ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যাহিদ হোসেন

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার

॥ পর্ব- চার ॥ কর্মসূচী প্রণয়নে পরামর্শকদের সুপারিশ মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা সচিব সামাদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করে কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা করার পরই তিনি মৌখিকভাবে নির্দেশ দিলেন ওই মুহূর্ত থেকে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার কাজ শুরু করতে। তবে এক সপ্তাহের মধ্যে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ক একটা কর্মসূচী এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া তৈরি করার নির্দেশও তিনি দিলেন আমাকে। ওই সময়ে তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. বেলায়েত এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আকবর আলি খানকেও পরিচয় করিয়ে দিলেন আমার সঙ্গে। আকবর আলি খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী ছিলেন এবং আমরা দুজনে তখন সলিমুল্লাহ হলে থাকতাম। আমাদের সময় আইএ পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল এবং বিএ (অনার্স) ও এমএতে, সাধারণ ইতিহাসে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিল। খুবই জ্ঞানী এবং মেধাবী ছাত্র বলে ওর খুব সুনাম ছিল। তাই প্রথমেই আমি আকবর আলির কাছ থেকে মোটামুটিভাবে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ক একটা কর্মসূচী এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বিষয়ে বিষদ বিশ্লেষণ নিলাম। এরপরে যার শরণাপন্ন হলাম তিনি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে আমার শিক্ষক, বিভাগীয় চেয়ারম্যান এবং ওই সময়ে মুজিবনগর সরকারের পরিকল্পনা সেলের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনরত প্রফেসর মোজাফ্ফর আহম্মদ চৌধুরী। তার সঙ্গে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ক কর্মসূচী ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বিষয়ে দু’দফা দীর্ঘ আলোচনা হয়, তাঁর বাসস্থানও কলকাতার শিয়ালদহ রেলস্টেশনের বিপরীত দিকে অবস্থিত বারোজ হোটেলে। তিনি প্রথমেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার জন্য টার্গেটসমূহ নিরূপণ করার কথা বললেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, আমরা কি জন্য মুক্তিযুদ্ধ করছি এবং কাদের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করছি? তিনি বললেন, আমরা নিশ্চয়ই যুদ্ধ করছি দেশকে হানাদার মুক্ত করে স্বাধীন করতে আর এই স্বাধীনতাটা কাদের জন্যÑ দেশের মানুষের জন্য। দেশের মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাস্কৃতিক অধিকার পুনরুদ্ধার করার জন্য। তাই আমাদের প্রথম টার্গেট হলো দেশের মানুষের স্বাধীনতা অর্জন। দ্বিতীয় বিষয়টা হলো আমরা কাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করছি? কারা আমাদের শত্রুপক্ষ? আমরা যুদ্ধ করছি হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে যারা আমাদের নিরীহ ভাই-বোনদের বিনাদোষে আমাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা হত্যা করছে অমানবিকভাবে জ্বালিয়ে দিচ্ছে তাদের বাড়িঘর এবং অন্যান্য স্থাপনা, ইজ্জত নষ্ট করছে আমাদের মা-বোনদের এবং হত্যা করছে শিশুদের। তাই আমাদের দ্বিতীয় টার্গেট হলো আমাদের শত্রুপক্ষ। তৃতীয় বিষয়টা হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছে কারা? আমাদের সামরিক ও বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের জীবনবাজি রেখে দেশের স্বাধীনতা হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের হাত থেকে ছিনিয়ে আনার জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছে দিনের পর দিন। তাই সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার তৃতীয় টার্গেট হলো আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা, আমাদের চতুর্থ বিষয়টা হলো আমরা পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালীরা তৎকালীন পাকিস্তানের ৫৬% জনগণকে নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী এবং ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের সর্বপ্রথম নির্বাচনে জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে দেশ শাসনের সাংবিধানিক অধিকার অর্জন করেছি। আর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে বর্তমান সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের প্রতিনিধিত্বকারী স্বৈরাচার সামরিক সরকার ক্ষমতা হাতছাড়া না করার জন্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চালিয়ে যাচ্ছে নির্মম গণহত্যা। ন্যায়বিচার ও সাংবিধানিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অমাদের সপক্ষে কার্যকরী ভূমিকা পালনের জন্য প্রয়োজন বিশ্বজনমত। আর তাই বিশ্বজনমত সপক্ষে আনার লক্ষ্য অর্জন করাটা হলো আমাদের চতুর্থ টার্গেট। প্রফেসর চৌধুরী আমাদের করণীয় কাজটা সম্পর্কে এমন পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিলেন যে, আমার কাজ করতে আর তেমন কোন অসুবিধা হয়নি। তবে তিনি আমাকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াটা বেশ কঠিন হবে। এজন্য উপরোক্ত চারটি টার্গেট এরিয়ার সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে খবরাখবর নিতে হবে এবং সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে। ‘আপনার একার পক্ষে পুরো দায়িত্বটা পালন করা সম্ভবপর হবে না বলেও তিনি জানিয়ে দিলেন আমাকে।’ উল্লেখ্য, প্রফেসর চৌধুরী সকল ছাত্র-ছাত্রীকে সবসময় ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ক কর্মসূচী বাস্তবায়ন বিষয়ে তিনি আর একটা বিষয়ের উপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করলেন। সেটা হলোÑ মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ খবরাখবর, মুজিবনগর সরকারের কার্যাবলী বিশেষ করে রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা ও কূটনৈতিক পদক্ষেপগুলোর বিষয়ে সম্পূর্ণ অবহিত থাকা। এজন্য প্রয়োজন হবে সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে এবং তাদের সব অপরাশেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ করে তাদের বহির্প্রচার ইউনিট, তথ্য মন্ত্রণালয় বিশেষ করে তাদের প্রেস ইনফরমেশন বিভাগ, স্বাধীন বাংলা, বেতার কেন্দ্র প্রভৃতি বিভাগ ও সংস্থার সঙ্গে সদা সমন্বয় রেখে দৈনন্দিন কার্যাবলী সম্পন্ন করতে সক্ষম হলে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার উদ্দেশ্য সফল হবে। ভাইস-চ্যান্সেলার ড. এ আর মল্লিক ১৯৭০ সালে ‘সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সমস্যা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়’ শিরোনামে একটা গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছিলাম তৎকালীন নীলক্ষেতস্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যে অবস্থিত ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন (নিপা) এর একাডেমিক জার্নালের জন্য। প্রবন্ধটি পড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ড. এ আর মল্লিকের ভাল লেগেছিল বিধায় তিনি নিপার অফিস থেকে ঠিকানা নিয়ে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তার সঙ্গে চা খাবার জন্য। সেই আলাপের সূত্র ধরে প্রফেসর মোজাফ্ফর আহম্মদ চৌধুরীর সঙ্গে দু’দফা আলাপের পর চলে গেলাম মুজিবনগরে ড. মল্লিকের সঙ্গে দেখা করতে। তাকে মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার দায়িত্ব প্রদানের কথা জানিয়ে এ বিষয়ে কয়েকদিনের মধ্যে জরুরী ভিত্তিতে একটা কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন পদ্ধতি প্রণয়ন করার বিষয়ে তার পরামর্শ এবং সহযোগিতা চাইলে, তিনি একটা দিন সময় চেয়ে পরের দিন যেতে বললেন। তবে তিনি একটা চিঠি লিখে আমাকে দেখা করতে বললেন। তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদের খানের সঙ্গেও ওইদিন দেখা করতে পরামর্শ দিলেন। পরের দিন ড. মল্লিক আমাকে তার নিজের হাতে লেখা দুই পৃষ্ঠার একটা কাগজ দিলেন যেহেতু তিনি ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন তাই খুব সংক্ষেপে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে যে বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন সেটা সত্যিই ছিল যুক্তিযুক্ত ও প্রাসঙ্গিক। তিনি তুলে ধরেছিলেন কিভাবে কি পরিস্থিতিতে হানাদার পাকবাহিনী অতর্কিত ঝাঁপিয়ে পড়ে গভীর রাতে তাদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালীদের সমূলে ধ্বংস করতে। বঙ্গবন্ধু ও তার রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে একটা আপোস এবং সমঝোতা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাইরে বাইরে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে গেলেও প্রকৃতপক্ষে বাঙালীর নিধনের লক্ষ্যে প্রণীত নীল নক্সার চূড়ান্ত রূপ দিয়ে যাচ্ছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়ার হানাদার পাক বাহিনী। ড. মল্লিক তার হাতে লেখা বক্তব্যে প্রথম মহাযুদ্ধ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিভিন্ন পক্ষ কিভাবে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনা করে শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করার পরিকল্পনা নিয়েছিল সংক্ষেপে সেটাও উল্লেখ করেছিলেন। তবে তিনি জানান, ওইসব ‘কনভেনশনাল’ যুদ্ধের সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ারের ধরন ও পদ্ধতি এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মতো জনগণের যুদ্ধের প্রেক্ষিত অনেকটা ভিন্ন যদিও সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু একই। তিনি জানান, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হলো মূলত: জনগণের যুদ্ধ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর যুদ্ধ, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ এবং সর্বোপরি পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্তি লাভ করে স্বাধীনতা অর্জনের যুদ্ধ। ড. মল্লিক যে বিষয়টার উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেন সেটা হলো, সাধারণত যুদ্ধ হয়ে থাকে দুই পক্ষের মধ্যে এবং যুদ্ধে মূলত অংশগ্রহণ করে থাকে দুই পক্ষের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা তাদের ট্যাঙ্ক, কামান, বন্দুক, যুদ্ধজাহাজ, নৌজাহাজ এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্রের সহযোগিতায়। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হলো জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত এবং শিক্ষিত, অশিক্ষিত, শিক্ষক, ছাত্র, শ্রমিক, আমলা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চাকরিজীবী ও অন্য সকল শ্রেণীর জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণে পরিচালিত যুদ্ধ। এটা শুধুমাত্র দেশ শাসনের জন্য ক্ষমতা বদলের যুদ্ধ নয়, এটা হলো জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের যুদ্ধ, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধিকার অর্জনের যুদ্ধ। তাই সারাদেশের মানুষই হলো যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা, কেবল গুটিকয়েক বিশ্বাসঘাতক ও রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছাড়া। তাই ড. মল্লিকের অভিমত হলো, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার যে কার্যক্রম এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতি প্রণয়ন করতে হবে সেটাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে জনগণের মনোবল সংহতি এবং একতাবদ্ধতার উপর। তিনি বলেন, আমরা যদি আমাদের জনগণের মনোবল দৃঢ় রাখতে পারি, তাদের মধ্যে ইস্পাত কঠিন সংহতি ও ঐক্য বজায় রাখতে পারি তাহলে তারা স্বাধীনতার জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে এতটুকু দ্বিধা করবে না, ফলে জনগণের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা আরও বেশি জোরকদমে এগিয়ে যাবে হানাদার পাক বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকারদের প্রতিহত ও নির্মূল করার অভিযানে আর আমাদের বিজয় হবে আরও ত্বরান্বিত। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই ছিল গ্রামে বসবাসকারী সাধারণ পরিবারের ছেলে। কেউ ছোটখাটো চাকরিজীবী, কেউ কেউ বেকার যুবক, আবার অনেকে স্কুল-কলেজের ছাত্র। অধিকাংশের আবার হয়ত পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতাও ছিল না। তবু দেশের ওই দুর্যোগ মুহূর্তে দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে তারা এগিয়ে এসেছে জীবনের মায়া ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। এদের অনেকেই হয়ত ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, আবার অনেকেই ছিল হয়ত পরিবারের একমাত্র ছেলে। তাই প্রবাসী সরকারের কাছে ড. মল্লিকের উপদেশ ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং অন্যান্য গণমাধ্যমে সরকারের তরফ থেকে মাঝে মধ্যে একটা বার্তা প্রচার করা যেÑ হানাদার পাকবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগী রাজাকার বাহিনীর বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে যাচ্ছেন এবং ভবিষ্যতে যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবেন তাদের প্রত্যেকের এবং তাদের পরিবারের সকলের দায়িত্ব প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের যে মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা হতাহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তাদেরও দায়িত্বভার গ্রহণ করবে সরকার। তিনি বললেন, এতে বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা আরও বেশি অনুপ্রাণিত হবে আরও সক্রিয়ভাবে যুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর অভিযান প্রতিহত করতে তেমনিভাবে আরও বেশি ছেলেরা ও মেয়েরা এবং এগিয়ে আসবে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হওয়ার জন্য। ড. মল্লিকের সর্বশেষ উপদেশ ছিল সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার দায়িত্ব যারা পালন করবে তাদের তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রেস ইনফরমেশন বিভাগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহির্প্রচার ইউনিট এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মতো আরও যে সমস্ত সংশ্লিষ্ট বিভাগে কর্মরত আছেন তাদের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কর্মসূচী প্রদান ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার কাজটি করা হলে সেটা আরও বেশি কার্যকর হবে। সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদের খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ড. এ আর মল্লিকের চিঠি নিয়ে পরের দিন অফিস সময়ের শুরুর দিকেই দেখা করতে গেলাম তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদের খানের সঙ্গে। তিনি চিঠিটা পড়ে প্রায় ১৫-২০ মিনিট আমার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বললেন। জানতে চাইলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে কোথায় কি কাজ করেছি? যখন বললাম, ১৯৬৮ সালে সরকারী কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগদান করার পূর্বে পাঁচ বছরের মতো সময় ঢাকার ইংরেজী দৈনিক মর্নিং নিউজ, করাচীর ডন এবং রাওয়ালপি-ি থেকে প্রকাশিত পাকিস্তান টাইমসে সাংবাদিকতা করেছি। প্রতিরক্ষা সচিব সামাদ সাহেবকে কিভাবে চিনি জানতে চাইলে যখন বললাম যে, আওয়ামী লীগ নেতা কেএম ওবায়দুর রহমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অফিসে অনুষ্ঠিত সভায় আমার সাংবাদিকতা বিষয়ে অভিজ্ঞতার বিষয়টি বিবেচনা করে আমাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার পরিচালনার দায়িত্ব পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে প্রতিরক্ষা সচিবের কাছে প্রেরণ করেন। পূর্বে তার সঙ্গে আমার কোন পরিচয় ছিল না। তিনি তখন জানতে চাইলেন মুজিবনগর সরকারের অন্য কোন কর্মকর্তাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি কি-না। বললাম, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব আকবর আলি খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহপাঠী ছিলেন এবং কামালউদ্দিন সিদ্দিকী, সাদাত হোসেন ও খসরুজ্জামান চৌধুরীকে ছাত্রজীবন থেকেই ভালভাবে চিনি এবং এদের সবার কাছে সাংবাদিক হিসেবেই আমি বেশি পরিচিতি। এছাড়া আমার তিন সহপাঠী বন্ধু তওফিক এলাহী, মাহবুবউদ্দিন আহম্মদ ও ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করছে স্ব-স্ব সেক্টরে। আর এক সহপাঠী মাহমুদুর রহমান বেনু গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ঠিক রাখার দায়িত্ব পালন করে চলেছে। নুরুল কাদের খানের সঙ্গে আলাপ করে আমার মনে হলো তিনি একজন খুব উদ্যোগী সাহসী এবং দূরদর্শী কর্মকর্তা। তিনি জানালেন, এ বিষয়ে একটু চিন্তা করে নিজ হাতে লিখে কয়েকটি পয়েন্ট দেবেন আমাকে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিষয়ক কর্মপ্রণালী বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এবং পেপারটি ওইদিনই রাত আটটার দিকে তার অফিস থেকে আমাকে সংগ্রহ করতে বললেন। তিনি প্রথমেই উল্লেখ করলেন যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পক্ষ হিসেবে সব সময়ই বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সাংবিধানিকভাবে গঠিত প্রবাসী মুজিবনগর সরকারকেই বিবেচনা করতে হবে। দ্বিতীয় পক্ষ হিসেবে বিবেচনায় আনতে হবে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অনির্বাচিত, স্বঘোষিত স্বৈরাচারী সামরিক সরকারকে যার নেতৃত্বে রয়েছে জেনারেল ইয়াহিয়া ও তার সামরিক এবং বেসামরিক আমলাতন্ত্র ও তাদের নিয়ন্ত্রিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণকারী হানাদার পাক বাহিনী। তার মতে, তৃতীয় পক্ষ হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে গণমাধ্যমকে যার সদস্যরা প্রতিনিয়ত মূল্যায়ন করছে প্রকৃত পরিস্থিতিÑ একপক্ষ রয়েছে ন্যায়ের পক্ষে, সত্যের পক্ষে মানবতার পক্ষে আর অন্য পক্ষ অন্যায়, অবিচার, জুলুম ও সামরিক শক্তির জোরে ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রচেষ্টায় মেতে আছে। তাই বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের প্রতিফলিত মূল্যায়নে পরিবর্তিত হচ্ছে বিশ্ব জনমত। চলবে... লেখক : মুজিবনগর সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার প্রধানের দায়িত্ব পালনকারী
×