ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এবার সিটওয়ে থেকে রোহিঙ্গাদের সরে যেতে মাইকিং

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

  এবার সিটওয়ে থেকে রোহিঙ্গাদের সরে যেতে মাইকিং

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের সুচি সরকার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী এবং আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের তকমা ঝুলিয়ে রেখে পূর্বে প্রণীত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাণিজ্যিক স্বার্থ বাস্তবায়ন কাজ শুরু করেছে। অগণন রোহিঙ্গার রক্তভেজা মাটিতে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে নেপিডো। একদিকে প্রায় ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। অপরদিকে, সেখানে গণহত্যার শিকার হয়েছে অনেকেই। এসবের পরেও যেসব রোহিঙ্গা এখন সেখানে রয়েছে তাদেরকে অন্যত্র সরে যাওয়ার জন্য গত সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে মাইকিং। সীমান্তের ওপারের সূত্রগুলো বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। সূত্র জানিয়েছে, অর্থনীতিতে জায়ান্ট হিসেবে পরিচিতি লাভকারী চীন গত সপ্তাহে নেপিডোতে উত্তর রাখাইনে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এছাড়া কিয়াতপিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে চায়না ইন্টারন্যাশনাল ট্রাস্ট এ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশনের (সিআইটিআইসি) নেতৃত্বে চীনের ছয়টি শিল্প গ্রুপ অব কোম্পানিজ কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। এই কনসোর্টিয়ামের অর্থায়নে নির্মিত প্রতিষ্ঠা পাবে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর ও একটি শিল্প পার্ক। মূলত কিয়াতপিউ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের অংশ হিসেবে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হবে। মিয়ানমারের বাণিজ্যমন্ত্রী থান মিয়েন্ট ইতোমধ্যে সেখানকার গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, চীনের বেল্ট এ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের আওতায় অর্থনৈতিক করিডরের অংশ হিসেবে কিয়াতপিউয়ের গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হবে। এতে দুই দেশের জন্যই লাভ ছাড়াও সমুদ্রবন্দরটির কল্যাণে উন্নত হবে রাখাইন রাজ্য। সৃষ্টি হবে কর্মসংস্থান। সে দেশের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রাখবে এ গভীর সমুদ্রবন্দর। গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের আওতায় রয়েছে মাদেই আইল্যান্ড টার্মিনাল ও ইয়ানবাই আইল্যান্ড টার্মিনাল। এতে জাহাজ নোঙ্গরের সুবিধাসম্পন্ন মোট ১০টি বাথ থাকবে। শিল্প পার্ক ও গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে রাস্তা ও সেতু নির্মাণের কাজও রয়েছে এ প্রকল্পের আওতায়। অবস্থাদৃষ্টে এখন আর সন্দেহের কোন অবকাশ নেই যে, বর্তমান সিটওয়ে (সাবেক আকিয়াব বন্দর) এলাকা থেকে বাংলাদেশের বান্দরবানের ওপারের শেষ পয়েন্ট (যেখান থেকে ভারত-বাংলাদেশের বর্ডার চিহ্নিত)। সে পর্যন্ত রাখাইন রাজ্যের বিস্তৃতি। উত্তর থেকে দক্ষিণে তুমব্রু পর্যন্ত মূলত রোহিঙ্গাদের জনবসতি। মিয়ানমারে মোট প্রদেশ রয়েছে ১৪। তন্মধ্যে রাখাইন একটি (যার পূর্ব নাম ছিল আরাকান)। এ রাজ্যে রয়েছে রোহিঙ্গাসহ ৯ নৃ- জাতি গোষ্ঠীর স্থায়ী বসবাস। এ জাতিগোষ্ঠী হচ্ছে রোহিঙ্গা, রাখাইন, বামার, চীন, ক্যাইয়িন, কাচিন, মুন, ক্যাইয়া ও শান (সনাতনী)। পুরো মিয়ানমার জুড়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ২০ লক্ষাধিক। বর্তমানে নতুন পুরনো মিলিয়ে ১২ লক্ষাধিক বাংলাদেশে আশ্রিত হয়েছে। অবশিষ্ট ৮ লক্ষাধিকের মধ্যে বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে রয়েছে ৩ লক্ষাধিক। আবার এর মধ্যে শুধু সিটওয়ে জেলার বন্দর সন্নিহিত এলাকায় রয়েছে ২ লক্ষাধিক। এখন এই দুই লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে সেখান থেকে সরে পূর্ব সিটওয়ের পাহাড় সংলগ্ন এলাকায় স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নেপিডো। আর এ কারণে এদের সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং শুরু হয়েছে। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে মংডু, বুচিদং, রাচিদংসহ বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে এখন আবার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) কঠোর অবস্থান নেয়ায় ইতোমধ্যে দুই দফায় ইঞ্জিনচালিত নৌকা বোঝাই রোহিঙ্গা পুশব্যাক হয়েছে। ওপারের সূত্রগুলো আরও জানিয়েছে, নেপিডো সরকার খুব দ্রুততার সঙ্গে সিটওয়ে সংলগ্ন এলাকায় এখনও বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সরে যেতে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। রাখাইন রাজ্য জুড়ে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কথা বহু আগেই ফাঁস হয়েছে। এখন তা দৃশ্যমান হচ্ছে। মূলত এ কারণেই রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গারা বলি হয়েছে। ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নিজেদের বাপ-দাদার ভিটেমাটি ফেলে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রিত হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের এমন কোন সংস্থা নেই যারা মিয়ানমার সরকারের এমন মানবতাবিরোধী কর্মকা-কে গণহত্যা বলে স্বীকার করেনি। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান এতে মিয়ানমার সরকার তাদের পূর্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অটল অবস্থানেই রয়েছে। সূত্র আরও জানিয়েছে, মিয়ানারের মূল এলাকার সঙ্গে সংযুক্ত প্রায় ১৭শ’ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে করিডর নির্মাণের জন্য দুদেশের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে তাতেই রোহিঙ্গাদের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেছে। বাণিজ্যিক স্বার্থে চীন রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষ নিয়ে আছে। এদিকে বিশ্লেষকদের আলোচনায় এসেছে, কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে চীনের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের আগে তা থমকে যায়। এ থমকে যাওয়ার নেপথ্যে চীনের পক্ষে মিয়ানমারের কিয়াতপিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর প্রতিষ্ঠায় অর্থ জোগান দেয়ার পরিকল্পনা হয়। যা এখন চুক্তি হয়ে পরবর্তীতে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় গেছে।
×