ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ব্যক্তি উদ্যোগে মানবকল্যাণ

অন্ধজন ফিরে পাচ্ছে আলো, দরিদ্র হচ্ছে স্বাবলম্বী...

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

অন্ধজন ফিরে পাচ্ছে আলো, দরিদ্র হচ্ছে স্বাবলম্বী...

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ অসময়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে একমাত্র পুত্র। শোকে দুচোখে অশ্রু ঝরছে সন্তানহারা মায়ের। দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে অন্ধ বরিশাল সদর উপজেলার টুঙ্গিবাড়িয়া ইউনিয়নের পতাং গ্রামের সেতারা বেগম। চিকিৎসার মাধ্যমে মায়ের চোখে আলো ফিরিয়ে আনতে চার মেয়ে ঘুরেছেন বিত্তবানদের দ্বারে দ্বারে। কিন্তু আশার আলো দেখাতে পারেননি কেউ। দুই চোখে আর কোনদিন আলোর দেখা মিলবে না, এমনটি ভেবে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন বৃদ্ধ সেতারা বেগম। অবশেষে আশার আলো হয়ে হাজির হয়েছেন আলহাজ সালাহউদ্দিন রিপন। বরিশালের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘এসআর সমাজকল্যাণ সংস্থা’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শিল্পপতি সালাহউদ্দিন রিপন। জটিল অস্ত্রপাচারের খরচ দিয়ে তিনি শুধু দৃষ্টিই ফেরাননি, সেতারা বেগমকে স্বাবলম্বী হতে সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিয়েছেন। ‘অন্ধজনে দেহ আলো’ শুধু গানের কথা নয়, বাস্তবেও প্রমাণ করে দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধু-প্রেমিক তরুণ সমাজসেবক আলহাজ সালাহউদ্দিন রিপন। চাষী পতাং গ্রামের আরেক বৃদ্ধ আশ্রাব আলী হাওলাদারও কয়েক বছর ধরে চোখে দেখতে পেতেন না। আজীবনের জাল বুননের পেশা ছাড়তে হয়েছে তাকে। ভিক্ষা করে খেয়ে না খেয়ে চলছিল তার জীবন। দুটি স্বাবলম্বী সন্তানও দৃষ্টিহীন বাবার চোখে আলো ফেরানোর উদ্যোগ নেয়নি। ‘বুড়ো মানুষ দৃষ্টিহীন হয়’ সাধারণ এ ধারণার শিকার হয়ে ৮১ বছর বয়সে আশ্রাবের অন্ধ চোখ দিয়ে কেবলই অশ্রু গড়িয়েছে। এসআর সমাজকল্যাণ সংস্থার সহায়তায় তিনিও ফিরে পেয়েছেন দৃষ্টিশক্তি। সুস্থ-সবল মানুষের মতো ফিরে গেছেন জাল বুননের পুরনো পেশায়। সংস্থার আর্থিক সহায়তায় বাড়ির পাশের রাস্তার ঢালে সবজির চাষ করেছেন আশ্রাব আলী। পতাং গ্রামের সেতারা ও আশ্রাবের মতো সদরের বিভিন্ন বয়সের আড়াই হাজার নারী-পুরুষ বিনা খরচে এসআর সমাজকল্যাণ সংস্থার সহায়তায় ফিরে পেয়েছেন দৃষ্টিশক্তি। সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন ও মহানগরীর সকল অসহায় দৃষ্টিহীনের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন ওয়ার্ডে চক্ষু শিবিরের আয়োজন করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে যাদের অপারেশনের প্রয়োজন তাদের স্থানীয় ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে ছানি ও কর্নিয়া অপারেশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। গত তিন মাসে বরিশাল সদর উপজেলা ও সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ১২ ক্যাম্পের মাধ্যমে প্রায় ১৮ হাজার রোগীর চোখের চিকিৎসা দেয়া হয়। এর মধ্যে আড়াই হাজার জনের চোখে ছানি, তিন শতাধিক রোগীর চোখে কর্নিয়া ও দুই শতাধিক ব্যক্তির নেত্রনালীর সমস্যা পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে ১২শ’ জনের চোখের ছানি, দুই শতাধিক কর্নিয়া ও ১৫০ জন রোগীর নেত্রনালী অপারেশনের মাধ্যমে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। প্রায় সাড়ে সাত হাজার জনকে ওষুধের পাশাপাশি নতুন চশমা দেয়া হয়েছে। এছাড়া নয় হাজারেরও বেশি রোগীকে চোখের ওষুধ দেয়া হয়েছে। রোগীরা প্রায়ই সংস্থার খরচে ইস্পাহানি চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। গত ৪ সেপ্টেম্বর ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে ২৯ জন প্রবীণ ব্যক্তির চোখের ছানি অপারেশন হয়েছে। পরের দিন ওই হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, কালো চশমা পরে আছেন সবাই। তাদের দৃষ্টিশক্তি পরীক্ষা করা হচ্ছিল। রায়পাশা-কড়াপুর ইউনিয়নের ৮০ বছর বয়সী মাহাতাব উদ্দিন বলেন, দুই বছর ধরে চোখে দেখি না। গরিব বলে ডাক্তার দেখাতে পারিনি। এখন আমি দেখতে পাচ্ছি। বাড়ি গিয়ে নাতিকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারব, তাতেই আমার শান্তি। চোখের আলো ফিরে পেতে সহায়তা দিয়েছে রিপন বাবায়, তার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করছি...। ইস্পাহানি চক্ষু হাসপাতালে বসে কথা হয় চরবাড়িয়া গ্রামের সবিরন বেগমের (৭০) সঙ্গে। তার পাঁচ পুত্র ও এক কন্যা। দুই বছর ধরে চোখে না দেখলেও ছেলে-মেয়েরা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়নি। সবিরনের পুত্র বজলুর রহমান বলেন, আমরা গরিব মানুষ। টাকার অভাবে মাকে ডাক্তার দেখাতে পারিনি। সালাহউদ্দিন রিপন মাকে এখানে এনে খাওয়া দাওয়া এবং ওষুধপত্র দিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন আমাদের কাছে মায়ের দাম অনেক বেড়ে গেছে। দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়া নিশিকান্ত দাশ নিশি জানান, সালাহউদ্দিন তার কাছে ভগবানের মতো। তিনি কোনদিন ভাবেননি পৃথিবীর আলো দেখতে পাবেন, আর কাজ করার স্বপ্ন দেখার তো প্রশ্নই উঠে না। এসআর সমাজকল্যাণ সংস্থা তাকে খুঁজে এনে চোখের অপারেশন করে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে স্বাবলম্বী হতে আর্থিক অনুদান দিয়েছে। সেই অর্থেই হাঁস-মুরগি কিনেছেন। তা দিয়েই এখন সংসার চলছে নিশিকান্ত দাস নিশির। শুধু চোখের চিকিৎসাই নয়, অসহায় অসুস্থ মানুষের তাৎক্ষণিক চিকিৎসায় সহায়তা দেয়া সংস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচী। ইতোমধ্যে কয়েক হাজার মানুষ সংস্থার সহায়তায় জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা করে আরোগ্য লাভ করেছেন। যেভাবে চিকিৎসা দেয়া হয় ॥ পতাং গ্রামের সমাজ সেবক বাচ্চু হাওলাদার জানান, ওয়ার্ড পর্যায়ে এই সংস্থার ১৬ সদস্য বিশিষ্ট স্বেচ্ছাসেবক কমিটি রয়েছে। প্রতিটি ওয়ার্ডের প্রতিনিধি নিয়ে ১০ সদস্যের ইউনিয়ন কমিটি রয়েছে। ওয়ার্ড কমিটি দুস্থ রোগীদের শনাক্ত করে। পরে সংশ্লিষ্ট কমিটি যাচাই করে চিকিৎসার অনুমোদন দেয়। যখন যে ইউনিয়নে ক্যাম্প বসে সেখানে সংস্থার খরচে রোগীদের নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসকরা রোগীর অবস্থা বুঝে অস্ত্রোপচারের জন্য বরিশাল নগরীর জীবনানন্দ রোডের ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে আসেন। অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হলে সংস্থার তত্ত্বাবধানে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার পাশাপাশি স্বাবলম্বী হতে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়। ইস্পাহানি চক্ষু হাসপাতালের পরিচালক বলেন, এখানে যেসব রোগী এসআর সমাজকল্যাণ সংস্থার আর্থিক সহযোগিতায় চিকিৎসা নেন তাদের ও তাদের সঙ্গে থাকা একজনকে বিনামূল্যে তিন বেলা খাবার দেয়া হয়। অপারেশনের এক সপ্তাহ পর এবং তারও পরে এক মাস সময় পর্যন্ত রোগীকে পর্যবেক্ষণে রেখে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে।
×