ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মতপার্থক্য হওয়ায় বি চৌধুরী যাননি

পাঁচ দাবি ও নয় লক্ষ্য ঘোষণা জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, যুক্তফ্রন্টের

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

পাঁচ দাবি ও নয় লক্ষ্য ঘোষণা জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, যুক্তফ্রন্টের

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেদের দাবি দাওয়া উপস্থাপন করেছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া ও ডাঃ এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট। সংগঠনটি তাদের ৫ দফা দাবি ও ৯ দফা লক্ষ্য ঘোষণা করেছে। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম ঘোষণার সময় শরিক দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতার পক্ষের সবাইকে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। শনিবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত জনাকীর্ণ এক সংবাদ সম্মেলনে এ আহ্বান জানানো হয়েছে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সংবাদ সম্মেলন করার কথা থাকলেও সেখানে তাদের অনুষ্ঠান করতে না দেয়ায় পরে জাতীয় প্রেসক্লাবে তারা এ ঘোষণা দেন। দাবিগুলো হলো : আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে বর্তমান সংসদ ভেঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন। নির্বাচনকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা প্রার্থী হতে পারবেন না। ২. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। ৩. কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রছাত্রীসহ সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের মুক্তি দিতে হবে। এখন থেকে নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা যাবে না। ৪. নির্বাচনের এক মাস আগে থেকে নির্বাচনের পর ১০ দিন পর্যন্ত মোট ৪০ দিন প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দিতে হবে। ৫. নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের চিন্তা ও পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর যুগোপযোগী সংশোধন করতে হবে। জাতীয় ঐক্য নয়টি লক্ষ্যের কথাও জানিয়েছে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলে তারা কী করবে, এই লক্ষ্যে তা বলা হয়েছে। তাদের লক্ষ্য হলো : ১. বাংলাদেশে স্বেচ্ছাচারী শাসন ব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণ এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্বাহী ক্ষমতা অবসানের লক্ষ্যে সংসদ, সরকার, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, ন্যায়পাল নিয়োগ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কার্যকর করা। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও সৎ যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক কমিশন গঠন করা। ২. দুর্নীতি দমন কমিশনকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করা। দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তুলে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে দুর্নীতি কঠোর হাতে দমন ও দুর্নীতির দায়ে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা। ৩. বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি, বেকারত্বের অবসান ও শিক্ষিত যুব সমাজের সৃজনশীলতা ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাকে একমাত্র যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা। ৪. কৃষক-শ্রমিক ও দরিদ্র মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সরকারী অর্থায়নে সুনিশ্চিত করা। ৫. জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় সরকারসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতি ও দলীয়করণ থেকে মুক্ত করা। ৬. বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা আনা, সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, সুষম বণ্টন ও জনকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা। ৭. জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য গঠন এবং প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও নেতিবাচক রাজনীতির বিপরীতে ইতিবাচক সৃজনশীল এবং কার্যকর ভারসাম্যের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা। ৮. ‘সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’Ñ এই নীতির আলোকে পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা। এই নীতির আলোকে জনস্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তাকে সমুন্নত রেখে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সমতার ভিত্তিতে ব্যবসা বাণিজ্য, যোগাযোগ ও বিনিয়োগ ইত্যাদির ক্ষেত্রে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া। ৯. বিশ্বের সব প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আধুনিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও সমর সম্ভারে সুসজ্জিত, সুসংগঠিত ও যুগোপযোগী করা। জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার লক্ষ্য ও দাবি ঘোষণা করেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই জাসদের সভাপতি আ স ম আব্দুর রব সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি বি চৌধুরী প্রেসক্লাবের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে, এজন্য তিনি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি। রবের এই ঘোষণার আগে প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে বসে একাধিকবার টেলিফোন করেও আ স ম আব্দুর রব বি চৌধুরীকে অনুষ্ঠানে আসার অনুরোধ জানান। তবে বি চৌধুরী সরাসরি অনুষ্ঠানে যোগদান করবেন না বলে তাকে জানিয়ে দেন। তার কারণ পাঁচ দফা দাবিতে বি চৌধুুরীর প্রস্তাবিত ‘রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের ক্ষমতা ভারসাম্য’ কথাটি রাখা হয়নি। এ কারণে মূলত বদরুদ্দোজা চৌধুরী সংবাদ সম্মেলনে যোগদান করেননি। সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন বিষয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করতে গেলে মঞ্চে উপস্থিত আ স ম আব্দুর রব, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ও মাহমুদুর রহমান মান্না সরাসরি ঘোষণা দেন, আজকের সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের কোন প্রশ্ন গ্রহণ করা হবে না। এর আগে আ স ম আব্দুর রব বি চৌধুরীর ব্যাপারে তার আগের বক্তব্য পরিবর্তন করে বলেন, বি চৌধুরী যখনই জানতে পেরেছেন আমাদের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে দেয়া হবে না। একথা শুনে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সংবাদ সম্মেলনের আগে প্রেসক্লাবের সামনে সমবেত হয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারের উদ্দেশ্যে দলবল নিয়ে রওনা হন যুক্তফ্রন্টের নেতারা। তবে বিশ কদমের মতো গিয়ে আব্দুর রব ঘোষণা দেন, আমাদের শহীদ মিনারে না যাওয়ার জন্য বলা হয়েছে। কারণ পুলিশ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ঘিরে রেখেছে। আমরা ধস্তাধস্তি-ধাক্কাধাক্কির রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। ফলে আমরা ফিরে এসেছি। তবে আমাদের যারা যেতে দেয়নি, তাদের ওপর যেন আল্লার গজব নেমে আসে। অনুষ্ঠানে বিশৃঙ্খলার মধ্যেই বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য করার লক্ষ্যে যুক্তফ্রন্ট, জাসদ ও নাগরিক ঐক্যের নেতারা তাদের পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেন। একই সঙ্গে তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যও ঘোষণা করেন। সংবাদ সম্মেলনে ড. কামাল হোসেন বলেন, এই দেশের মালিক জনগণ। দেশের মালিকদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারলে দেশ রক্ষা পাবে, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত ও কালো টাকার প্রভাবমুক্ত হবে। রাষ্ট্র-সমাজ আগ্রাসন থেকে মুক্ত হবে। জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিরা দেশের মালিকদের ভোটে নির্বাচিত হবে। তিনি বলেন, কার্যকর গণতন্ত্র, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সুষ্ঠু নির্বাচনের কোন বিকল্প নেই। নির্বাচনে ভেজাল হলে দেশের মালিক আর জনগণ থাকে না। এ ছাড়া আগামী তিন বছর পর স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি হবে উল্লেখ করে ড. কামাল বলেন, আমরা এ তিন বছরের মধ্যে দেশে কার্যকর গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও দেশের মালিক যে জনগণ তা প্রতিষ্ঠা করব। মানুষের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করব। ব্যক্তির বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনব। স্বাধীনতার পক্ষের সকল শক্তিতে তাদের এই প্ল্যাট ফরমে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জেএসডির সভাপতি আ স ম আব্দুর রব, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক রতন, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, ‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া’র সদস্য সচিব আ ব ম মোস্তফা আমিন, বিকল্প ধারার সাংগঠনিক সম্পাদক চৌধুরী ওমর ফারুক প্রমুখ।
×