ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ক্রিকেট ইতিহাসে ইনজুরি নিয়েও ব্যাটিং করার বিরল নজির, মাঠে ফিরতে অন্তত ২/৩ মাস সময় লাগবে

তামিমের বীরত্বই বড় অনুপ্রেরণা টাইগারদের

প্রকাশিত: ০৬:৪১, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 তামিমের বীরত্বই বড় অনুপ্রেরণা টাইগারদের

মোঃ মামুন রশীদ ॥ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়ের নায়ক মুশফিকুর রহীম, তবে আশ্চর্য বীরত্ব দেখিয়েছেন এক আহত সেনানী। সেই অভূতপূর্ব বীর তামিম ইকবাল খান। যে কোন লড়াইয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এগিয়ে যেতে অভাবনীয় কোন চমক দেখাতে হয়, সেটি করেছেন তামিম। বাংলাদেশ ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই হাতের কব্জিতে আঘাত পাওয়ার পর সরাসরি হাসপাতালে গিয়ে ব্যান্ডেজ করে এসেছিলেন। আবারও উইকেটে নামা দূরের কথা, প্রাথমিকভাবে জানা গিয়েছিল অন্তত ৬ সপ্তাহ মাঠের বাইরে থাকতে হবে তাকে। কিন্তু নবম উইকেট পতনের পর আবারও মাঠে নেমে এক হাতে ব্যাটিং করে প্রতিপক্ষকে বিমূঢ় করে দেন তিনি। দলকে ভাল অবস্থানে নিয়ে যেতে, নিখাঁদ দেশপ্রেমের অনন্য নজির স্থাপন করে এখন দেশবিদেশে আলোচিত তিনি। কারণ কোনভাবে আরেকটি আঘাত পেলেই ক্যারিয়ার পুরোপুরি শেষ হয়ে যেত। ৪ বলে ২ রান হয়তো পরবর্তীতে স্কোরকার্ড দেখলে তার এই উৎসর্গ উপলব্ধি করা যাবে না। কিন্তু শনিবার দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপের উদ্বোধনী ম্যাচ যারা দেখেছেন তারাই তামিমকে বীর ঘোষণা করেছেন। তবে মারাত্মক ঘটনা ক্রিকেট ইতিহাসে আরও ছিল। তবে এক হাতেই ব্যাটিং করার এমন নজির আর নেই। এটিই এখন এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দলের জন্য বড় অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) সূত্রে জানা গেছে অন্তত ২/৩ মাস মাঠের বাইরে থাকতে হবে তামিমকে। ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারে সুরাঙ্গা লাকমলের শর্ট অব লেন্থের বলে পুল করতে গিয়ে বাঁ হাতের তর্জনির গোড়ায় যে আঘাত পেয়েছিলেন তারপর তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। স্ক্যানে তার তর্জনির আশেপাশে বেশ কয়েকটি চিড় ধরা পড়ে এবং একটি হাড়ও সামান্য স্থানচ্যুত হয়েছে। অবশ্য অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা জানিয়েছেন আরও ২/৩ দিন অপেক্ষা করে কয়েকটি স্ক্যান করিয়ে তামিমের চূড়ান্ত অবস্থা জানানো হবে। এ বিষয়ে বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের চেয়ারম্যান আকরাম খান জানিয়েছেন, অন্তত ২/৩ মাসের জন্য ক্রিকেটের বাইরে থাকতে হবে তামিমকে। এশিয়া কাপে তো দর্শক হয়েই গেছেন, ঘরের মাটিতে আগামী মাসে জিম্বাবুইয়ে এবং নবেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও খেলা হবে না তার। কিন্তু বাংলাদেশ দলের অবস্থা খুবই নাজুক ছিল লঙ্কানদের বিপক্ষে লাসিথ মালিঙ্গার পেস তোপে। পুরোটা সময় একাই বুক চিতিয়ে লড়েছেন মুশফিক। মাঝে দীর্ঘ সময় তাকে শুধু মোহাম্মদ মিঠুন সঙ্গ দিয়েছেন। ব্যান্ডেজ বাঁধা হাত স্লিংয়ে ঝুলিয়ে সেটা দর্শক হয়ে দেখছিলেন তামিম। তবে অধিনায়ক মাশরাফি জানিয়েছিলেন, যদি মুশফিক স্ট্রাইকে থাকেন সেক্ষেত্রে নন-স্ট্রাইকিংয়ে নামানো হবে তাকে শুধু সঙ্গ দেয়ার জন্য। কিন্তু ৪৭তম ওভারের পঞ্চম বলে মুস্তাফিজুর রহমান নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হয়ে যাওয়ার পর এক হাতেই ব্যাটিং করতে নেমে যান তামিম, মোকাবেলা করেন সেই লাকমলের ওভারের শেষ বলটি। তার মোকাবেলা করা একটি বলের কারণে ৩২ রান হয়েছে বাংলাদেশের। হতবিহ্বল শ্রীলঙ্কার পরিকল্পনা ওলট-পালট হয়ে যাওয়ার সুযোগ নিয়ে মুশফিক ব্যাট হাতে ঝলসে ওঠেন, ১৫ বলে তুলে নেন ৩২ রান। এক হাতে একজন পেসারকে মোকাবেলা করে তামিম পুরো দলকেই অনুপ্রাণিত করেছেন। সেই অনুপ্রেরণা এখন পুরো এশিয়া কাপেই দলের সঙ্গে থাকবে। তবে ক্রিকেট ইতিহাসে এমন ঘটনা আগেও দেখা গেছে। ১৯৮৪ সালে লিডসে ম্যালকম মার্শাল এক হাতে আঘাত পেয়ে অন্যহাতে ব্যাটিং করেন। তারও আগে এডি পেইন্টার টনসিল নিয়ে ব্রিসবেনের হাসপাতাল থেকে গ্যাবায় গিয়ে ৮৩ রানের ইনিংস খেলে দলকে লিড এনে দেন। এরপর আবার হাসপাতালে ভর্তি হন। ফিরে এসে আবার জয়সূচক রান করেন তিনি। অসি ব্যাটসম্যান রিক ম্যাককাস্কার বব উইলিসের বলে চোয়াল ভেঙ্গে রক্তাক্ত হয়েছিলেন, ঘাড়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে তিনিই পরে ১০ নম্বরে ব্যাট হাতে নেমেছিলেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মারভিন ডিলনের বাউন্সারে ভারতের অনীল কুম্বলের চোয়াল ভেঙ্গে গিয়েছিল। কিন্তু মাথা থেকে ঘাড় বিস্তৃত ব্যান্ডেজ নিয়েই বোলিং করে ব্রায়ান লারার উইকেট নেন। ২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রায়েম স্মিথ ইনজুরি আক্রান্ত হন অসি পেসার মিচেল জনসনের বলে। সিডনিতে এরপরও তিনি ব্যাটিংয়ে নেমে যান। ১৯৮৬ সালে ওয়াসিম আকরাম যেন অর্ধশতক করতে পারেন সে জন্য ডানহাতি সেলিম মালিক ইনজুরির কারণে বাঁহাতি ব্যাটসম্যান হিসেবে ব্যাটিং করেন। তামিম তাদের চেয়েও ভিন্ন কীর্তি গড়েছেন শুধু এক হাতে ব্যাট ধরে। সে জন্য তামিম ব্যাট হাতে নামার পর শুধু প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কাই নয়, বিস্মিত হয়েছেন ধারাভাষ্যকার, সাবেক ক্রিকেটার এবং বিশ্বব্যাপী ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট সকলেই। এ বিষয়ে লঙ্কান অধিনায়ক এ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস ম্যাচ শেষে বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম শেষ হয়ে গেছে ব্যাটিং, কিন্তু তামিম নেমে আমাদের অবাক করেছে।’ ধারাভাষ্যকারেরাও সে সময় তাকে প্রকৃত দেশপ্রেমিক বলে অভিহিত করেন। আর অনেক ক্রিকেট তারকাই তাকে নিয়ে টুইটারে লিখেছেন যে তামিম যা করেছেন তা যে কোন দেশের জন্যই গর্বের। তবে অনেকে এটাকে আত্মঘাতীও বলেছেন। এর মধ্যে একজন লিখেছেন, ‘এটি তো ফাইনাল নয়! এমন পরিস্থিতিতে ব্যাট করতে নামা অবশ্যই ক্যারিয়ারের জন্য হুমকি।’ তবে তামিম নিজ সিদ্ধান্তেই নেমেছেন। ৪ বলে ২ রান করেছেন, কিন্তু সেটিই অনেক বড় অনুপ্রেরণা হয়েছে বাংলাদেশের জন্য। ১৫০ বলে ১৪৪ রানের অতিমানবীয় ইনিংস খেলা মুশফিকও এ বিষয়ে পরে বলেন, ‘তামিমকে দেখে খুবই বিস্মিত হয়েছি এবং আরও বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছি। তখনই উপলব্ধি করি তারজন্য এবং দেশের জন্য আমার কিছু করতে হবে।’ অধিনায়ক মাশরাফিও বলেন, ‘সবাই এ জন্য তামিমকে আজীবন মনে রাখবে। তাকে টুপি খোলা স্যালুট।’
×