ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

শাহজালালে ফের জব্দ ভয়ঙ্কর মাদক এনপিএস

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

  শাহজালালে ফের জব্দ ভয়ঙ্কর মাদক এনপিএস

গাফফার খান চৌধুরী ॥ হালের ভয়ঙ্কর মাদক এনপিএস বা খাত আসা বন্ধ করতে আমদানি করা গ্রীন টির ওপর স্থায়ীভাবে শর্তারোপ করতে যাচ্ছে সরকার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, কাস্টমস ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়া বিমানবন্দর থেকে গ্রীন টি ছাড় না করার সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। প্রতি সপ্তাহেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নতুন মাদক এনপিএস জব্দ হচ্ছে। এতে দিনকে দিন বিদেশে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। বিশ্বের কাছে বিমানবন্দরটি মাদক আনা নেয়ার ট্রানজিট রুট হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। এমন ঘটনায় রীতিমত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে বিমানবন্দরে। শুক্রবার আবারও ভয়ঙ্কর মাদক নিউ সাইকোট্রফিক সাবসটেনসেস বা এনপিএসের আরও একটি চালান জব্দ হয়েছে। এবার জব্দ হয়েছে ১২০ কেজি। চালানটি এবারও সেই নাজিমের নামেই ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবা থেকে এসেছে। তবে নাজিমের নামে কত বছর ধরে এখন পর্যন্ত কতটি চালান এসেছে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন তথ্য মেলেনি। নাজিমের নামে আসা আরও চালান আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চোখ ফাঁকি দিয়ে পাচার হয়ে গেছে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। এই নিয়ে মোট পাঁচটি চালান এলো এনপিএসের। শুক্রবার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ছয় কার্টনে আসা ১২০ কেজি খাত জব্দ করেছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। চালানটি রাজধানী ঢাকার কাকরাইলের আমদানি-রফতানিকারক মোহাম্মদ নাজিমের নামে এসেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা শাখা সূত্রে জানা গেছে, মাদকগুলো ইথিওপিয়া থেকে আমদানি করা হয়েছে। এর আগেও নাজিমের নামে গ্রীন টির প্যাকেটের মধ্যে খাত নামের এই মাদক এসেছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ৩১ আগস্ট শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ডাক বিভাগের সর্টিং এয়ারপোর্ট অফিসের গোডাউন থেকে ২৩ কার্টনে মোট ৪৬৮ কেজি এনপিএস নামক নতুন মাদক জব্দ হয়। পরে ওই মাদকের সঙ্গে যোগসূত্র থাকার তথ্য মোতাবেক আরেকটি অভিযানে ঢাকার কাকরাইল থেকে রাতেই আমদানি-রফতানিকারক ব্যবসায়ী দুবাই ফেরত মোহাম্মদ নাজিমকে গ্রেফতার করা হয়। নাজিমের তথ্য মোতাবেক শান্তিনগরে অভিযান চালিয়ে প্রায় চারশ’ কেজি এনপিএস উদ্ধার করা হয়। দুই দফায় চালানো অভিযানে মোট ৮৬১ কেজি এনপিএস জব্দ হয়। উদ্ধারকৃত মাদকের মূল্য প্রায় সোয়া কোটি টাকা। গত ৮ সেপ্টেম্বর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ইউনিটের ভেতরে অবস্থিত ফরেন পোস্ট অফিসের মাধ্যমে আসা ১৬০ কেজি এনপিএস জব্দ করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। ঢাকা কাস্টমস হাউসের ডেপুটি কমিশনার ওথেলো চৌধুরী জানান, এনএসআইর সহযোগিতায় গত ৬ সেপ্টেম্বর ভারত থেকে আসা জেট এয়ারওয়েজের একটি বিমানে চালানটি আসে। পণ্যগুলোর রফতানিকারকের নাম জিয়াদ মুহাম্মদ ইউসুফ, ঠিকানা আদ্দিস আবাবা, ইথিওপিয়া। আর আমদানিকারক হিসেবে লেখা রয়েছে রাজধানীর তুরাগ থানাধীন এশা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে। গত ১১ সেপ্টেম্বর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ফরেন পোস্ট অফিসের মাধ্যমে পার্সেল হিসেবে আসা ১৬শ’ কেজি এনপিএস জব্দ করে সিআইডি। মাদকগুলো ৯৬ কার্টনে ২০ ঠিকানায় গ্রীন টি নামে আনা হয়েছিল। ওইদিনই রাজধানীর মালিবাগ সিআইডি সদর দফতরে সংস্থাটির উপমহাপরিদর্শক শাহ আলম আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ব্যবসায়ীরা কৌশলে দেশে নতুন মাদক এনপিএস আনছে। মাদকটি দেখতে হালে দেশে খুবই জনপ্রিয় গ্রীন টির মতো। বিদেশ থেকে গ্রীন টি আমদানি হচ্ছে হরহামেশাই। গ্রীন টি আমদানি যেহেতু বৈধ, তাই গ্রীন টির প্যাকেটে করে গ্রেফতার এড়িয়ে মাদক মাফিয়ারা নিরাপদে মাদকটি দেশে আনছে। এ জন্য সম্প্রতি বিদেশ থেকে আমদানি করা গ্রীন টির ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। মাদকগুলো গ্রীন টির প্যাকেটের আড়ালেই আনা হয়েছিল। জব্দ হওয়া মাদকের আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ২ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও জানান, যে ঠিকানায় গ্রীন টি হিসেবে এনপিএসগুলো আমদানি করা হয়েছে, সেসব ঠিকানার যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। মাদকগুলো পোস্ট অফিসের মাধ্যমে আসায় যেগুলো কে পাঠিয়েছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত কোন তথ্য মেলেনি। আর বহনকারীও নেই। যারা এই মাদকের সঙ্গে জড়িত তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। জড়িতরা বিদেশে থাকা বাংলাদেশী নাগরিক হলে তাদের ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে আনার চেষ্টা করা হবে। আর জড়িতদের মধ্যে বিদেশী থাকলে সেই সব দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এই মাদকগুলো গুলিয়ে অথবা চিবিয়ে সেবন করা হয়। পাশাপাশি ইয়াবা তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে এই মাদকটি বিদেশে পাচার হওয়ার তথ্য মিলেছে। যদিও এখন পর্যন্ত কতটি চালান বিদেশে গেছে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন তথ্য মেলেনি। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফর ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য মোতাবেক অন্তত সাতটি চালান বাংলাদেশ হয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে। এতদিন মাদকগুলো দেশে জনপ্রিয় গ্রীন টির প্যাকেটে করে আসত। ফলে সহজেই চালানগুলো পার পেয়ে গেছে। দেশে মাদকটির প্রবেশ ঠেকাতে আমদানি করা গ্রীন টির ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গবেষণা ও নিরোধ শাখার মতে, ইয়াবার চেয়েও ভয়ঙ্কর এনপিএস। এটিকে বাংলায় খাত বলা হয়ে থাকে। ঢাকায় এই মাদক সেবনকারীদের সম্পর্কে কোন তথ্য মেলেনি। তবে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও অষ্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য পাশ্চাত্য দেশে এই মাদকের ব্যবহার তুলনামূলক বেশি। এক ধরনের গাছ থেকে এনপিএস তৈরি হয়। নতুন এই মাদক চায়ের পাতার গুঁড়োর মতো। পানির সঙ্গে মিশিয়ে তরল করে সেবন করা হয়। সেবনের পর মানবদেহে এক ধরনের সাময়িক উত্তেজনার সৃষ্টি করে। বহু পুরনো মাদক আফিম ও ভাংয়ের নেশার ধরনের সঙ্গে মিল আছে মাদকটির। দীর্ঘদিন সেবন করলে সেবনকারীর মধ্যে চরমভাবে একাকিত্ব ভর করে। মানসিকভাবে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। আসক্ত ব্যক্তি মানসিক বৈকল্যে ভুগতে থাকেন। সামাজিকভাবে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করে থাকেন। কর্মস্পৃহা হারিয়ে ফেলেন। বেঁচে থাকা অপ্রয়োজনীয় মনে করেন। এক সময় আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের তথ্য মতে, এনপিএস তৈরির উপাদানগুলো বৈধ হলেও এর ভয়াবহতার কারণে অনেক দেশ স্থায়ীভাবে এনপিএস নিয়ন্ত্রণ করছে। অনেক দেশ অস্থায়ীভাবে নিষিদ্ধও করেছে। এনপিএসের ব্যবহার ব্যাপকমাত্রা পেলে যুবসমাজ ধ্বংসের চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের অধিদফতরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দীন আহমেদের ভাষ্য, তারা ২০১৫ সালেই মাদকটি সম্পর্কে সরকারকে আগাম জানায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ভাষ্য, ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবা থেকে জিয়াদ মোহাম্মাদ ইউসুফ নামে এক ব্যক্তি ঢাকায় এনপিএসের চালানগুলো পাঠাচ্ছে বলে তথ্য মিলেছে। এদেশের নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে চালানগুলো পাঠানো হচ্ছে। ইথিওপিয়া থেকে কয়েকটি দেশ ঘুরে চালানগুলো হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসছে। এ ব্যাপারে ইথিওপিয়া সরকার ও সেদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা চলছে। যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হলে দেশটির রাজধানীর আদ্দিস আবাবা থেকে যারা মাদকগুলো পাঠাচ্ছে, তাদের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হবে। যদিও ধারণা করা হচ্ছে, ভুয়া নাম ঠিকানা ব্যবহার করে মাদকগুলো বাংলাদেশকে ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে পাচার করা হচ্ছে।
×