ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইতোপূর্বে অমিত শাহ ফোন করেছেন খালেদাকে, মার্কিন কংগ্রেসম্যানের বিবৃতি সবই ছিল মিথ্যা ;###;দেশ ও দেশের রাজনীতির জন্য লজ্জার

এবারও মিথ্যাচার ॥ মির্জা ফখরুলকে জাতিসংঘে আমন্ত্রণ!

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮

এবারও মিথ্যাচার ॥ মির্জা ফখরুলকে জাতিসংঘে আমন্ত্রণ!

বিভাষ বাড়ৈ ॥ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ’র পর এবার খোদ জাতিসংঘের মহাসচিবের নামেও মিথ্যাচার করেছে বিএনপি। অমিত শাহের টেলিফোনের ভুয়া খবর ছড়িয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার পর একই রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে গিয়ে ধরা পড়েছে দলটির মিথ্যাচারের কূটনীতি। ‘জাতিসংঘের মহাসচিব বৈঠকের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে’- এ কথা বলে ঢাকঢোল পিটিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতিসংঘে গেলেও আসলে কোন আমন্ত্রণই জানাননি জাতিসংঘ মহাসচিব। বরং বিএনপির অনুরোধে মির্জা ফখরুলকে সাক্ষাত দিয়েছেন জাতিসংঘের এক সহকারী মহাসচিব। জাতিসংঘ বলছে, বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মাঝেমধ্যেই সহকারী মহাসচিব বৈঠক করেন, এটি তার ব্যতিক্রম নয়। এদিকে ভারতের পর এবার খোদ জাতিসংঘের নাম ভাঙ্গিয়ে মিথ্যাচারের এ রাজনীতি খোদ বিএনপি সমর্থকদেরও লজ্জায় ফেলেছে। দু’এজজন নেতা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মিথ্যাচারকে কৌশলে আড়াল করার চেষ্টা করলেও অধিকাংশই বিব্রতকর অবস্থায় পরে বলছেন, তারা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। কেউ কেউ বলছেন, কেবল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরই দেশে ফিরে বলতে পারবেন আসলে কি হয়েছে? কেন এমন হয়েছে? দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিএনপির এমন মনোভাবকে দেশ ও দেশের রাজনীতির জন্য অশনিসঙ্কেত হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, তারা যে কাজ করেছে তা দেশের জন্য দেশের রাজনীতির জন্য চরম লজ্জার। আর দেশ ও রাজনীতিকে লজ্জার ফেলেছে বিএনপি। দলটির দেউলিয়াত্ব আজ এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, মিথ্যাচার করে বারবার ধরা খেলেও স্বভাব পাল্টাচ্ছে না দলটি। এ ধরনের কর্মকা- সাধারণ মানুষ পছন্দ করেন না উল্লেখ করে বিএনপিকে মনোভাব পাল্টনোর পরামর্শ দিয়েছেন বিএনপি সমর্থক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবীরাও। এর আগে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তিতে বিএনপির পক্ষ থেকে অবরোধ কর্মসূচী দেয়া হয়। কর্মসূচী চলাকালে হঠাৎ করে রাতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ ফোন করেন বলে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। বিএনপির চেয়ারপার্সনের প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান সে সময় জানিয়েছিলেন, খালেদা জিয়াকে ভারতের বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ টেলিফোন করেছেন এবং অমিত শাহ টেলিফোনে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিয়েছেন। এ বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে একটি প্রেস বিবৃতিও প্রকাশ করা হয়। সেই প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বিএনপি চেয়ারপার্সন জিয়ার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিয়েছেন ভারতীয় জনতা দল (বিজেপি) সভাপতি অমিত শাহ। তিনি ফোনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। বিষয়টি নিয়ে দেশের মানুষের কাছে ভারত তাদের পাশে আছে বলে বার্তা দেয়ার চেষ্টা করে বিএনপি। প্রথমে কিছুটা সফলও হয়। কিন্তু পরে দেখা গেল, অমিত শাহ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে কোন ফোনই করেননি। বরং নয়াদিল্লীর বিজেপি অফিসে খালেদা জিয়ার অফিস থেকে দু’দফা ফোন করলেও কেউ তা রিসিভ করেননি। এর কিছুদিন পর খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানকে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যানদের নামে ভুয়া বিবৃতি প্রকাশ করার ঘটনাও ধরা পড়ে। বিএনপি ওই মিথ্যা বিবৃতি প্রকাশ করায় ক্ষোভও প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যানরা। ওই সময় দেশজুড়ে হাসির পাত্রে পরিণত হলেও দলটির মিথ্যাচারের খেলা যে বন্ধ হয়নি তার প্রমাণ এবার আবারও দেখাল দলটি। এবারও ক’দিন ধরে বিএনপির প্রচার করেছে জাতিসংঘের মহাসচিব তাদের দলের মহাসচিবকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এজন্য জাতিসংঘ মহাসচিব চিঠিও দিয়েছেন বলে জানানো হয়। জাতিসংঘে গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও আগামী নির্বাচনে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ চাওয়া হবে বলে সরকারকে বিভিন্নভাবে হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়। এভাবে ঢাকঢোল পিটিয়েই এবার জাতিসংঘে গেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরল। বছর শেষে অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে জাতিসংঘ মহাসচিবের আমন্ত্রণে বিএনপির মহাসচিবের এই সফর দেশে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার সৃষ্টি করে। কিন্তু তথ্য শেষ পর্যন্ত জানা গেল, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে কোন আমন্ত্রণ জানাননি জাতিসংঘ মহাসচিব। বরং বিএনপির অনুরোধে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে আলোচনা করেছেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব মিরোস্লেভ জানকো। এ কথা জানিয়েছেন তার অফিসের স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন অফিসার জোয়স লুইস ডায়াজ। এ মির্জা ফখরুলের এই সফর নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আর এই প্রশ্ন বড় হয়ে ওঠে ফখরুলের এই সফরের সময় খোদ জাতিসংঘের মহাসচিরের যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান না করার বিষয়টি। জাতিসংঘের সদর দফতরের তথ্য বলছে, এই মুহূর্তে গুতেরেস অবস্থান করছে আফ্রিকান দেশ ঘানায়। সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কোফি আনানের শেষকৃত্যে অংশ নিচ্ছেন। মহাসচিবের ডেপুটি মুখপাত্র ফারহান হকও বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, মির্জা ফখরুলের সঙ্গে কোন বৈঠকের তথ্য জানা নেই তার। তবে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় জাতিসংঘ সদর দফতরে বৈঠক করেছেন, সহকারী মহাসচিব মিরোস্লেভ জানকোর সঙ্গে। ফখরুলের এই সফর জাতিসংঘ মহাসচিবের আমন্ত্রণে বলে তার দলের নেতাদের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও বিশ্ব সংস্থাটির দফতর জানিয়ে দিয়েছে, বিএনপির উদ্যোগেই এই বৈঠক হয়েছে। জানা গেছে, জাতিসংঘে পদমর্যাদায় আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলের পরে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল বা সহকারী মহাসচিবদের অবস্থান। পদমর্যাদায় জাতিসংঘ মহাসচিবের পরে রয়েছেন একজন উপ-মহাসচিব; তার নিচে রয়েছেন বর্তমানে ২১ জন আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল। এই আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলদের সহায়তায় রয়েছেন বিভাগভিত্তিক অনেক সহকারী মহাসচিব। এমন পরিস্থিতিতে কি ভাবছে বিএনপি? দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ দাবি করছেন, ‘জাতিসংঘ মহাসচিব যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন তখন সময়ের অভাবে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেননি। সেজন্য তিনি বিএনপিকে আমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন। এর প্রেক্ষিতেই আমাদের মহাসচিব নিউইয়র্ক গেছেন, নিজের থেকে যাননি। দাওয়াত দিয়েছেন তাই গিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে এই মুহূর্তে বিএনপির নেতারা চুপ থাকার কৌশল নিয়েছে। দু’একজন কথা বললেও বিব্রতকর অবস্থায় পরে বলছেন কৌশলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। দলটির প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক এবিএম মোশারফ হোসেন বলছিলেন, কোন পর্যায়ে কিভাবে বৈঠক হয়েছে তা আমাদের দলের মহাসচিব না আসলে পরিষ্কার করে বলা যাচ্ছে না। উনি এসে জানালে বিষয়টি খোলাসা করা যাবে। দলের যেকোন কর্মসূচী দফতর থেকে ঘোষিত হলেও মির্জা ফখরুলের জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে দেখা বা বৈঠকের বিষয়ে কিছু ‘জানেন না’ বলে ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীও। চেয়ারপার্সন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, মির্জা ফখরুলকে জাতিসংঘ মহাসচিব আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কি-না তা তিনিই ভাল বলতে পারবেন। এ নিয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। তিনি না আসা পর্যন্ত বলাও হবে না। এদিকে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বিএনপির এমন মনোভাবকে দেশ ও দেশের রাজনীতির জন্য অশনিসঙ্কেত হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, তারা যে কাজ করেছে তা দেশ ও দেশের রাজনীতিকে চরম লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে। এ ধরনের কর্মকা- কাক্সিক্ষত নয় বলে মন্তব্য করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলছিলেন, এটার মধ্য দিয়ে বিএনপি একটি অপেশাদার মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে। বিশিষ্টজন সৈয়দ আবুল মকসুদ বিএনপির কর্মকা-ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, জাতিসংঘের মহাসচিবের আমন্ত্রণে যাচ্ছি এ কথা বলার পর জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের কাছে বিষয়টি একটি হাস্যকর বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। তারা ভাববে ওরা (বিএনপি) আমাদের ওপর এতটাই নির্ভরশীল যে নিজেদের বিষয় নিয়ে এই কাজ করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শিক্ষাবিদ ড. এ জে এম সফিউল্লাহ ভূঁইয়া বলছিলেন, অমিত শাহকে নিয়েও বিএনপি এ মিথ্যাচার করেছে। বিএনপির আন্দোলনের প্রতি বিদেশীদের সহানুভূতি রয়েছে এমন ভুল বার্তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার কৌশল হিসেবেই মিথ্যাচার করা হয়েছে। এর ফলে বিএনপির আন্দোলনের দেউলিয়াত্ব প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। হিতে বিপরীত হয়েছে। আসলে দলটি নিজেরাই প্রমাণ দিচ্ছে দেশের জনগণের প্রতি তাদের কোন দায় নেই। জনগণের ওপর কোন নির্বরতাও নেই। নিজেদের কাজের মধ্য দিয়েই দলটি। তার প্রমাণ আবারও দিয়েছে। এটা বিএনপির চরম দেউয়াত্বেও বহির্প্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। আমার প্রশ্ন হচ্ছে জাতিসংঘ আমন্ত্রণ জানালে জানাবে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীকে। উনি তো সরকারের কেউ নন। তাকে আমন্ত্রণ জানানোর প্রশ্নও আসে না। আওয়ামী লীগের উপ-দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া বলছিলেন, দেশের মানুষ বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। বিএনপি দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ঘোষণা দিল ইউএন মহাসচিব নাকি আমন্ত্রণ জানিয়েছে। অথচ জানা গেল এটা মিথ্যা। বরং জাতিসংঘ মহাসচিব এখন আছেন ঘানায়। নিজেরা চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেন সহকারী মহাসচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করেছেন। বিএনপি যে কাজ করেছে এতে দেশের মানুষকে লজ্জায় ফেলেছে। এটা চরম লজ্জার। আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং দলের অন্যতম মুখপাত্র হাছান মাহমুদ এক অনুষ্ঠানে অভিযোগ করেছেন, বিএনপির নেতারা জাতিসংঘে গিয়ে সর্বনিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা সহকারী মহাসচিবের সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি বলেছেন, এটা দেশের জনগণের সঙ্গে ‘ভাওতাবাজি’ ছাড়া অন্য কিছু নয়। জাতিসংঘের মহাসচিব নাকি বিএনপি নেতাদের ডেকেছেন? জাতিসংঘের মহাসচিব আফ্রিকায়। বিএনপির নেতারা দেখা করলেন জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিবের সঙ্গে। বাংলাদেশে বিসিএসের মাধ্যমে কেউ প্রশাসনে চাকরি নিলে সর্বপ্রথম সহকারী সচিব হিসেবে নিয়োগ পান। তেমনি জাতিসংঘেরও সহকারী মহাসচিব সর্বনিম্ন বা প্রাথমিক পদবি। তিনি বলেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম সাহেবকে যখন সাংবাদিকেরা জিজ্ঞেস করলেন, কী আলোচনা হয়েছে? তিনি আমতা-আমতা করে কিছুই বলতে পারলেন না।
×