ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮

 মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

॥ পর্ব-পাঁচ ॥ (গতকালের পর) জনাব নুরুল কাদের বিষয়টি আর একটু ব্যাখ্যা করে বলেন, আমরা অর্থাৎ মুজিবনগর সরকার যেহেতু তৎকালীন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের ১৯৭০ সালের সার্বজনীনভাবে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে শুধু নির্বাচিত প্রতিনিধি নয়, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী দলের ও উচ্চপর্যায়ের নেতা এবং তাই স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণের সাংবিধানিক অধিকার তাদের। অন্যদিকে দ্বিতীয় পক্ষ অর্থাৎ জেনারেল ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে যারা পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের শাসনভার ১৯৭০ সালের দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের পরেও বেআইনীভাবে পরিচালনা করে যাচ্ছেন, তারা বেআইনী, অসাংবিধানিক এবং স্বৈরাচারী ও বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমে সেটাই প্রতিনিয়ত প্রতিফলিত হচ্ছে ব্যাপকভাবে। আর সেই কারণেই বিশ্বজনমত পরিপূর্ণভাবে আমাদের পক্ষে। প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের কথা উল্লেখ করে আরও যে বিষয়টি তার নিজ হাতে লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন সেটা হলো মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি যা হলো তার মতে মুজিবনগর সরকার পরিচালিত তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন যুদ্ধ এবং এই সরকার কর্তৃক নিয়োজিত প্রধান সেনাপতি ও অন্যান্য এগারোজন সেক্টর কমান্ডারের দ্বারা পরিচালিত জনযুদ্ধ। তবে তিনি এ কথাটা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন যে, আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রকৃতপক্ষে সরকারের নিয়ামক শক্তি এবং হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের বিরুদ্ধে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা ও সাহসিকতাপূর্ণ অভিযানসমূহের দৈনন্দিন ব্যাপক অগ্রগতির ফলে হানাদার বাহিনীর ক্রমাগত পশ্চাদপসরণই হলো আমাদের সত্যিকারভাবে বিজয়মুখী পদক্ষেপ। তবে তিনি সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনা কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের দৈনন্দিন হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানসমূহের বীরত্বগাথা নিয়মিতভাবে গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। তবে তিনি মুজিবনগর সরকার ও সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে জড়িত ব্যক্তিদের দৈনন্দিন রাজনৈতিক কর্মকান্ড এবং সভা-সমাবেশের খবরাখবরও গুরুত্বের সঙ্গে গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারের উপর জোর দেন। তার অভিমত মুজিবনগর সরকার ও সরকারের সঙ্গে জড়িত সকলের স্বাধীন সার্বভৌম অস্তিত্ব বজায় রেখে কার্যকরভাবে চলমান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় থাকার ওপরই নির্ভর করবে ভবিষ্যতে আমাদের সার্বিক বিজয়। . পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম চাষী মুক্তিযুদ্ধকালে আনোয়ারুল করিম চৌধুরী কলকাতার বাংলাদেশ মিশনের ফার্স্ট সেক্রিটারি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আমার এক বছরের সিনিয়র হলেও আমার সঙ্গে তার মোটামুটি ভাল সম্পর্ক ছিল। তাই মুজিবনগরে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে বিদেশে যোগাযোগের জন্য তার ঠিকানা ব্যবহার করার অনুমতি নেই। এদিকে দুদিন পরে মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা সচিব কর্তৃক আমাকে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হলে বিষয়টা তাকে জানাতে গিয়ে যখন বললাম যে, এক সপ্তাহের মধ্যে আমাকে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ক একটা কর্মসূচী প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার খসড়া তৈরি করতে হবে; তখন তিনি প্রথমে আমার কাজের জন্য একটা প্রাথমিক টিপস দেন এবং পরে তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম চাষীর সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করার পরামর্শ দেন এবং সচিব মহোদয়ের সঙ্গে আলাপ করে আমার জন্য একটা সময়ও নির্ধারণ করে দেন। নির্ধারিত সময়ে পররাষ্ট্র সচিব মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করলে তার কথাবার্তায় মনে হলো তিনি সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়টি নিয়ে বেশকিছু চিন্তা-ভাবনা করেছেন। তিনি প্রথমেই আনন্দের সঙ্গে যে খবরটি আমাকে দিলেন সেটা হলো ইতোমধ্যে দিল্লী, লন্ডন, নিউইয়র্ক এবং আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে বেশিকিছু সিনিয়র বাঙালী কূটনৈতিক সদস্য পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন এবং নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের পক্ষে সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে আমাকে জানালেন যে কিছুদিনের মধ্যে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের স্বপক্ষে সক্রিয়ভাবে পরিকল্পিত উপায়ে কর্মসূচী গ্রহণ করার জন্য সদ্য আনুগত্য প্রদানকারী বাংলাদেশী কূটনৈতিক ও স্থানীয় বিশিষ্ট বাংলাদেশীরা সম্মিলিতভাবে কার্যক্রম শুরু করবে। এ প্রসঙ্গে তিনি তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর কথাও উল্লেখ করে বললেন যে, তিনি ইউরোপব্যাপী তার কার্যক্রম শুরু করেছেন। তিনি আরও জানান, এদের সবার সঙ্গে আমাদের নিয়মিতভাবে যোগাযোগ আছে এবং সরকারের অনুমোদনক্রমেই তারা বাংলাদেশের পক্ষে সকল কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন। পররাষ্ট্র সচিব মহোদয় এরপর আমাকে অনুরোধ করলেন তার অফিস থেকে ওই সময়ে কার্যরত সব বাংলাদেশ অস্থায়ী মিশনের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করে আমাদের কার্যক্রমের সকল প্রতিবেদন নিয়মিতভাবে তাদের কাছে পাঠানোর জন্য। প্রয়োজন হলে তার অফিস থেকে আলাদাভাবে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দেয়া হবে বিদেশে অবস্থিত সকল অস্থায়ী বাংলাদেশ মিশনকে। তিনি আরও বললেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিশেষ করে তাদের বহির্প্রচার ইউনিটের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়। সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ে বলতে গিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বললেন, প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা মোতাবেক এবং সেক্টর কমান্ডারদের নির্দেশনা অনুযায়ী যদি আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে তাহলে হানাদার পাকবাহিনী খুব শীঘ্রই গ্রাম অঞ্চল থেকে পালিয়ে নিজেদের জীবন বাঁচাতে তাদের প্রধান ঘাঁটিগুলোতে অর্থাৎ ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নিতে বাধ্য হবে আর তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকার বাহিনী সদস্যরা তাদের দেশবিরোধী কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে শরণাপন্ন হবে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে। তাই আমাদের সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সঙ্গে যে বিষয়টা বিশ্ববাসীর কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে সেটা হলো প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও নির্দেশনা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিদিনের হানাদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালিত বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ অভিযানসমূহের বিস্তারিত তথ্যাবলী। আর এটা সম্ভব হলেই বিশ্বজনমত আরও বেশি কার্যকরীভাবে এগিয়ে আসবে আমাদের পক্ষে। তার ব্যক্তিগত অভিমত যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের মাত্র গুটিকয়েক দেশের তৎকালীন সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকায় সক্রিয় হলেও সেসব দেশের জনগণ বুদ্ধিজীবী এবং গণমাধ্যমে প্রথম থেকেই বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে তাদের জোরদার ভূমিকা পালন করছে এবং প্রতিটি দেশেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনসমাবেশ ও আন্দোলন হচ্ছে নিয়মিতভাবে। প্রবাসী মুজিবনগর সরকার যে সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সে বিষয়টাও বিশ্ববাসীকে বিভিন্নভাবে জানিয়ে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে তিনি জানান। মুজিবনগর সরকার যে একটা সক্রিয় পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেছে প্রফেসর মোজাফফর আহমেদকে চেয়ারম্যান করে সেটার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন অনেক বিদেশী আমাদের সঙ্গে সাক্ষাতকারের সময়ে। বিষয়টা খুবই সময় উপযোগী এবং সরকারের গণতান্ত্রিক মানসিকতার একটা বহির্প্রকাশ বলে তিনি উল্লেখ করেন এবং তিনি মনে করেন যে, সরকারের এসব কর্মসূচী ব্যাপকভাবে বিদেশী গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পররাষ্ট্র সচিব উল্লেখ করেন। তা হলো হানাদার পাকবাহিনী কিন্তু তাদের স্থানীয় সহায়তাকারী রাজাকার বাহিনীর সহায়তা না পেলে তাদের পক্ষে দেশের ভেতরে গ্রাম-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়া গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া, নির্বিশেষে লোক হত্যা করা মহিলাদের ওপর অমানবিক অত্যাচার করা এবং শিশুদের হত্যা করার মতো জঘন্য অপরাধমূলক তৎপরতা চালিয়ে যাওয়া কোনভাবেই সম্ভবপর ছিল না। তাই রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের টার্গেট করে প্রাথমিকভাবে তাদের নানারকম ভয়ভীতি দেখিয়ে এবং পরে ক্রমে ক্রমে হানাদারদের দেয়া অস্ত্রশস্ত্রসহ তাদের পক্ষপরিত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করলে সাধারণভাবে ক্ষমা করা হবে ইত্যাদি ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে হানাদার বাহিনীকে কোন রকম সাহায্য সহযোগিতা প্রদানে বিরত রাখা সম্ভবপর হয়, তাহলে হানাদার পাকবাহিনীর পক্ষে গ্রাম-গঞ্জ থেকে পালিয়ে বড় বড় শহরে অবস্থিত ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নেয়া ছাড়া কোনভাবে নিজেদের জীবন বাঁচানো সম্ভব হবে না। ফলে ক্রমে ক্রমে অঞ্চলের পর অঞ্চল শত্রুমুক্ত করা সম্ভব হবে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় আরও ত্বরান্বিত গতিতে চলতে থাকবে। তাই সচিব মহোদয়ের অভিমত হলো এই ধরনের কোন সিদ্ধান্ত সরকারের পক্ষে নেয়া সম্ভব হলে সেটা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবাণী ও বিবিসির মতো গণমাধ্যমে যথাযোগ্যভাবে প্রচার করা। পরবর্তীকালে বিশেষ কারণে মাহবুবুল আলম চাষীকে পররাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এমআর আখতার মুকুল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এমআর আখতার মুকুল চরমপত্র খ্যাত এমআর আখতার মুকুলকে চিনতাম অনেক আগে থেকেই। আমার এক আত্মীয় সাবেক ছাত্রনেতা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক ও এ্যাডভোকেট ইকবাল আনসারী খানের বাসায় উনি আসতেন মাঝেমধ্যে আড্ডা মারতে ও তাস খেলতে। উনি যে এতটা সাধারণ বিষয়কে ভাষা ও বলার ভঙ্গি দিয়ে এমন মজার করে ফেলতেন যে বক্তব্যটা গ্রহণযোগ্য না হলেও কেউ এটাকে একেবারে ফেলে দিতে পারত না। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে প্রতিরক্ষা সচিব সামাদ কর্তৃক সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার উদ্দেশ্যে এক সপ্তাহের মধ্যে একটা কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার খসড়া তৈরি করার জন্য আদিষ্ট হয়ে সংশ্লিষ্ট অনেকের মতো এমআর আখতার মুকুল ভাইয়ের কাছেও হাজির হই এ বিষয়ে তার চিন্তা-ভাবনা ও উপদেশ গ্রহণের জন্য। মুকুল ভাই অবশ্য জানতেন যে, সরকারী কলেজে যোগদান করার পূর্বে আমি কয়েক বছর ইংরেজী দৈনিক মর্নিং নিউজ ও করাচীর ডন পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছি এবং বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আমার একটি গ্রন্থ ১৯৭০ সালে পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ড কর্তৃক ওই বছরের শ্রেষ্ঠ অনুবাদ গ্রন্থ হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছে। সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার জন্য তিনি খুব খুশি মনে আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো আন্তরিকভাবে আলিঙ্গন করলেন এবং খুব আন্তরিকতার সঙ্গে কাজটি করে যাবার জন্য উপদেশ দিলেন। কাজটি সুষ্ঠুভাবে এবং সুকল্পিতভাবে সম্পন্ন করার জন্য সব রকম সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করার আশ্বাস তিনি আমাকে দিলেন সময়টা ছিল বিকেল পাঁচটা-ছয়টার মতো। তিনি বিষয়টা নিয়ে রাতে চিন্তা-ভাবনা করবেন এবং প্রয়োজন হলে আরও কয়েক জনের সঙ্গেও আলাপ করবেন এবং পরেরদিন সকাল দশটার সময় আমাকে আবারও যেতে বললেন তার বাসায়। পরেরদিন সকালে নির্ধারিত সময়ে তার বাসায় গিয়ে হাজির হলে প্রথমেই তিনি আমাকে জানালেন যে, বিষয়টি নিয়ে তিনি গাফ্ফার চৌধুরী ও তোয়াব খানের সঙ্গে আলাপ করেছেন এবং আরও আলাপ করেছেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আশফাক ও শামসুল হুদার সঙ্গে। প্রথমেই তিনি আমাকে বললেন যে, তার চরমপত্র প্রতিদিনই খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে তোমাকে এবং আমার প্রতিদিনের বক্তব্যে তোমার জন্য হয়ত অনেক খোরাক পেয়ে যাবে যা কিছু প্লাস-মাইনাস করে প্রয়োজন মতো তোমার নিজস্ব বক্তব্য যোগ করে নিজস্ব প্রতিবেদন তৈরি করা হয়ত সম্ভবপর হবে। পরে তিনি আমাকে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার জন্য যে কাজগুলো খুব গুরুত্বসহকারে নিয়মিতভাবে করে যাবার জন্য উপদেশ দিলেন সেগুলো হলো মুজিবনগর সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রাখতে হবে, নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখতে হবে কোকাকোলা বিল্ডিংয়ে অবস্থিত অস্থায়ী আওয়ামী লীগ অফিসের সঙ্গে। তিনি আমাকে জানালেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক খবরাখবর পাওয়ার জন্য উপরোক্ত স্থানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে অবশ্যই তোমাকে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রাখতে হবে। এ ছাড়াও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর বিভাগের সঙ্গে বিশেষ করে আলমগীর কবির ও আলি জাকেরের সঙ্গে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রাখার পরামর্র্শও তিনি আমাকে দিলেন। তিনি জানালেন, মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ খবরাখবর জানার জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রই হলো সবচেয়ে এমআর আখতার বেশি নির্ভরযোগ্য। কথা প্রসঙ্গে মুকুল ভাই বললেন, এতসব স্থানে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রাখা তোমার একার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভবপর হবে না। তাই সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার জন্য আরও কয়েকজনকে নিয়োগ দেয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করতে হবে। তিনি অবশ্য নিজেই জানালেন, প্রতিরক্ষা সচিব সামাদ তার খুব পরিচিত এবং তিনি তাকে বিষয়টি জানাবেন। কিছু দিন পরে অবশ্য আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন কবি আল মাহমুদ ও সাংবাদিক আল মুজাহিদী। দুজনই স্ব-স্ব কাজে খুব আন্তরিক ছিলেন এবং তাদের যোগদানের পর সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ারের কাজে খুব গতি পেয়েছিল। তবে আমাদের কাজে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপ-সচিব আকবর আলি খান এবং প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা ড. বেলায়েতও সর্বতোভাবে আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করতেন ও শলাপরামর্শ দিতেন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে। মুকুল ভাই আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, দুনিয়ার অন্যতম একটি সামরিক বাহিনী হিসেবে পরিচিত হানাদার পাক বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাদার বাহিনীর সম্মিলিত বাঙালী নিধন অভিযান এবং জ্বালানো-পোড়ানো কার্যক্রমকে সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে প্রতিনিয়ত প্রতিহত করে চূড়ান্ত বিজয়ের পথে এগিয়ে যাবার যে অভিযান আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা চালিয়ে যাচ্ছেন সেই বীরত্বগাথা ও মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে বিশ্বব্যাপী প্রচার এবং প্রকাশ করাটার অন্তর্নিহিত কর্মপদ্ধতি এবং কৌশলটাই হলো আমাদের সত্যিকার সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার। একাজে আমরা আমাদের কৌশল ও নৈপুণ্য যতবেশি দেখাতে সক্ষম হব আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রগতি হবে তত দ্রুত ও কার্যকরী। এরপরে মুকুল ভাই প্রশ্ন তুললেন বিশ্ব জনমত বিষয়ে। হানাদার পাকবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে যেভাবে হঠাৎ করে সমস্যা সমাধানের জন্য চলমান আলোচনা সমাপ্ত হওয়ার পূর্বেই অতর্কিতভাবে কামান, বন্দুক, ট্যাঙ্ক নিয়ে নিরীহ, অস্ত্রহীন সাধারণ মানুষদের আক্রমণ শুরু করে তারপর থেকেই বিশ্বজনমত তাদের বিরুদ্ধে চলে যায় বিশেষ করে তাদের প্রতিপক্ষ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা ও সহযোগী হওয়ার কারণে। তারপর থেকেই জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার ও তার সামরিক এবং বেসামরিক সহযোগীরা যেভাবে ক্রমাগতভাবে একটার পর একটা রাজনৈতিক কূটকৌশল এবং অনৈতিক কূটচালের মাধ্যমে বিশ্বজনমতকে সপক্ষে ফেরানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে তখন আমাদের সদাসতর্ক থাকতে হবে বিদেশী গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত তাদের সকল প্রচারণা বিষয়ে। বিশেষ করে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, রেডিও অস্ট্রেলিয়া, কানাডিয়ান রেডিও এবং জার্মান রেডিওসহ অন্যান্য বিশ্ব গণমাধ্যমের পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমাদের গড়ে তুলতে হবে আন্তর্জাতিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যাতে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক তৎপরতা এবং মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর সঠিকভাবে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয় ওই সমস্ত দেশে। একইভাবে তিনি এপি, এএফপি এবং রয়টারের মতো আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার কলকাতার প্রতিনিধিদেরও ব্যক্তিগত সম্পর্ক স্থাপনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন মুকুল ভাই তার বক্তব্যে। চলবে... লেখক : মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার প্রধানের দায়িত্ব পালনকারী
×