ডিজিটাল বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির সীমাহীন সম্ভাবনা-শক্তি কাজে লাগানোর এক অপরিমেয় সুযোগ তৈরি হয়েছে। সরকারের রাজনৈতিক ফোকাসে নিয়ে প্রযুক্তি ব্যবহারের এ রকম উদাহরণ বাংলাদেশ বাদে দ্বিতীয়টি এর আগে আর নেই। যদিও এখন অনেক দেশ একে নিজেদের দেশের উন্নয়ন ফোকাসে নিয়ে এসেছে। ফলে বাংলাদেশের জন্য ‘ডিজিটাল অপরচুনিটি’র সর্বোচ্চ সফল ব্যবহার অনেকটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। আর সেখানেও নানা উপাত্ত ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের সাফল্য অনেক বেশি। কারণ, বাংলাদেশ তার ফোকাসে নিয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন বা দেশের মানুষের কল্যাণ সাধন।
ডিজিটাল বাংলাদেশের সাফল্য পরিমাপ হতে পারে দুভাবে- একটি হলো এই রূপকল্পের চিন্তা বা দর্শন প্রণয়ন, আর দুই. এই রূপকল্পের কার্যকর ব্যবহার। যখন সময় হবে মহাকাল হয়তো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সে বিচার করবে; কিন্তু এখন যদি আমরা অন্যান্য দেশের অগ্রগতির পরিমাপের সঙ্গে মিলিয়ে আমাদের অগ্রগতি তুলনা করতে বসি আমার ধারণা আমরা গোড়াতেই ভুল করব। আমাদের অগ্রগতি বুঝতে হবে আমাদের মতো করে। কারণ অন্য দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়া, শিক্ষাব্যবস্থা ও কৃষ্টি চর্চার সঙ্গে এই বাংলাদেশ ভূ-খ-ের রয়েছে বিস্তর ফারাক। বাংলাদেশের প্রধান উপজীব্য মানুষ ও এর সংস্কৃতি। যেখানে অন্যান্য দেশে প্রধান নিয়ামক অর্থনীতি বা আয়। এমনকি আজকাল কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোও নিজেদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য দিয়ে বা জনসাধারণের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় নিয়ে সেই দেশের মানুষের সেবা চাহিদা পূরণের পরিকল্পনা করে। বাংলাদেশ তা করে না। কারণ এই দেশের উন্নয়ন সংস্কৃতি হলো মানুষের সুবিধা দিতে তার কাছে যাওয়া বা সেবা পৌঁছে দেয়া। চিন্তার এই বিকেন্দ্রীভূত বিকাশের কারণেই ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্পে কখনও কোন সেবা কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থায় পরিকল্পিত হয়নি। সব সেবাই প্রকারান্তরে ছড়িয়ে গেছে সারাদেশে।
দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রধান সাফল্য জনমানুষের চিন্তায় এর কার্যকরী প্রয়োগ। পৃথিবীর আর কোন দেশে, এমনকি উন্নত দেশেও মোবাইল ফোনের সর্বব্যাপী এমন ব্যবহার ঘটেনি। বাংলাদেশের সংস্কৃতি এমন যে, আন্তঃব্যক্তি যোগাযোগ এখানে মুখ্য। শিল্পোন্নত দেশগুলোর মতো জনবিচ্ছিন্ন বা তাদের সংজ্ঞায়িত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ এদেশে বেদনার জন্ম দিয়েছে ঠিকই; কিন্তু প্রভাবিত করতে পারেনি। যে কারণে সম্পদ শক্তির পশ্চিমা স্বার্থবুদ্ধি আমাদের পরিবারগুলোকে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে; কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ অবিচ্ছিন্ন থাকতেই পছন্দ করছে। শত চেষ্টা করেও এদেশে বৃদ্ধাশ্রম নামের সংস্কৃতি আমরা গ্রহণ করতে পারছি না। ভেতরের রক্তক্ষরণ নিয়ে হলেও ভাই বোনের খবর নিচ্ছে, বোন ভাইয়ের, পিতা-মাতার, আত্মীয়-স্বজনের, এমনকি শত্রু অসুস্থ হলেও তার। এটাই বাঙালীর কল্যাণ ধর্ম, এর বাইরে তার আর কোন ধর্ম নেই। এদেশের মানুষের যে যূথবদ্ধ জীবনাচার সেটা মিলনের, বিচ্ছেদের নয়। প্রযুক্তি সে মিলনাকাক্সক্ষাকেই নিশ্চিত করেছে, অন্য দেশে যেটা হয়নি।
বিদেশের যান্ত্রিক জীবনে দেখেছি ও অবাক হয়েছি কেউ ফোন করলে আগে থেকে এ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়, সেই অনুযায়ী তারা কথা বলে। আর আমাদের দেশে পথ চলতে চলতে কারও সঙ্গে পরিচিত হলে আমরা নানা গল্প করি, শেষে ফোন নম্বর বিনিময় করি। এর যে অপচর্চা হয় না তা নয়। কিন্তু এটাই আমাদের সম্পদ যে, আমরা কাছাকাছি থাকতে ভালবাসি, ‘ভাই ওই যে পরিচয় হয়েছিল’- বলে আলাপ শুরু করি আর। সে আলাপ পারিবারিক বন্ধুত্বে পরিণত হয় এমন উদাহরণ আমাদের দেশে অনেক আছে। এই যে মানবিক সম্পর্ক, প্রযুক্তি আমাদের ভিত তাতে মোটেই দুর্বল করে দিতে পারেনি, উল্টো আরও দৃঢ় করেছে। এটা ডিজিটাল বাংলাদেশের এক অনন্য সফল উদাহরণ।
মোবাইল ফোনের যেসব সেবা এখন পর্যন্ত পাওয়া সম্ভব সেসবের প্রায় সব ক’টি আমাদের দেশে আমরা কমবেশি চালু করে ফেলেছি। সবচেয়ে বড় সাফল্য এসেছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ব্যাংকিং বা টাকা-পয়সা লেনদেন। প্রতিদিন সামান্য খরচ দিয়ে প্রধানত স্বল্প আয়ের মানুষই হাজার কোটি টাকা লেনদেন করছে। এতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন যা-ই হোক বা গ্রামীণ অর্থনীতির চলৎশক্তি যতই বৃদ্ধি পাক, পরিবারের বা সমাজের আর্থিক আন্তঃসম্পর্ক বেড়েছে বা নিশ্চিত হয়েছে এই কথা যে কেউ স্বীকার করবেন। বাংলাদেশের জন্য কি এটা অস্বাভাবিক ছিল না? পৃথিবীর আর কোন দেশে কি এমন ঘটনা ঘটে যে, পথের মধ্যে দরকার হলে কাউকে ফোন দিলে মুহূর্তে টাকা পৌঁছে যায়? অনেক দেশ এই উদাহরণকে ব্যবসা হিসেবে নিয়ে চালু করতে চাইছে বটে; কিন্তু বাংলাদেশ এমন এক উদাহরণ কিছুদিন আগে তৈরি করে ফেলেছেÑ বিশ্বের এক নামকরা পুঁজি বিনিয়োগ করা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের মোবাইল লেনদেনের ব্যবসায় পার্টনার হতে চেয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘরে তার সাফল্য রেখে দিতে পেরেছে ও অন্যদের শেখাচ্ছে।
ইন্টারনেট সেবায়ও বাংলাদেশের মানুষ ভাল করে অভ্যস্ত হচ্ছে। শিখে নিচ্ছে এর সুবিধাগুলো কেমন করে আমাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিতে পারে। ইন্টারনেট চালু হওয়ার পরে দুনিয়াব্যাপী একটা কথা জোরেশোরে চলছিল আর তা হলো ‘এনেব্লিং এনভায়রনমেন্ট’ বা উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে দেয়াই হবে সরকারগুলোর প্রধান কাজ। এর ফলে ইন্টারনেট বিকাশে যেসব সমস্যা সামনে এসে হাজির হবে সেগুলো ঠিকঠাক করে নেয়া যাবে। বাংলাদেশে ইন্টারনেট চালুর প্রথম পর্বে কিছুটা হোঁচট ছিল। কারণ এর মর্ম বুঝতে না পারা ও বণিক শ্রেণীর অতিরিক্ত মুনাফা চিন্তা। বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের সবচেয়ে জরুরী যে কাজটা করেছে তা হলো ইন্টারনেটের জন্য একটি ‘এনেব্লিং এনভায়রনমেন্ট’ তৈরি করে দেয়া ও এর দাম কমিয়ে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসবার সুযোগ তৈরি করে দেয়া। ফলে সীমিত সাধ্যের মধ্যে থেকেই এদেশের সাধারণ মানুষ ইন্টারনেটের সুবিধা পেতে শুরু করেছে, বিশেষ করে সরকারী অফিসের কাজকর্মের তথ্য, ভূমির রেকর্ড বা স্বাস্থ্য সুবিধা পেতে ইন্টারনেট বড় ভূমিকা পালন করছে। আয়-রোজগারে প্রতিদিন তরুণরা সৃজনশীল উদ্যোগ নিচ্ছে। একটা উদাহরণ তো সারা দুনিয়ায় হৈচৈ ফেলে দিয়েছে যে, বাংলাদেশের তিনজন বেকার বন্ধু ‘পাঠাও’ বানিয়ে কেমন করে রাইড শেয়ারিং ব্যবসা চালু করে ফেলল, যে ব্যবসা কি-না ৩ বছরে ৮২০ কোটি টাকার ব্যবসায় দাঁড়িয়ে গেছে! একবার চিন্তা করে দেখুন এই ব্যবসায় কত শত তরুণের কর্মসংস্থান হয়েছে আর কতগুলো সাধারণ পরিবার তার সুবিধা পাচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সাফল্য বিবেচনা করতে কি কয়েক শ’ পৃষ্ঠার মূল্যায়নপত্র লিখতে হবে?
মানবিক বাংলাদেশে প্রযুক্তি কখনও আমাদের গ্রাস করতে পারবে না, যদি আমরা প্রযুক্তিকে বশে রাখতে পারি। অনেক অভিভাবক ছেলেমেয়েদের মোবাইল, ইন্টারনেট ও কম্পিউটার ব্যবহার নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন কী জানি কোন বিপদে পড়ে। এর সমাধান খুব সহজ। ঘরে ঘরে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের নিয়ম-কানুনগুলো জেনে রাখা। ‘পেরেন্টাল গাইডেন্স’ বলে একটা কথা আছে অর্থাৎ আপনি ছেলেমেয়েদের কতটুকু ব্যবহার করতে দেবেন বা সে কখন কতটুকু ব্যবহার করবে তার প্রতি লক্ষ্য রাখা। পিতা-মাতা বা অভিভাবক হিসেবে এটুকু দায়িত্ব তো পালন করতেই হবে। বাকিটুকু করবে স্কুল আর সমাজ। সমাজের নিয়ম-কানুন মেনে চলা তো আমাদের ঐতিহ্য। আপনার আমার ছেলেমেয়ে নিশ্চয়ই তার বিপরীতে কোন অন্যায় করুক আমরা তা ঘটতে দিতে পারি না। সমাজবদ্ধ বাঙালী জনমানসে আমরা যেন এমন সংস্কৃতির দাসও না হয়ে পড়ি সে দায়িত্বও আমাদের। সরকারের কাজ সরকার করেছে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সব সরকার করে দেবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্পের এটাই বড় বৈশিষ্ট্য যে, এই রূপকল্প একটি দর্শনের প্রয়োগ, যা বাংলাদেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখাবে একটি মানবিক বাংলাদেশের, যেখানে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বৈষম্য থাকবে না। আর তা অর্জন করতে আমাদের শিখে নিতে হবে ডিজিটাল প্রযুক্তির সব সেবা কেমন করে পেতে হয় ও ব্যবহার করতে হয়। আমরা এখন যে জ্ঞান সমাজে প্রবেশ করেছি সেখানে এই প্রচেষ্টা মোটেও আর কঠিন নয়।
লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প
[email protected]
শীর্ষ সংবাদ: