ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আইডিইবির উদ্ভাবনী মেলায় তরুণ আবিষ্কারকদের নানা কথা, হরেক উদ্ভাবন

ড্রাইভারের লাইসেন্স না থাকলে স্টার্ট নেবে না গাড়ি...

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

   ড্রাইভারের লাইসেন্স না থাকলে স্টার্ট নেবে না গাড়ি...

ওয়াজেদ হীরা ॥ ড্রাইভারের লাইসেন্স না থাকলে গাড়ি স্টার্ট নেবে না কিংবা মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে হেলমেট পরিধান না করলেও চালু হবে না মোটরবাইক। কোন গাড়ি যে কোন দুর্ঘটনার শিকার হলে অটোমেটিক খুদে বার্তা (এসএমএস) চলে যাবে জরুরী সেবাকেন্দ্রে। অথবা অটোমেটিক ফায়ার ইন্ডিকেটিং সিস্টেমের মাধ্যমে অগ্নিদুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাবে অফিস, কারখানা, বাসাবাড়িও। প্রযুক্তির ব্যবহারে পাওয়া যাবে এসব সুবিধা। এমন অর্ধশতরও বেশি উদ্ভাবনের তথ্য জানাচ্ছে দেশের বিভিন্ন পলিটেকনিকের তরুণ উদ্ভাবকরা। উদ্ভাবকরা অল্প খরচে নানা আবিষ্কার দিয়ে মানুষের জীবনমান আরও উন্নত এবং নিরাপদ করতে চায়। সেই সঙ্গে বিশ্ব প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে চায়। ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স (আইডিইবি) আয়োজিত তিন দিনব্যাপী ২২তম জাতীয় সম্মেলন ও ৪১তম অধিবেশন কাউন্সিলে উদ্ভাবনী মেলায় প্রযুক্তির নানা আবিষ্কার তুলে ধরা হচ্ছে। আবিষ্কারের বর্ণনা করছেন উদ্ভাবকরা। খুব অল্প খরচেই এসব সেবা পাওয়া সম্ভব বলে জানা গেছে। শনিবার গণভবনে আইডিইবির জাতীয় সম্মেলন ও কাউন্সিল অধিবেশন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানেও আইডিইবির আইসিটি সেলের তৈরি ‘মি. টিভেট’ নামে একটি রোবট প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানায়। রবিবার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনোভেশন এক্সপো-’১৮ উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ইঞ্জিনিয়ারিং ইনোভেশন এক্সপো ঘুরে দেখা গেছে, নানা ধরনের আবিষ্কার বর্ণনা দিচ্ছেন উদ্ভাবকরা। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষেরও ব্যাপক আগ্রহ এসব উদ্ভাবন নিয়ে। ঢাকা মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা নিরাপদ যানবাহন ও সড়ক সিস্টেম নামে একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। সুমাইয়া শরীফ ও ফারজানা আক্তার নামের উদ্ভাবকরা জানান, গাড়ি কোন দুর্ঘটনায় পড়লে পুলিশ, হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিসসহ সেবাকেন্দ্রগুলোতে দ্রুত এসএমএস চলে যাবে এবং দুর্ঘটনার তথ্য দেবে। এটিতে কোন মানুষের সহায়তা লাগবে না। কোন গাড়ি দুর্বৃত্তের কবলে পড়লে গাড়ির জরুরী সুইচ চেপে পুলিশের সাহায্য নেয়া যাবে। ওভারটেকিং করা যাবে না এবং গাড়িতে কোন যান্ত্রিক ত্রুটি থাকলে গাড়ি স্টার্ট নেবে না। উদ্ভাবক সুমাইয়া বলেন, অনেক সময় প্রয়োজনীয় জায়গায় দুর্ঘটনার তথ্য জানাতে অনেক সময় লেগে যায়। তাই আমরা এই প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছি। ডিভাইসের মাধ্যমে যার খরচ পড়বে ৭-৮ হাজার টাকা দিয়ে এই সেবা মিলবে বলেও জানান। এছাড়াও গ্রাফিক আর্টস ইনস্টিটিউট আবিষ্কার করেছে এমন এক পদ্ধতি যেখানে ড্রাইভারের লাইসেন্স সঠিক না হলেও গাড়ি চালু হবে না। ফলে সঠিক এবং যোগ্য ড্রাইভার নিয়োগ দেয়া যাবে বলে মনে করছেন উদ্ভাবক আলামিন খালেদ ও আনোয়ার পারভেজ। তারা এই প্রযুক্তির নাম দিয়েছে ‘ড্রাইভার চেকার’। শুধু তাই নয় এর মাধ্যমে ড্রাইভার মাদকাসক্ত কিনা তাও জানা যাবে। যানবাহন চুরি রোধ করা সম্ভব হবে বলেও তিনি জানান। এদিকে, হেলমেট পরিধান করে মোটরবাইক চালানোর কথা থাকলেও অধিকাংশই তা মানতে চায় না। কুড়িগ্রাম পলিটেকনিকের তরুণ উদ্ভাবক মুতিউর রহমান রিয়াত আবিষ্কার করেছেন ‘স্মার্ট হেলমেট’। মোটরবাইকের নির্দিষ্ট স্থানে সুরক্ষিত অবস্থায় একটি ডিটেক্টর বসানো হয়। ফলে ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বাইকে চালক হেলমেট না পরলে মোটরবাইক চালু হবে না। সেই সঙ্গে বার বার ডিসপ্লেতে হেলমেট ব্যবহার করতে বলা হবে। একই সঙ্গে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মোটরসাইকেল চালানো প্রতিহত করতে বায়ু সেন্সর ঘ্রাণ ব্যবহার করা হয়েছে। এটি পোর্টেবল সিস্টেম করানো হবে ফলে যে কেউ তার হেলমেটটি ব্যাগে গুছিয়ে রাখতে পারবে। গবেষণায় খরচ হয়েছে এক হাজার টাকা। বাণিজ্যিক পর্যায়ে আরও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলেও জানা যায়। সিদ্ধেশ্বরী বিশ^বিদ্যালয় থেকে আসা ফাহিম বলেন, আমাদের দেশে প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক বেড়েছে। আগামীতে প্রযুক্তি আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। হাতের কাছে এমন উদ্ভাবনী মেলা না এসে থাকা যায় না। উদ্ভাবনী মেলায় আসা সপ্তম শ্রেণীর আব্রাহাম বলেন, এখানে এসে নতুন নতুন অনেক তথ্য পেলাম। অনেক বিষয় জানতে পারলাম। আব্রাহামের মা আতিয়া রহমান বলেন, ছেলেকে নিয়ে এলাম নতুন আবিষ্কারের সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে। এসব প্রযুক্তিতে আমরা কত এগিয়ে যাচ্ছি এসব সবারই জানা দরকার বলেও জানান তিনি। মেলা ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ বিভিন্ন স্টলের সামনে উদ্ভাবন নিয়ে জানার চেষ্টা করছেন। উদ্ভাবকরাও এতে বিরক্ত নন। হাসিমুখে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানানো মি.টিভেটের সঙ্গে ছবি তুলছেন কেউ কেউ। এদিকে, যানজটের নগরীতে যানজটের অন্যতম কারণ যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং। তাই পার্কিং একটি সিস্টেমে আনার জন্য অটোমেটিক কার পার্কিংয়ের উদ্ভাবনে এ কথা জানানো হয় মেলায়। জানা গেছে, এই সিস্টেমের মাধ্যমে অল্প জায়গায় অনেক গাড়ি স্বল্প সময়ে পার্কিং করা যাবে। গাড়ি পার্কিংয়ে ড্রাইভারের হয়রানি নেই। পার্কিং করার সময় যে অনাকাক্সিক্ষত ক্ষতি হয় সেটিও হবে না। অনেক গাড়ি থেকে গাড়ি বের করে আনতেও সময় লাগবে না। এই সিস্টেমে অতিরিক্ত শব্দ দূষণ হবে না। অফিস-আদালত, শপিংমল, বিমানবন্দর বা রাস্তায় এই সিস্টেম চালু করতে পারলে যানজট নিরসন সম্ভব বলে মনে করছেন উদ্ভাবকরা। ডিপ্লোমা শিক্ষার্থী তানজিম বলেন, দেখুন বিশ^ কত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তিতে। আমাদেরও তাল মেলাতে হবে। জীবনমানে আরও সহজ করতে হবে, নতুনত্ব আনতে হবে। আজ প্রযুক্তির কারণে সেকেন্ডের মধ্যেই কয়েক হাজার দূরের খবর পাচ্ছি। সব মিলিয়ে এক্সপোতে এসে দেখলাম আমরাও অনেক কিছুই পারি এবং তাল মেলাচ্ছি। এছাড়াও নদীমাতৃক দেশে নৌ দুর্ঘটনা নিয়ে ‘সেভ দ্য লাইফ’ উদ্ভাবন করেছে ঢাকা পলিটেকনিকের তিন শিক্ষার্থী। দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম যোগাযোগের মাধ্যম এই নৌপথ। প্রতিবছর নৌ দুর্ঘটনায় জীবন ও সম্পদের ক্ষতি হয় বলে এই আবিষ্কার করেছেন তরুণ উদ্ভাবকরা। উদ্ভাবকরা জানান, নৌ মালিক বা কর্মচারীরা অতিরিক্ত লাভের আশায় অনেক সময়ই অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন করে। এতে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পায়। আমাদের এই প্রকল্পের মাধ্যমে নৌযান দুর্ঘটনার তথ্য দেবে। ডিভাইসের মাধ্যমে নৌযান স্বাভাবিক থাকলে সবুজ বাতি, স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বা মালামাল থাকলে হলুদ বাতি এবং এরপরেও যাত্রী বা মালামাল উঠালে লাল বাতি জ¦লবে সেই সঙ্গে বাঁশি বেজে উঠবে, ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয় এই প্রযুক্তির মাধ্যমে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ও কর্তৃপক্ষের কাছে চলে যাবে এসএমএস। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে নৌযান স্বাভাবিক অবস্থায় ডুবে গেলে তার অবস্থান নির্ণয় করা যাবে এবং চলাচল পথের গভীরতার তথ্যও পাওয়া যাবে। উদ্ভাবক মনিরুল ইসলাম, জাহানারা সরকার ও সাজ্জাদ মাহমুদ আশা করেন নৌ দুর্ঘটনা রোধে এটি অন্যতম একটি পদ্ধতি হতে পারে। দুর্ঘটনা কমানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি লঞ্চে এর ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে অসাধু লঞ্চ মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে বলেও জানান। এটি তৈরিতে দুই হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলেও তারা জানান। মেলা ঘুরে আরও অনেক উদ্ভাবন বিষয়ে জানা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে অটোমেটিক ফায়ার ইন্ডিকেটিং সিস্টেম। এর মাধ্যমে অফিস কিংবা বাসাবাড়িতে স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র হিসেবে কাজ করবে। যা পরিচালনায় কোন লোকবল প্রয়োজন হবে না। এছাড়াও, ডিজিটাল পদ্ধতিতে মুরগির ফার্ম পরিচালনা, জীবনের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে রোবট, অটোমেটিক হাউস ক্লিনার এ্যান্ড লাইফ সেফটি রোবট, ইরিগেশন সিস্টেম ইত্যাদি। অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া দেশগুলো হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, তাইওয়ান ও নেপাল। এছাড়াও অনুষ্ঠানে কয়েক লাখ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স কোর্সের ছাত্র-শিক্ষকদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। আইডিইবি কেন্দ্রীয় সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার একেএমএ হামিদ জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, প্রযুক্তিতে রাষ্ট্রকে আরও এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যেই ‘চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিশ^মানের টিভেট’ প্রতিপাদ্যে এবার জাতীয় সম্মেলন ও অধিবেশন কাউন্সিল হচ্ছে। তিন দিনের এই অনুষ্ঠানে আমাদের দুটি আন্তর্জাতিক সেমিনারসহ ১৫ অধিবেশন হবে। একই সঙ্গে বিশে^র সাতটি দেশের ১৫ বিদেশী অংশ নিচ্ছেন।
×