ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাবাত রেজা খান

বাংলাদেশের নীল অর্থনীতির অপূর্ব সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৭:৩৩, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বাংলাদেশের নীল অর্থনীতির অপূর্ব সম্ভাবনা

বঙ্গোপসাগর বাংলাদেশের একমাত্র সমুদ্রসীমা এবং বিশ্বের বৃহত্তম উপসাগর যা সারা বিশ্বে ‘বে অব বেঙ্গল’ নামে পরিচিত। বঙ্গোপসাগরের সীমানা নিয়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছিল। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে ও ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ায় মোট ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার টেরিটোরিয়াল সমুদ্র এলাকায় বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব, অধিকার ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যার আয়তন প্রায় আরেকটি বাংলাদেশের সমান। আরও আছে ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল ও চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে সব ধরনের সম্পদের ওপর পূর্ণ অধিকার। এই সুবিশাল জলরাশির অভ্যন্তরে যেমন লুকিয়ে আছে অপার রহস্য তেমনি লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের নীল অর্থনীতির এক অপূর্ব সম্ভাবনা। এই অর্থনীতি পাল্টে দিতে পারে জাতীয় অর্থনীতির চেহারা। সমুদ্র উপকূল পরিবেষ্টিত পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলো সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগিয়ে তাদের ভাগ্যের চাকা পরিবর্তন করেছে। পাল্টে দিয়েছে দেশের অর্থনীতি। আন্তর্জাতিক সমুদ্র সম্পদ গবেষকরা বহুকাল আগে থেকেই বঙ্গোপসাগরকে বিভিন্ন ধরনের সম্পদের খনি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। বঙ্গোপসাগরের তলদেশে যে খনিজ সম্পদ রয়েছে তা পৃথিবীর আর কোন সাগর, উপসাগরে নেই। মণি, মুক্তা, সোনা, রুপা, তামা, প্রবালসহ বিভিন্ন ধরনের মহামূল্যবান ধনরতœ এখানে রয়েছে বলে ভারতবর্ষের পৌরাণিকে বঙ্গোপসাগরের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘রতœাকাগার’। বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সম্পদকে দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ১. অপ্রাণিজ সমুদ্র সম্পদ ২. প্রাণিজ সমুদ্র সম্পদ। অপ্রাণিজ সমুদ্র সম্পদ বলতে মূলত খনিজ ও খনিজ জাতীয় সম্পদকে বোঝায়। বঙ্গোপসাগরে আছে সীমাহীন অপ্রাণিজ সম্পদ। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তেল, গ্যাস, চুনাপাথর ইত্যাদি। খনিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে পায় ১৭ ধরনের খনিজ বালি। এর মধ্যে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায় জিরকন, রুটাইল, সিলিমানাইট, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, গ্যানেট, কায়ানাইট, মোনাজাইট, লিকোক্সিন ইত্যাদি। প্রত্যেকটি পদার্থই মূল্যবান তবে মোনাজাইট অতিমূল্যবান পদার্থ। এই তেজস্ক্রিয় পদার্থ পারমাণবিক বোমা তৈরিতে ও পারমাণবিক চুল্লিতে শক্তি উৎপাদক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত মোনাজাইট যদি উত্তোলন করা যায় তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এটা হবে শতাব্দীর সেরা আশীর্বাদ। বঙ্গোপসাগরের নীল অর্থনীতি খুলে দিয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাবনার সকল দুয়ার। তথ্য মতে, ১২০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকায় ২ কোটি ৪৯ লাখ ৬০ হাজার ৯৮ টন খনিজ পদার্থ অপরিশোধিত অবস্থায় আছে। বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের রিপোর্ট মতে, সৈকতের বালিতে মোট খনিজের মজুদ ৪৪ লাখ টন এবং প্রকৃত সমৃদ্ধ খনিজের পরিমাণ প্রায় ১৭ লাখ ৫০ হাজার টন। যা বঙ্গোপসাগরের ১৩টি স্থানে পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা থেকে প্রায় ১০ লাখ টন খনিজ বালু উত্তোলন করা যেতে পারে। এছাড়াও বঙ্গোপসাগরের তলদেশে রয়েছে ম্যাঙ্গানিজ নডিউল, ফসফরাস ডেপোজিট, পলিমেটালিক সালফাইড, এ্যাডাপোরাইট, ক্লেসার ডেপোজিট নামক আকরিক। এইসব আকরিক পরিশোধনের মাধ্যমে পাওয়া যাবে মলিবডেনাম, কোবাল্ট, কপার, জিঙ্ক, লেডসহ ইত্যাদি দুর্লভ ধাতু। এ সব দুর্লভ ধাতু জাহাজ নির্মাণ ও রাসায়নিক কারখানায় ব্যবহার করা যাবে। বদলে যাবে জাহাজ নির্মাণ শিল্প ও রাসায়নিক কারখানা। দেশের অর্থনীতিতে যোগ হবে নতুন মাত্রা। বাংলাদেশ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী অগভীর সমুদ্রের তলদেশে ভ্যানাডিয়াম, প্লাটিনাম, কোবাল্ট, মলিবডেনাম, ম্যাঙ্গানিজ ক্রাস্ট, তামা, সিসা, জিঙ্ক এবং কিছু পরিমাণ সোনা ও রূপা দিয়ে গঠিত সালফাইডের অস্তিত্ব রয়েছে। ১৪০০ থেকে ৩৭০০ মিটার গভীরে এসব মূল্যবান সম্পদ রয়েছে। এসব মূল্যবান পদার্থ উত্তোলন করা গেলে খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ হবে দেশ। বঙ্গোপসাগরের প্রায় ৩০ থেকে ৮০ মিটার গভীরে সিমেন্ট শিল্পের কাঁচামাল ‘ক্লে’র সন্ধান পাওয়া গেছে। যদি অগভীর সমুদ্রের ক্লে উত্তোলন করা যায় তাহলে বাংলাদেশের সিমেন্ট শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। সমৃদ্ধ হবে সিমেন্ট শিল্প। অতিসম্প্রতি বঙ্গোপসাগরের অগভীর ও গভীর তলদেশে মহামূল্যবান ধাতু ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এই ধাতুগুলো উত্তোলন করা গেলে ইউরেনিয়ামে সমৃদ্ধ হবে দেশ। বিশ্ববাজারে ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের চাহিদা কিরুপ তা সহজেই অনুমেয়। এবার বলা যাক বঙ্গোপসাগরের প্রাণিজ সম্পদের কথা। বঙ্গোপসাগর মূলত প্রাণিজ সম্পদের এক বিস্ময়কর আঁধার। মৎস্য সম্পদ, সামুদ্রিক প্রাণী, সামুদ্রিক আগাছা, লতা, গুল্ম ইত্যাদিতে ভরপুর বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় রয়েছে ৪টি মৎস্যক্ষেত্র। এই মৎস্যক্ষেত্রগুলোতে প্রায় ৪৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ বিচরণ করে। তাছাড়া আরও আছে ৩৩৬ প্রজাতির শামুক ঝিনুক, ৭ প্রজাতির কচ্ছপ, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৩ প্রজাতির তিমি, ১০ প্রজাতির ডলফিন, প্রায় ২০০ প্রজাতির সি উইড (এক ধরনের সামুদ্রিক ঘাস)। বঙ্গোপসাগরে আছে বিপুল পরিমাণ সামুদ্রিক আগাছা। এসব আগাছা প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বিভিন্ন রোগের ওষুধ তৈরি করা যায়। আর এটা সম্ভব হলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে বিপ্লব ঘটবে। বঙ্গোপসাগরে থাকা সামুদ্রিক আগাছা মানবদেহের জন্য উপকারী ও পুষ্টিকর। বিদেশে এসবের চাহিদা ব্যাপক। বিদেশীরা এসব আগাছা উপকূলে কৃত্রিমভাবে চাষাবাদ করে অথচ বঙ্গোপসাগরে প্রাকৃতিক ভাবে এসব জন্মায়। এসব আগাছার মধ্যে ইসপিরুলিনা সবচেয়ে মূল্যবান। চীন, জাপান, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানুষ এগুলোকে খাদ্য হিসেবে খেয়ে থাকে। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রফতানি করে এসব আগাছা থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যেতে পারে। এটা সম্ভব হলে শক্তিশালী হবে দেশের অর্থনীতি। বঙ্গোপসাগরে রয়েছে বিপুল পরিমাণ মৎস্য সম্পদ। রূপচাঁদা, রুই, কাতল, পাঙ্গাস, আইড়, কোরাল, লইট্টা, ভেটকি, কাজলি, ফাহা, তাপসী, পোয়া, টুনা, নানা জাতের ভোলমাছসহ আরও শতশত প্রজাতির মাছ। এসব মাছ পরিকল্পিতভাবে আহরণ করা গেলে অভ্যন্তরীণ আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। মৎস্য সম্পদে ভরপুর বঙ্গোপসাগর হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। বঙ্গোপসাগরে যে পরিমাণ শামুক ঝিনুক, কাঁকড়া, কচ্ছপ, সি কুকুমবার, সি আরসিম আছে তা অকল্পনীয়। বিদেশে এসবের দারুণ চাহিদা। দেশের ভেতরে সি আরসিম ও সি কুকুমবার খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত না হলেও বিদেশে খাদ্য হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। অথচ বঙ্গোপসাগর এসবের ভা-ার। পরিকল্পিত আহরণের মাধ্যমে বিদেশে রফতানি করে এসব থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে জেলিফিস পাওয়া যায়। জেলিফিস সুস্বাদু খাদ্য হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। তবে এতবড় সামুদ্রিক ধনভা-ার থাকা সত্ত্বেও নেই আহরণ ও সংরক্ষণের সুব্যবস্থা। সমুদ্রসীমা নিয়ন্ত্রণে নেই। অনেক সময় পার্শ্ববর্তী দেশ মৎস্য সম্পদ আহরণ করে নিয়ে যায়। সমন্বিত উদ্যোগ ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবে বঙ্গোপসাগরের সম্পদরাশি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অতীতে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারেনি। তাছাড়া সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ অন্যতম কারণ ছিল। এখন সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নেই। বাংলাদেশ তার কাক্সিক্ষত সমুদ্রসীমা পেয়েছে। দেশ ও জাতির ভাগ্য উন্নয়নে বঙ্গোপসাগরের সম্পদ রাশিকে ব্যবহার করার এক সুবর্ণ সুযোগ সামনে এসেছে। বঙ্গোপসাগরের সম্পদ আহরণের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরী। নীল অর্থনীতি নিয়ে জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে পরিকল্পনাবিদ এবং সমুদ্র অর্থনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে। সমুদ্র সম্পদ আহরণে পূর্বের মনোভাব বাদ দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন সমুদ্র সম্পদ আহরণ সহজ কোন বিষয় নয়। সমুদ্রে খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান, খনন, আহরণ সবই টেকনিক্যাল বিষয়। বিজ্ঞান সম্মতভাবে ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাজ করতে হবে। দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে। প্রযুক্তিগত ব্যবহারটা হতে হবে নিখুঁত। সামুদ্রিক মৎস্য আহরণে ও প্রক্রিয়াকরণে নিয়োজিত হবে বিপুলসংখ্যক মানুষ। কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে অনেক মানুষের। সম্পদশালী হয়েও সম্পদের ব্যবহার করতে না পারা কূপম-ূকতার পরিচায়ক। সমুদ্র মন্থন করে অমৃত তোলার মতো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুলে আনতে হবে বঙ্গোপসাগরের সুবিশাল ঐশ্বর্য। যা বদলে দেবে পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতি। তবে আশার কথা হলো সরকার আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। সম্প্রতি সরকারের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে সমুদ্র অর্থনীতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সরকারী উদ্যোগে ব্লু ইকোনমি সেল গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ বা ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ মহাপরিকল্পনায় সমুদ্র অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনায় নীল অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পাঁচ ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে যার মধ্যে অন্যতম হলো সামুদ্রিক সম্পদের বহুমাত্রিক জরিপ দ্রুত সম্পন্ন করা। এসব কৌশল বাস্তবায়নের জন্য সমুদ্র জরিপ, সমুদ্র নিরাপত্তা, সমুদ্র বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণা করার জন্য প্রয়োজনে একটি নতুন সংস্থা বা অধিদফতর গঠন করা যেতে পারে। তাছাড়া নীল অর্থনীতির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সমুদ্র নিরাপত্তা ও কেবল মাত্র মৎস্য সম্পদ আহরণে গুরুত্ব দিলে চলবে না বরং সমুদ্র থেকে অন্যান্য সম্পদ আহরণের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিপ্লব সাধিত হবে। লেখক : কলামিস্ট ও শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
×