বিশেষ করে পচা মাছ। নিজের দেশের দুর্নাম করার জন্য যারা বিদেশে যায় তারা পেট্রিয়ট না ট্রেইটর এই প্রশ্নটির আগে মীমাংসা হওয়া উচিত। এরশাদের দশ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের সময় কি আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন বিরোধী দল, এমনকি বিএনপিও কি লবিস্ট ভাড়া করে জাতিসংঘ কিংবা মার্কিন সরকারের কাছে নালিশ জানাতে বিদেশে ছুটেছিল? তারা যাননি। তারা দেশের মাটিতে এরশাদ হঠাও বিরাট আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। এরশাদকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে এবং ২০০৬ সালে বিএনপির অপশাসনের বিরুদ্ধে নালিশ নিয়ে কেউ বিদেশে ছোটেনি। আন্দোলন ও নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়েছে। ২০০৬ সালে বিএনপির অত্যাচারে জর্জরিত জনগণের অসন্তোষের সুযোগ নিয়ে দেশের সামরিক বাহিনী হাওয়া ভবন নিয়ন্ত্রিত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটায়। বিদেশী হস্তক্ষেপ কেউ কামনা করেনি। ২০১৪ সালেও বিএনপি স্বেচ্ছায় নির্বাচনে না গিয়ে দেশের একটি সুশীল সমাজের সঙ্গে মিলে দেশে বাইরের হস্তক্ষেপ ডেকে আনতে চেয়েছে। ব্যর্থ হয়ে এই নির্বাচন ও নির্বাচিত সরকার অবৈধ বলে গত চার বছর প্রচার চালিয়েছে। তাদের প্রচারণায় দেশের মানুষ বা বিদেশের সরকারগুলোর একটিও কান দেয়নি। বরং তারা হাসিনা সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের প্রশংসা করেছে। বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের সবচাইতে বৈরী দেশ পাকিস্তানের টেলিটক শোতে বিশিষ্ট বক্তারা বলেছেন, ‘পাকিস্তান উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বহু পেছনে। পাকিস্তানের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য শেখ হাসিনার মতো একজন নেত্রী চাই।’ বাংলাদেশে ভয়াবহ মৌলবাদী সন্ত্রাস এবং রাজপথে বিএনপি-জামায়াতের পেট্রোলবোমা সন্ত্রাস দমনে আওয়ামী লীগ সরকারকে সময় বিশেষে বাহুবল প্রয়োগ করতে হয়েছে। যে কোন গণতান্ত্রিক দেশ তা করে। ভারত গণতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও নকশাল ও মাওবাদী সন্ত্রাস দমনে বছরের পর বছর ধরে যে শক্তি প্রয়োগ করে চলেছে, বাংলাদেশ ততটা করেনি। তথাপি এই শক্তি প্রয়োগে বাড়াবাড়ি হয়ে থাকতে পারে, তার জন্য প্রতিবাদ ও আন্দোলনের পথ তো খোলা। এরশাদের আমলে গণআন্দোলন দমেন বেপরোয়া লাঠি বন্দুক চালানো হয়েছে। বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার করা হয়েছে। হাসিনা ও খালেদাকে নজরবন্দী রাখা হয়েছে। পিঠে পোস্টা-বাঁধা নিরস্ত্র নিরীহ নূর হোসেনকে হত্যা করা হয়েছে, সরকার বিরোধী আন্দোলন স্তব্ধ করার জন্য নির্মম দমননীতি চালানো হয়েছে। তাতে আন্দোলন থামেনি। আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছে। নেতারা মাঠ ছেড়ে পালাননি। মাঠ ছেড়ে পালিয়ে বিদেশ গিয়ে বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দেননি। বর্তমানে আওয়ামী লীগ শাসনে জিয়া, এরশাদ কিংবা বিএনপি-জামায়াত আমলের মতো নারী ধর্ষণ থেকে একই ধরনের গণনির্যাতন চলছে বললে সত্যের অপলাপ করা হবে। তবু বিরোধী দল বিএনপি এবং ড. কামাল হোসেন ও ডাঃ বি চৌধুরীর যুক্তফ্রন্ট যদি মনে করে যে, এই শাসনেও গণনির্যাতন চলছে, বিরোধী দলকে পীড়ন করা হচ্ছে, তাহলে তারা বিদেশে ধর্ণা দিয়ে নিজেদের নাক না কেটে দেশে আন্দোলনে নামতে পারেন, সরকার বাধা দিলে আর আন্দোলনের পেছনে জনসমর্থন থাকলে তা তো আরও ফুলে ফেঁপে ওঠে সরকারের সিংহাসন কাঁপিয়ে দেয়ার কথা। বিএনপি সেই আন্দোলন সেপ্টেম্বরে শুরু করবে ঘোষণা দিয়ে ছিলেন। সেই আন্দোলন কই? কামাল হোসেন সাহেবেরা ৫ দফা কর্মসূচী দিয়ে আন্দোলনে নামবেন বলেছিলেন। তারা কর্মসূচী দিয়েছেন। সেই কর্মসূচী ভিত্তিক আন্দোলন কই? মুরগি ডিমে তা দিচ্ছে, বাচ্চা কই? সন্দেহ নেই জনসমর্থনের অভাবেই তারা আন্দোলন করতে পারছেন না, স্কুলছাত্রদের অরাজনৈতিক আন্দোলন হাইজ্যাক করে তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধি করবেন ভেবেছিলেন। তাও ব্যর্থ হয়েছেন। সুশীল সমাজের রেহমান সোবহান সম্প্রতি তার এক প্রবন্ধে লিখেছেন ‘শিশুরা (স্কুলছাত্ররা) আমাদের পথ দেখিয়েছে।’ ভাল কথা। সে পথও তারা অনুসরণ করতে পারছেন না কেন? আসল কথা তাদের পেছনে জনসমর্থন নেই। তাই একদিকে আন্দোলনে নামার অসার হুঙ্কার এবং অন্যদিকে বিদেশে গিয়ে বিদেশীদের কাছে এই ধর্ণা দেয়া। কিন্তু এটা বিফল তপস্যা। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বিএনপি ও সুশীল সমাজ কোন শিক্ষা নেয়নি। বিদেশী শক্তি অপর কোন রাষ্ট্রে তখনই হস্তক্ষেপে উৎসাহী হয়, যখন সেই রাষ্ট্রে তাদের কোন বড় স্বার্থ ও অভিসন্ধি পূরণ দরকার হয়। তার বড় প্রমাণ মিয়ানমারে এখন ভয়াবহ গণহত্যা চললেও বড় দেশগুলো কার্যত নীরব এবং নিষ্ক্রিয়। তাদের স্বার্থ সেখানে ভিন্ন। এদিক থেকে বাংলাদেশের হাসিনা সরকারের সঙ্গে ভারত এবং পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিগুলোর এখন মৈত্রী ও সহযোগিতার সম্পর্ক। তারা এদেশের রাজনীতি কেবল বিএনপি বা সুশীল সমাজের স্বার্থে স্থিতিহীন করতে চাইবে কেন? এটা ১৯৭৫ সাল নয়। বিশ্ব পরিস্থিতিরও আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এখন অতীতের আওয়ামী লীগের খোন্দকার মোশতাকের ভূমিকায় কেউ যদি অভিনয় করতে চান তিনি সফল হবেন না। তার যতই আন্তর্জাতিক খ্যাতি-প্রতিপত্তি থাকুক। বিএনপি যদি টিকে থাকতে চায়, এমনকি আবার ক্ষমতায় যেতে চায়, তাহলে কোন বাহানা না করে তাদের নির্বাচনী রাজনীতিতে নামা উচিত। জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে সরকারবিরোধী তৎপরতা চালানো উচিত। জামায়াতের সঙ্গে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য সব সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিত। তা না করে বিদেশে গিয়ে বার বার ধর্ণা দিয়ে কোন লাভ হবে না। আর সুশীল সমাজের তথাকথিত যুক্তফ্রন্টও তাদের নির্বাচন জয়ে কোন সাহায্য জোগাতে পারবে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই সুশীল সমাজ এখন সিন্দবাদের দৈত্যের মতো একচোখা। লন্ডন, ১৮ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার, ২০১৮।
×