ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সমীরণ বিশ্বাস

পুষ্টি নিরাপত্তায় বায়োফর্টিফাইড হাই জিংক রাইস

প্রকাশিত: ০৭:৩৪, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

পুষ্টি নিরাপত্তায় বায়োফর্টিফাইড হাই জিংক রাইস

সরকারের সফল নীতিমালা, কৃষি বিজ্ঞানীদের নিরলস গবেষণা, কৃষি সম্প্রসারণ কার্যক্রম, বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার সহায়তা এবং সর্বোপরি কৃষকদের সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তায় সফল হলেও পুষ্টি নিরাপত্তায় রয়েছে ব্যাপক ঘাটতি। পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকার জাতীয় পুষ্টি প্রোগ্রামের মধ্য দিয়ে ভিটামিন-এ ট্যাবলেট খাওয়ানোর মাধ্যমে, এর ঘাটতি পূরণ করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ভিটামিন-এ ছাড়াও মানবদেহ গঠনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুপুষ্টি উপাদান হচ্ছে জিংক। বর্তমানে বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৪৪%-এর অধিক শিশু জিংকের অপুষ্টিতে ভুগছে। ১৫-১৯ বছরের প্রায় ৪৪% কিশোরী মেয়ে জিংকের অভাবজনিত কারণে খাটো হয়ে যাচ্ছে। প্রায় ৫৭ ভাগ মহিলা জিংকের অভাবজনিত অপুষ্টিতে ভুগছে। জিংকের ঘাটতির কারণে শিশুর শরীরের কলা গঠন ব্যাহত হয়, বাড়-বাড়তি কমে যায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, খাদ্য গ্রহণে অরুচি, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়াসহ শিশুর নানাবিধ রোগ দেখা দেয়, স্মৃতিশক্তি কমে যায় ও কম মেধাবী হয়। নারীদের সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা হারানো, কম ওজনের সন্তান জন্ম দেয়া, বামন বা খাটো শিশুর জম্ম দান, গর্ভবতী মায়েদের প্রসবকালীন জটিলতা দেখা দেয়, যা মা ও শিশু-মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাছাড়াও জিংকের অভাবে মানসিক ভারসাম্যহীনতা, দৃষ্টিশক্তিতে ব্যাঘাত ঘটা, মাথার চুল পড়ে-যাওয়া ও প্রস্টেট গ্রন্থির সমস্যা দেখা দেয়। একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক ১২-১৫ মিলিগ্রাম, দুগ্ধদানকারী মায়েদের ১৬ মিলিগ্রাম এবং শিশুদের ২-১০ মিলিগ্রাম জিংক প্রয়োজন। জিংক সাধারণত সামুদ্রিক মাছ, মাংস, কলিজা ও ফলমূলে বেশির ভাগ পাওয়া যায়, যার বেশির ভাগই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রতিদিন গ্রহণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রতিদিন ঘাটতি থেকে যায় প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। মানবদেহে জিংক প্রায় ৩৬০ ধরনের হরমোনকে তাদের কার্যকারিতা সম্পন্ন করতে সহায়তা করে। জিংকের ঘাটতির কারণে অসম্পূর্ণ থেকে যায় আমাদের বিপাকীয় কার্যক্রম তথা বৃদ্ধি ও বিকাশ। জিংক বিষয়ে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে সচেতনতা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। জিংকসহ অন্যান্য অনুপুষ্টির ঘাটতি পূরণে বিশেষত ২০০২ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে হারভেস্টপ্লাস প্রোগ্রাম। হারভেস্টপ্লাস প্রোগ্রাম, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ট্রপিক্যাল এগ্রিকালচার ও ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের যৌথ প্রয়াসে পরিচালিত, যা ইন্টারন্যাশনাল কনসালটেটিভ গ্রুপ ফর এগ্রিকালচারাল রিসার্চ অন এগ্রিকালচারাল ফর নিউট্রিশন এ্যান্ড হেলথ-এর অংশ। হারভেস্টপ্লাস প্রোগ্রাম বাংলাদেশে জিংকের ঘাটতি পূরণে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টটিউটের সহায়তায় আবিষ্কার করে জিংক ধান। বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত, প্রয়োজনীয় শক্তির ৮৪% ভাত থেকে আসে এবং মোট জমির ৭০% জমিতে ধান চাষ হয়। সারা বিশে^র মধ্যে বাংলাদেশেই, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রথম জিংক ধান আবিষ্কার করে। জিংক ধান অন্যান্য ধানের মতোই। পার্থক্য হচ্ছে, এই ধানে জিংক-এর পরিমাণ বেশি। সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, মানুষের দেহে দৈনিক জিংকের চাহিদা তিন বেলা জিংক সম্মৃদ্ধ চালের ভাত খেয়ে পূরণ করা সম্ভব। এই ধানকে অনেকে হাইব্রিড এবং জিএমও ধান মনে করে এবং বীজ সংরক্ষণ নিয়ে চিন্তিত হয়ে যায়। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, এটি কোন হাইব্রিড বা জিএমও ধান নয়। এটি আমাদের দেশে বিদ্যমান জাতগুলোর থেকে সংকরায়নের মাধ্যমে উদ্ভাবিত জিংক সমৃদ্ধ জাত। এই উদ্ভাবন পদ্ধতিকে বলা হয় বায়োফর্টিফিকেশন এবং বায়োফর্টিফাইড ফসলের বীজ সংরক্ষণ করা সম্ভব। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বায়োফর্টিফিকেশন-এর মাধ্যমে উৎপাদন করেছে ধানের ৫টি জাত এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কৃষি বিশ^বিদ্যালয় উদ্ভাবন করেছে একটি হাইব্রিডসহ ২টি জাত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কৃষি বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃক উদ্ভাবিত হাইব্রিড জাতটির বীজ সংরক্ষণ করা যাবে না। বিনা উদ্ভাবিত জাত ১টি। ব্রি ধান ৬২ Ñ এই জাতটি বাংলাদেশ ধান গবেষণা কর্তৃক উদ্ভাবিত জাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে স্বল্প মেয়াদী। এই জাতটির জীবনকাল ১০০ দিন। জাতটির সুবিধা হচ্ছে, যেসব এলাকায় কৃষকরা আগাম রবি শস্য, যেমন Ñ গম, আলু, সরিষা, ভুট্টা চাষ করতে চায়, সেসব এলাকার জন্য উপযোগী। জীবনকাল মাত্র ১০০ দিন হওয়ায় এই জাতটি অক্টোবর মাসের প্রথম থেকে দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে কর্তন করা যায়। এর ফলে আগাম রবি শস্য রোপণ ক’রে কৃষকরা যেমন একদিকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে, অন্যদিকে জমির নিবিড়তা বাড়ে অর্থাৎ বছরে অধিকসংখ্যক ফসল চাষ করে খাদ্যে বৈচিত্র্য এনে পুষ্টির নিশ্চয়তা পেতে পারে। তবে এই জাতটি চাষাবাদের লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ধানের চারার বয়স অবশ্যই ২০ দিনের কম হতে হবে। এই ধানের চাল লম্বা ও সরু হওয়ায় ভাত দেখতে ও খেতে সুস্বাদু। এই ধানের মুড়ি ও খৈ উৎকৃষ্ট। ব্রি ধান-৭২ Ñ এই জাতটির মধ্যে জিংকের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি এবং প্রতি হেক্টরে ফলন ৭.৫ টন। এই ধানটির সুবিধা হচ্ছে, যেসব এলাকায় বিআর ১১ ধান চাষ করা হয়, সেসব এলাকায় এই ধানটি চাষ করা যেতে পারে এবং এর ফলন বি আর ১১ ধান-এর চেয়ে অনেক বেশি। ব্রি ধান ৭৪Ñ এই জাতটির মধ্যে জিংকের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি এবং প্রতি হেক্টরে ফলন ৭.৫ টন। বর্তমান সময়ে ধান চাষে আতঙ্ক হিসেবে দেখা দেয়া ব্লাস্ট রোগটি এই ধানে হয় না। বি ইউ ধান ২Ñ এটি উচ্চফলনশীল ধান। এই জাতটির সুবিধা হচ্ছে, এটি আউশ, আমন, বোরোÑ এই ৩ মৌসুমেই চাষ উপযোগী। এই জাতটি চাষে জিংকের সঙ্গে সুগন্ধি চাল পাওয়া যায়। আশা করা যায় যে, একজন মানুষ দৈনিক আধা কেজি চালের ভাত খেলে তার দৈনিক জিংক চাহিদার ৮০ ভাগ পূরণ করতে পারবে। এই উদ্যোগের ফলে বায়োফর্টিফাইড জিংক ধান ছাড়াও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়েছে আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ বায়োফর্টিফাইড মসুরের জাত বারি মসুর ৬, জাত বারি মসুর ৭, জাত বারি মসুর ৮। বিবিএস-এর মতে মানুষ দৈনিক ৬.৭ গ্রাম মসুরের ডাল গ্রহণ করে, যেখানে অন্য ডালগুলোর গ্রহণ অর্ধেকের চেয়ে কম। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়েছে আয়রন ও জিংক সমৃদ্ধ বায়োফর্টিফাইড মসুর ডাল। ইন্টারন্যাশনাল পটেটো সেন্টারের সহায়তায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়েছে ভিটামিন-এ সমৃদ্ধ মিষ্টি আলুর জাত, বারি মিষ্টি আলু-২ (কমলা সুন্দরী) এই জাতটি রবি মৌসুমে চাষযোগ্য। এর ফলন ৪০-৪৫ টন/হেক্টর। এর জীবনকাল ১৪০-১৫০ দিন। লতা ও পরিপক্ব পাতা সবুজ, কিন্তু লতার অগ্রভাগ বেগুনি, লতার অগ্রভাগ শাক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কন্দমূলের চামড়া কমলা; শাঁস গাঢ় কমলা রঙের, ভিটামিন-এ ৭,৫০০ আ.এ./১০০ গ্রাম। এছাড়াও গমের বায়োফর্টিফাইড জাত আবিষ্কারের গবেষণা চলমান রয়েছে। হারভেস্টপ্লাস প্রোগ্রাম বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রথম কৃষক-পর্যায়ে জিংক ধানের বিতরণ শুরু করে। বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এবং এনজিও-দের মাধ্যমে বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ উপজেলায় বীজ বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছে। ধান ছাড়া বায়োফর্টিফাইড ফসলের অন্যান্য জাতগুলো কৃষক-পর্যায়ে খুব সহজলভ্য না হলেও আগ্রহী উৎপাদনকারীরা গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে বীজ সংগ্রহ করতে পারেন। বর্তমানে বিএডিসি কিছু পরিমাণে বীজ উৎপাদন শুরু করেছে এবং মেহেরপুর, যশোর, বগুড়া, মানিকগঞ্জ এবং রাজশাহী এলাকায় কিছু বীজ উৎপাদনকারী প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান, বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার জিংক ধান বীজ উৎপাদন করে যাচ্ছে। পুষ্টি নিরাপত্তায় বায়োফর্টিফাইড ফসলÑ হাই জিংক রাইস-এর গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং মাননীয় কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবৃন্দ বিভিন্ন সময় বক্তব্য রেখেছেন। একটি সমৃদ্ধ জাতি ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গঠন করতে হলে বেসরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারী উদ্যোগকে এ বিষয়ে আরও বেগবান করা আব্যশক। লেখক : কো-অর্ডিনেটর, কৃষি ও বীজ কর্মসূচী, সিসিডিবি, ঢাকা।
×