ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মিলু শামস

পণ্যের নাম গণতন্ত্র

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮

পণ্যের নাম গণতন্ত্র

সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে এলে ‘গণতন্ত্র’ ‘নির্বাচন প্রক্রিয়া’ ইত্যাদি নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা গবেষণায় সরব হয় দেশীয় রাজনৈতিক অঙ্গন। এতে আর কিছু না হোক নির্বাচনের একটা আবহ তৈরি হয়। এসবের আসল উদ্দেশ্যও সময় তাই। কেননা বর্তমান বিশ্বে ‘গণতন্ত্র’ নিজেই পণ্য। এতে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হল কি হল না তাতে কিছু আসে যায় না। কারণ গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত হয় বিশ্ব পুঁজি প্রবাহের নিয়ন্ত্রকদের খেয়াল মতো। যার শীর্ষে রয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানি ও কর্পোরেশনগুলো। জেনারেল মটরস, ওয়ালমার্ট, এক্সন-মবিল, ফোর্ড ডাইমলার-ক্রাইসলার ইত্যাদির মতো বহুজাতিক কোম্পানি ও কর্পোরেশনের মুনাফা নিশ্চিতের স্বার্থে ব্যবহার হয় ‘গণতন্ত্র’ নামের শাসন ব্যবস্থা। এসব কোম্পানি ও কর্পোরেশনের সামগ্রিক বিক্রি পৃথিবীর এক শ’ বিরাশিটি দেশের জিডিপির চেয়ে বেশি। আর মাইক্রোসফট, কোকা-কোলা এবং আইবিএম কোম্পানির বার্ষিক বিক্রি তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশের সম্মিলিত জিডিপি ছাড়িয়ে যায়। সুতরাং এদের ক্ষমতা সম্পর্কে সহজেই ধারণা করা যায়। এদের কাছে অন্য সব কিছুর মতো গণতন্ত্রও একটি পণ্য। এ পণ্য বিক্রেতারা সবচেয়ে বেশি মনোযোগী পুঁজির পুঞ্জিভবনের প্রান্তের দেশগুলোয়। বিশেষ করে যেসব দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। এসব দেশ নানা আইন ও চুক্তিতে জড়িয়ে নিজেদের সম্পদ ওসব কোম্পানির হাতে নামমাত্র মূল্যে তুলে দেয়। বৃহৎ পুঁজিকে সার্ভিস দিতে যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুত সরবরাহ, আর্থিক লেনদেনের আধুনিকায়ন ইত্যাদি অবকাঠামোগত উন্নয়নে মনোযোগী হয়। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাটে স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে আছে মার্কিন কর্পোরেশনগুলো। মার্কিন গবেষক হাওয়ার্ড জিমের দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের শতকরা ষাট ভাগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেশনগুলো নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। গত শতকের আশির দশকের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় বাজার সম্প্রসারণ ও প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের জন্য শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা হিসেবে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। আন্তর্জাতিক পুঁজির চরিত্র বদলের সঙ্গে এরপর ধীরে ধীরে আমদানি হয় গণতন্ত্র। কেননা গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে লুটপাট ও দখলদারিত্ব ভদ্রস্থ গ্রহণযোগ্যতা পায়। উনিশ শ’ একানব্বই সালে গ্যাট চুক্তি থেকে শুরু করে দু’হাজার তেরোর টিক্্ফাÑ সব চুক্তি সই হয়েছে গণতান্ত্রিক সরকারের সময়। গ্যাট চুক্তির মধ্য দিয়ে দেশের তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ তুলে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল কেন্দ্রের বৃহৎ কর্পোরেট পুঁজির হাতে। স্বাস্থ্যনীতি, শিক্ষা, শিল্প ও কৃষিনীতির পুরোপুরি বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। এগুলোর প্রতিটি এখন বিক্রয়যোগ্য একেকটি পণ্য। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্য, বাসস্থানÑপ্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার হলেও এগুলো চড়া দামে বিক্রি হয় বলে দেশের বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠী এ থেকে প্রায় বঞ্চিত। দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা দু’হাজার আট-এ বিশ্বে গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে জরিপ চালিয়েছিল। তাতে দেখা যায়, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ গণতন্ত্রের নামে এখনও কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থায় বাস করেন। অথচ সংসদীয় গণতন্ত্র বা বহুদলীয় গণতন্ত্র পরিচালিত হয় এই জনগণের নামে। তাদের নামে নির্বাচন হয়। সংসদ বসে, উন্নয়নের নানা পরিসংখ্যানের প্রজেকশন হয়। অথচ প্রাকৃতিক যে সম্পদের মালিক জনগণ তা যখন বিভিন্ন চুক্তির নামে বহুজাতিক কর্পোরেশনের হাতে চলে যায় জনগণ তখন কিছুই টের পায় না। দেশে এ পর্যন্ত যতগুলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তার কোনটাই সংসদের মাধ্যমে হয়নি। দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রক্রিয়া নির্ধারণে এখন সংসদের তেমন কোন ভূমিকা নেই। এ দায়িত্ব চলে গেছে পুঁজিবাদী বিশ্ব প্রক্রিয়ার কেন্দ্রের কর্পোরেট পুঁজির হাতে। তাদের দরকার এমন শাসন ব্যবস্থা যা প্রান্তের দেশগুলোর পুঁজির প্রবাহ ও উদ্বৃত্তের প্রবাহ প্রাপ্তি নিরাপদ রাখতে পারে, জনগণের অসন্তোষ বা ক্রোধ থেকে ব্যবস্থাটি রক্ষা করে চড়া মুনাফা ফেরত নিশ্চিত করতে পারে। তাই তাদের জন্য সহায়ক গণতন্ত্রকেই তারা বাংলাদেশের মতো দেশে চালান করে। আর তাই নিয়ে এখানকার রাষ্ট্র পরিচালনার গণতান্ত্রিক খেলোয়াড়দের কাড়াকাড়ি, লাফালাফি। এই হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দেশের গণতন্ত্রের পেছনের সরল অঙ্ক। বাংলাদেশের রয়েছে বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ। স্বাভাবিক কারণেই বহুজাতিক কর্পোরেট পুঁজির এ ভূখ- নিয়ে নানা ধরনের হিসাব-নিকাশ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতি বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের যে কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে সেখানে ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের অবস্থান তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের প্রতিনিধি ও বিভিন্ন দেশের দূতদের আনাগোনা এবং ভালমানুষী বিবৃতির পেছনে একই কারণ কাজ করে। এরা তখন ভীষণ উদ্বিগ্ন ও তৎপর। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও ভূ-রাজনীতি বিষয়ে অভিজ্ঞরা মনে করেন, অর্থনীতিসহ এ অঞ্চলের সার্বিক অগ্রগতির স্বার্থে স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায় প্রতিবেশী দেশগুলো। কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির ব্যাপ্তি ওসব দেশেও বিস্তৃত হয়। অস্থিতিশীলতার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি এর কম-বেশি বিরূপ প্রভাব পড়ে ভারত ও চীনসহ এ অঞ্চলের সার্বিক অগ্রগতির ওপর। তারা বলছেন, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আগামী নির্বাচন নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং এ অঞ্চলের রাষ্ট্রদূত কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বক্তব্য-মন্তব্য গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, আঞ্চলিক অগ্রগতির জন্য তারা স্থিতিশীলতাকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশে যে মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে তাও তারা পর্যবেক্ষণ করছেন। এমন কি নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে বাংলাদেশের সংবিধানে বহাল ব্যবস্থা থাকলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে, নাকি এ ব্যবস্থা পরিবর্তন হলে স্থিতিশীলতা থাকবে তাও প্রতিবেশী দেশগুলোর বিবেচনায় রয়েছে। সংলাপ, অবাধ, নিরপেক্ষÑ সুষ্ঠু-নির্বাচন প্রসঙ্গে উচ্চারিত এসব শব্দ আসলেই কী কোন তাৎপর্য বহন করে? অথবা এসব শব্দের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের আদৌ কোন সম্পর্ক আছে কি? এ নিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে তর্কের তুফান তোলা মানে আসল সমস্যা আড়ালে রাখার চেষ্টা। সামরিক শাসনের বদলে কর্পোরেট প্রভুরা এখন গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণ বেশি পছন্দ করছে। সুতরাং গণতন্ত্র রক্ষার জন্য বহুমাত্রিক খেলাধুলা পৃথিবীর নানা দেশেই চলছে। বাংলাদেশে নির্বাচনকে উপলক্ষ করে সে খেলা ক্রমশ জমে উঠছে।
×