ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রথম পর্যায়ে নির্মিত হচ্ছে ১২০ গুচ্ছগ্রাম ১৪৪০ ব্যারাক হাউস

ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর কার্যক্রম চলছে জোরেশোরে

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

   ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর কার্যক্রম চলছে  জোরেশোরে

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের ক্ষুদ্র একটি অংশ নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরে স্থানান্তরের কার্যক্রম চলছে বেশ জোরেশোরে। ২০১৭ সালে একনেক বৈঠকে এ নিয়ে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকার যে প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয় তার বাস্তবায়ন কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বহুল আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে যে, যেখানে লাখ লাখ রোহিঙ্গা অর্থাৎ নতুন পুরনো মিলিয়ে বর্তমানে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলে আশ্রয় শিবির, শরণার্থী শিবির, বস্তিসহ বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সেখানে সরকারী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথম দফায় ১ লাখ ৩ হাজার ২শ রোহিঙ্গাকে দুই দশক আগে জেগে ওঠা এই চরে স্থানান্তরের উদ্যোগ সফল হবে কিনা। আর ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার মধ্যে এই ক্ষুদ্র সংখ্যক অর্থাৎ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে নেয়ার বিষয়টি সফল হলেও অবশিষ্টদের নিয়ে কী হবে। ইতোমধ্যে যাদের নেয়া হবে তাদের একটি তালিকাও প্রস্তুত করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী নেয়ার প্রাক্কালে এদের সকলকে পাওয়া যাবে কিনা সেটাও একটি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়েছে, মিয়ানমান পক্ষ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সমঝোতা চুক্তি করেও প্রকারান্তরে যেখানে দূরে সরে রয়েছে, সেখানে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের পাশাপাশি ত্রাণ সহায়তা প্রদান এবং এদের নানামুখী উৎপাত স্থানীয়দের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করে রেখেছে। প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে যে প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে তা এককভাবে বাস্তবায়ন করছে নৌবাহিনী। নৌবাহিনী প্রধানের পক্ষে আলাদা একটি সেল গঠন করে এ কার্যক্রমের তদারকি চলছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভাসানচরে ১২০টি গুচ্ছ গ্রামে ১ হাজার ৪৪০টি ব্যারাক হাউস এবং ১২০টি আশ্রয় কেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। এছাড়া থাকবে স্কুল, মাদ্রাসা, চিকিৎসা কেন্দ্রসহ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয়তার বিভিন্নমুখী ব্যবস্থা। উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রায় ২০ বছর আগে নোয়াখালীর হাতিয়া থেকে ২০ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে জেগে ওঠে জালিয়ারচর এবং ঠেঙ্গারচর নামে দুটি দ্বীপ। খুব কাছাকাছি হওয়ায় এই দুটি দ্বীপকে একত্রিত করে ভাসানচর নামকরণ করা হয়। ভাসানচরের আয়তন প্রায় ১৬ হাজার একর। এর মধ্যে জালিয়ারচর ৬ হাজার এবং ঠেঙ্গারচর ১০ হাজার। দ্বীপটি দৈর্ঘ্যে ৮ কিলোমিটার এবং প্রস্থে সাড়ে ৪ কিলোমিটার। হাতিয়া থেকে এ দ্বীপে পৌঁছতে সময় লাগে ৩ ঘণ্টার মতো। দ্বীপটি এখনও গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। জোয়ারের সময় এর কিছু অংশ প্লাবিত হয়। এদিকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের খবরে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে হাতিয়ার উপকূলে বসবাসকারীরা। তাদের আশঙ্কা এমন বৃহৎ একটি ভিনদেশী জনগোষ্ঠীর সদস্যদের এখানে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা হলে এলাকায় মাদকসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ের বিস্তার ঘটতে পারে। তাছাড়া সমুদ্রে মৎস্য আহরণসহ শ্রম নির্ভর জীবিকায় এরা ভাগ বসাতে পারে। স্থানীয়দের পক্ষে আরও বলা হয়েছে, এরপরও সরকার যেহেতু প্রথম দফায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে এই চরে স্থানান্তরের উদ্যোগ নিয়ে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে, সেক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিবেশসহ যাবতীয় কর্মকান্ড নিয়েও প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় ভূমিকা কার্যকর করতে পারে। স্থানীয়দের আশঙ্কা রোহিঙ্গাদের সেখানে অবস্থান দীর্ঘমেয়াদী হলে এদের জনসংখ্যা যেমন বাড়বে, তেমনি নানামুখী উৎপাতও বিস্তৃতি লাভ করবে- যা সামগ্রিক আত্মসামাজিক অবস্থায় বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। এদিকে উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের যত্রতত্র চলাফেরা এবং বন উজাড় করার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসন হিমশিম খাচ্ছে। নিজ দেশে প্রত্যাবাসন আর ভাসানচরে স্থানান্তর যাই হোক এ ধরনের বিষয় আঁচ করতে পেরে শতাধিক রোহিঙ্গার একটি দল দালালদের হাত ধরে সমুদ্র পথে পালিয়ে গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার হওয়ার সময় শিশুসহ ১৮ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ আটক হয়েছে আমড়াখালী চেকপোস্টের বিজিবি সদস্যদের হাতে। আটককৃতরা সকলেই উখিয়ার কুতুপালং আশ্রয় শিবিরের রোহিঙ্গা। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট বানাতে গিয়ে আটক হয়েছে দুই রোহিঙ্গা। এরা হচ্ছে যুবতী নুর কায়েস (২২) ও রাশিদা (২০)। এদিকে উখিয়া-টেকনাফের বন উজাড় করেই চলেছে রোহিঙ্গারা। শুধু গাছ নয়, গাছের চারা থেকে শুরু করে শেকড় পর্যন্ত তুলে নিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। এ প্রক্রিয়া কত দিন হাজার হাজার মণ জ্বালানি কাঠ উখিয়া-টেকনাফের বন থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে রোহিঙ্গারা। আগে যেখানে পাহাড় সবুজ ছিল অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা তা ন্যাড়া করে ফেলেছে। বর্তমানে উখিয়া-টেকনাফের বন জঙ্গল বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে উস্কানিমূলক বিভিন্ন তৎপরতা নানাভাবে ঘটে চলেছে। দেশী-বিদেশী এবং এনজিও সংস্থার পক্ষে এসব উস্কানিদানের অভিযোগ এন্থার। পাশাপাশি রয়েছে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী বিভিন্ন গ্রুপ। এরা মুখে বলে প্রত্যাবাসনে আগ্রহী। আবার দাবি দিয়ে রেখেছে মিয়ানমার তাদের নাগরিকত্ব না দিলে যাবে না। অনুরূপভাবে মিয়ানমারও বলে দিয়েছে নাগরিকত্বের প্রমাণ ছাড়া তারা কউকে নেবে না। এ অবস্থায় ভাসানচরে প্রাথমিকভাবে লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে স্থানান্তরের যে কর্মযজ্ঞ চলছে সে ব্যাপারেও উস্কানিমূলক তৎপরতা শুরু হয়েছে। ৩০ আশ্রয় শিবিরে ভাসানচরে না যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের মাঝে প্রচার চালানো হচ্ছে। অথচ সরকার পক্ষে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের জন্যও নানা প্রকল্পও গ্রহণ করেছে। সাগর থেকে আহরিত মৎস্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ বিভিন্ন প্রকল্প এবং এর পাশাপাশি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নানা কর্মে এদের নিয়োজিত করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে স্বভাবগতভাবে এরা এক প্রকার অস্বাভাবিক। শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে একেবারে পেছনের সারি। রাখাইন রাজ্যে থেকে এরা থেকেছে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর তালিকায়। সঙ্গত কারণে চোরাচালান, মাদক পাচার, মৎস্য আহরণ, কৃষি কাজ ইত্যাদি ছাড়া অন্য কোন কাজে এদের তেমন কোন সংশ্লিষ্টতা ছিল না।
×