ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কোটা উঠে যাচ্ছে ॥ ১ম ও ২য় শ্রেণীর চাকরির ক্ষেত্রে সুপারিশ

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮

কোটা উঠে যাচ্ছে ॥ ১ম ও ২য় শ্রেণীর চাকরির ক্ষেত্রে সুপারিশ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সরকারী চাকরির নবম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেড পর্যন্ত অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদে কোন ধরনের কোটা না রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুপারিশ করেছে কোটা পর্যালোচনায় গঠিত ‘উচ্চ পর্যায়ের কমিটি’। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর পদে নিয়োগে চলমান কোটা তুলে দেয়ার সুপারিশ করে সরকারের এ কমিটি বলেছে, এ ক্ষেত্রে নিয়োগ হবে কেবল মেধার ভিত্তিতে। ত্রয়োদশ থেকে বিংশতম গ্রেডে নিয়োগের ক্ষেত্রে আগের নিয়মই বহাল থাকবে। সরকারের এমন উদ্যোগে কোটা সংস্কার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা সঙ্কটের ইতিবাচক সমাধান হতে চলেছে। এদিকে সরকারের এ কমিটির সুপারিশকে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন আন্দোলনকারীরা। কোটা সংস্কার নিয়ে গত কয়েক মাস দেশে আন্দোলনের নামে পানি কম ঘোলা করা হয়নি। কোটা সংস্কারে সরকার প্রথম থেকেই ইতিবাচক অবস্থান দেখালেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে এক পর্যায়ে নেমে পড়ে সরকারবিরোধীরা। দেশজুড়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্রিয় হয়ে পড়ে জামায়াত-শিবিরসহ উগ্রবাদী গোষ্ঠী। তাদের লক্ষ্য ছিল কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে পুঁজি করে বড় ধরনের নাশকতার মাধ্যমে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা। কোটার যৌক্তিক সংস্কারে শুরু থেকেই সরকার ইতিবাচক অবস্থানে থাকলেও বিশেষ একটি গোষ্ঠী ছিল সুযোগের অপেক্ষায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১১ এপ্রিল সংসদে বলেন, সরকারী চাকরিতে কোটা পদ্ধতিই আর রাখা হবে না। তবে পরে সংসদে তিনি বলেন, কোটা পদ্ধতি থাকবে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ রাখতে হাইকোর্টের রায় আছে। এরপর সরকারী চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি পর্যালোচনা করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলমের নেতৃত্বে গত ২ জুন একটি কমিটি করে সরকার। কোটা পর্যালোচনা কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেনÑ লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ শহিদুল হক, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়েজ আহম্মদ, অর্থ বিভাগের সচিব মুসলিম চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব অপরূপ চৌধুরী, সরকারী কর্ম কমিশনের সচিব আকতারী মমতাজ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব সাজ্জাদুল হাসান। সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কোটা বাতিল করে কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম। মন্ত্রিসভার বৈঠক নিয়ে সচিবালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, কোটা নিয়ে রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রীর কাছে আজ সাবমিট করে দিয়েছি। আমাদের ফাইন্ডিংস হলো নবম থেকে ত্রয়োদশতম গ্রেড পর্যন্ত যে প্রাথমিক নিয়োগ হয়, সে নিয়োগে কোন কোটা থাকবে না, কোন কোটাই থাকবে না। কমিটির এই সুপারিশ প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পেলে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে। মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেলে আগামী মাসেই তা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হতে পারে। বর্তমানে সরকারী চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষিত। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধী এক শতাংশ। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ত্রয়োদশ থেকে বিংশতম গ্রেডে নিয়োগের ক্ষেত্রে আগের নিয়মই বহাল থাকবে। সরকারী কর্ম কমিশন ইতোমধ্যে ৪০তম বিসিএসের যে বিজ্ঞাপন দিয়েছে, তার ওপর এই সুপারিশের কোন প্রভাব পড়বে কি নাÑ এই প্রশ্নে সচিব বলেন, না। কারণ সেখানে বলা আছে সরকার যদি ভিন্নরূপ সিদ্ধান্ত নেয়Ñ সে অনুযায়ী কোটা নির্ধারিত হবে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কিংবা প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা অন্য কোনভাবে রাখা যায় কি না তা ভাবা হবে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শফিউল আলম বলেন, তারা যাচাই-বাছাই করে দেখেছেন, এখন কোটা ‘না হলেও চলতে পারে’। আদালতের একটি নির্দেশনা আছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে। এ বিষয়ে আমরা এক্সামিন করেছি। আইন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকার পলিসি ম্যাটার হিসেবে যেটা সিদ্ধান্ত দেবে সেটা ঠিক আছে। ‘আমরা আইন বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছি, তারা বলেছেন যে, এটা যেহেতু গবর্নমেন্ট পলিসির ডিসিশন, এটা আদালতের রায়কে স্পর্শ করবে না। কোন সমস্যা নেই। আরেক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সরকারী চাকরিতে ঢোকার বয়স ৩০ বছর থেকে বাড়ানোর কোন সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। বর্তমানে সরকারী চাকরিতে বেতনের ক্ষেত্রে ২০টি গ্রেড রয়েছে। বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্তরা নবম গ্রেডে বেতন পান। এই গ্রেডে নিয়োগপ্রাপ্তরা পদোন্নতির মাধ্যমে সপ্তম থেকে প্রথম গ্রেড পর্যন্ত উন্নীত হন। কার্যপরিধিতে না থাকায় ১৪তম থেকে ২০তম গ্রেডে (আগের তৃতীয় ও চতুর্থ) নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা নিয়ে কোন সুপারিশ করেনি কমিটি। এর আগে শফিউল আলম গত ১৩ আগস্ট সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তারা সরকারী চাকরির কোটা ‘যতটা সম্ভব’ তুলে দিয়ে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের সুপারিশ করবেন। আর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য কোটার বিষয়ে যেহেতু আদালতের রায় আছে, সেহেতু এ বিষয়ে সুপ্রীম কোর্টের মতামত নেয়া হবে। সে অনুযায়ী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মতামত চাওয়া হলে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তার মতামত সরকারকে জানান। মন্ত্রিপরিষদ সচিব সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের ফাইন্ডিংস অনেক ছোট, তবে রিপোর্ট অনেক বড়, আমরা আইন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েছি। তারা বলেছে এটি সরকারের পলিসি ডিসিশন, কোন সমস্যা নেই। এদিকে কোটা বাতিলের সুপারিশকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন আন্দোলনকারীরা। তবে তারা দ্রুত প্রজ্ঞাপন চান ও মামলা থেকে তাদের সদস্যদের প্রত্যাহার ও হামলাকারীদের বিচারও চান। প্রজ্ঞাপন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দেন আন্দোলনকারীরা। সরকারের কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে বিকেল ৫টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সংবাদ সম্মেলন করেন আন্দোলনকারীরা। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন বলেন, মন্ত্রিপরিষদ সচিব নবম গ্রেড থেকে তেরোতম গ্রেড পর্যন্ত কোটা বাতিলের যে প্রতিবেদন আজকে জমা দিয়েছেন সেটাকে আমরা ইতিবাচকভাবে নিচ্ছি। পাশাপাশি আমরা দাবি জানাচ্ছি বাকি গ্রেডগুলোতে যৌক্তিকভাবে কোটার সহনীয় সংস্কার করা হোক। কোটা সংস্কার প্রজ্ঞাপন আকারে জারি না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলমান থাকবে বলে ঘোষণা দেন তিনি। এর অংশ হিসেবে আগামীকাল (আজ মঙ্গলবার) বেলা ১১টায় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের হবে। হাসান আল মামুন আরও জানান, আমাদের যেসব সদস্যদের গ্রেফতার করে মামলার সঙ্গে জড়ানো হয়েছে তাদের মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। এ ছাড়া আমাদের ওপর হামলাকারীদের বিচার হতে হবে। তাদের দাবি মানতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক ফারুক হোসেন, বিন ইয়ামিন মোল্লা, আতাউল্লাহ, রাতুল সরকার উপস্থিত ছিলেন। ফারুক হোসেন বলেন, আমরা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছি, যেদিন আমাদের তিন দফা দাবি বাস্তবায়ন হবে, সেদিনই আমরা আন্দোলন থেকে সরে যাব। এ সময় তিনি তিন দফা দাবি তুলে ধরেন। সেগুলো হলো- ভিত্তিহীন, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক সব মামলা প্রত্যাহার করা; হামলাকারীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা এবং পাঁচ দফার আলোকে কোটা পদ্ধতির যৌক্তিক সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন দেয়া। এ সময় তিনি প্রজ্ঞাপনের দাবিতে সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজগুলোতে বিক্ষোভ মিছিলের ঘোষণা দেন। এদিকে সংগঠনের কয়েক নেতাকর্মী এমন কৌশলী বক্তব্য দিলেও আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীরা সরকারকে স্বাগত জানিয়েছেন। ইতোমধ্যেই ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন অনেকে। ব্যবসায় অনুষদের শিক্ষার্থী রাসেল লিখেছেন, ‘অনেক হয়েছে। আমার কথা হচ্ছে কোন সরকার নির্বাচনের আগে বা পরে কোটা সংস্কার করেছে? আওয়ামী লীগ সরকার এটা করেছে। তাদের ঝুলিতে আরও একটি ভাল কাজ যোগ হলো অভিনন্দন। এখনও আন্দোলন ঝুলিয়ে কেউ রাখলে ফল শিক্ষার্থীদের জন্য খারাপও হতে পারে।’ দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী রওনক লিখেছেন, ‘আমার মতে খুব ভাল প্রস্তাব। তবে শুধু মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য সুবিধা দেয়া জরুরী। কিভাবে তা করা যায় সরকারের তা দেখা প্রয়োজন।’ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী কেয়া আক্তার বলেন, কোটা নিয়ে যারা সরকাররের বিরুদ্ধেই কেবল স্লোগান তুলেছেন। তারা এখন কি বলবেন? সরকার বিরোধী রাজনীতিটাতো আর করা গেল না!
×