ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রুশো তাহের

রূপপুর ॥ গ্রিনফিল্ড থেকে কোর ক্যাচার

প্রকাশিত: ০৪:২৭, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

রূপপুর ॥ গ্রিনফিল্ড থেকে কোর ক্যাচার

মনে অজানা আতঙ্ক নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য ঈশ্বরদীর রূপপুর। কিন্তু স্ত্রী ও কন্যাকে বুঝতে দিইনি। তারপরও স্ত্রী ও কন্যার মধ্যে ওই আতঙ্ক সংক্রামিত হয়েছে ঠিকই। তাই তো বারবার তারা বলছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে, মানে নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলনের পরে রূপপুর গেলে হয় না। কিন্তু আমার এবারকার রূপপুর যাওয়া বিশেষ এ্যাসাইনমেন্টে। ‘কোর ক্যাচার’র ভিডিও ধারণ করা, যেটি মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে দীর্ঘপথে রূপপুর জেটিতে এসেছে। অনেক কারণে পদ্মায় ভাসমান কোর ক্যাচারের ভিডিও ধারণ করে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়টি প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবরও বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন। আর আমার ভিডিও টিম নিয়ে রূপপুর যাওয়া ও অনুমোদনসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্বে ছিলেন মুখ্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা অলোক চক্রবর্তী। তিনি আগের দিন-১ আগস্টই আমাদের লোকাল গাইড বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ নূর-ই-আলমের সেলফোন নম্বরসহ খুদে বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছেন। যা হোক, কোন ঝামেলা ছাড়াই সকাল সাতটার মধ্যে সাভার পার হয়ে গেলাম। টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পেরিয়ে নূর-ই-আলমকে ফোন দিলাম। আমরা কোথায় আছি এটা জানতে পেরে তিনি বললেন আরও তিন ঘণ্টার বেশি লাগতে পারে। একই সঙ্গে আমাদের শূটিং পরিকল্পনা জানতে চাইলেন মোঃ নূর-ই-আলাম। এবার রূপপুর যেতে মনে হলো পথই শেষ হচ্ছে না। দুটার কাছাকাছি। আমরা তখনও ঈশ্বরদী রেলগেট পার হচ্ছি। সেখান থেকে রাহুল মালিথাকে (আমার পরিচিত স্থানীয় যুবক ও ব্যবসায়ী) ফোন দিলাম। বললাম, রাহুল আপনার হোটেল কোথায়, আমরা দুপুরের খাবার আপনার হোটেলেই খাব। কাছাকাছি গিয়ে দেখি রাহুল মোটরসাইকেলে আমাদের এগিয়ে নিতে এসেছে। রাহুল মালিথার হোটেল রোহান রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাওয়া শেষ করতে করতে প্রায় তিনটা বেজে গেল। ইতোমধ্যে প্রকল্পের গাড়ি নিয়ে রোহান হোটেলে উপস্থিত হয়েছেন মোঃ নূর-ই-আলম। তিনি আমাদের নিয়ে রওনা হলেন আবাসিক এলাকা বাংলা কুটিরে। পথিমধ্যে নির্মাণাধীন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখে বিস্মিত হলাম এই ভেবে যে, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নদর্শী নেতৃত্বে বাঙালী কত বড় কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে যাচ্ছে। বাংলা কুটিরে আমাদের জন্য বরাদ্দ আলাদা আলাদা কক্ষে ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নিয়ে মোঃ নূর-ই-আলমসহ হার্ডিঞ্জ ব্রিজের আশপাশের এলাকা ও লালন শাহ্ সেতু থেকে কোর ক্যাচার ও খরস্রোতা পদ্মার ভিডিও ধারণের জন্য টিম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। উল্লেখ্য, এর আগে শুকনো মৌসুমে লালন শাহ্ সেতু থেকে পদ্মার ভিডিও ধারণ করেছিলাম। এখন বর্ষা মৌসুমে পদ্মার ভিডিও ধারণের জন্য এসেছি। পড়ন্ত বিকেলের অপরূপ দৃশ্যে লালন শাহ্ সেতুর ওপর থেকে পদ্মা ও পদ্মার ওপর ভাসমান কোর ক্যাচারের বিভিন্ন এ্যাংগেলে ভিডিও ধারণ করছে আমার টিম। খরস্রোতা পদ্মার বৈকালিক দৃশ্য দেখতে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। ঘটনাটি হলো গত বছর নিউক্লিয়ার সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে গিয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগে। আলাপচারিতার একপর্যায়ে জনৈক অধ্যাপক রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে বললেন পদ্মায় পানি নেই, হেঁটে পার হওয়া যায় আর আপনারা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট বানাচ্ছেন। পানি পাবেন কোত্থেকে। মনে পড়ে, আমি ওই অধ্যাপকের দাবির প্রতিবাদ করে বলছিলাম চলুন আমরা সরেজমিন দেখে আসি- হেঁটে পদ্মা পার হওয়া যায় নাকি সাঁতার দিতে হয়। আসলে সাংবাদিকতার আড়ালে দেশপ্রেমিক সেজে জনমনের ভ্রান্তিকে আরও উসকে দিয়ে ও পাকাপোক্ত করে দেশে নিউক্লিয়ার বিরোধিতাকে সুগম করেছিল কথিত প্রচার সংখ্যার শীর্ষের গণমাধ্যম (বাংলা ও ইংরেজী)। লালন শাহ্ সেতুর ওপর থেকে শূটিং শেষ করে বাংলা কুটিরে যাওয়ার পথে বিকেলের নাস্তা সেরে নিলাম। এক ফাঁকে আমি আর প্রোগ্রাম ডিজাইনার জাহেদুল করিম চলে গেলাম পাকশি রেলস্টেশনে। সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে কিছু সময় দারুণই কাটল পাহাড়ের চূড়াসম পাকশি রেলস্টেশনে। তারপর বাংলা কুটিরে ফিরে ঘণ্টখানেক বিশ্রাম নিয়ে রাতের খাবারের জন্য রোহান রেস্টুরেন্টে রওনা হলাম। গেটে সিকিউরিটি সদস্যরা জানিয়ে দিল স্যার রাত ১০টার মধ্যে অবশ্যই ফিরে আসতে হবে। এরপরে আর বাংলা কুটিরে প্রবেশ করা যাবে না। রোহান রেস্টুরেন্টে যেতে ও ফিরে আসতে প্রত্যক্ষ করলাম প্রকল্পের সাইটের অপরূপ দৃশ্য। বাংলা কুটিরে ফিরে টিভি দেখতে দেখতে মূল সাইটের ভিডিও ধারণের অনুমোদনের জন্য প্রকল্প পরিচালক ড. মোঃ শৌকত আকবরের সঙ্গে সেলফোনে যোগাযোগ করলাম। উনি ইতিবাচক আশ্বাস দিলেন এবং আমার ও টিমের অন্য সদস্যদের খোঁজখবর নিলেন। রাত দশটার পর মোঃ নূর-ই-আলমের ফোন। মূল সাইটে ভিডিও ধারণের অনুমতি পাওয়া গেছে। সেলফোনে ঠিক করে নিলাম আগামীকাল ৩ আগস্ট নয়টা থেকে কাজ শুরু করব। ৩ আগস্ট সকাল নয়টায় প্রকল্প সাইটে প্রবেশ করে প্রথমেই সবাই হেলমেট ও জ্যাকেট পরলাম। তারপর দৃশ্যমান স্থাপনা দেখতে দেখতে চলে গেলাম জেটিতে, যেখানে কোর ক্যাচারের শিপ ভিড়ানো আছে। এর মধ্যে শুরু হলো বৃষ্টি। বৃষ্টি উপেক্ষা করে আমার টিমের ক্যামেরাম্যান ও ক্রুরা শিপসহ বিভিন্ন এ্যাংগেলে কোর ক্যাচারের ক্লোজ শর্ট নিলেন। এরপর ক্লোজ ও লং শর্ট নিলেন ২.২ কিমি. দীর্ঘ, ১১ মিটার প্রস্থ ও ১৮.৫ মি. উচ্চতাসম্পন্ন বাঁধের, যেটি রূপপুর নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টকে খরস্রোতা পদ্মা থেকে রক্ষা করবে। যা হোক, এরপর গাড়িতে চড়ে, কোথাও বা গাড়ি থেকে নেমে এক হাজার দুইশ’ ঊনসত্তর একরের বিশাল এলাকা অনুমোদিত দৃশ্যমান ও দৃশ্যমান হওয়ার পথে স্থাপনাসমূহের ভিডিও ধারণের কাজ সমাপ্ত করলাম। পদ্মাতীরের এক সময়ের সবুজমাঠ বা গ্রিনফিল্ড ও ধু-ধু বালুচর আজ বাঙালীর পঞ্চাশ বছরের স্বপ্ন পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র হতে যাচ্ছে আর বাংলাদেশ হবে ৩৩তম পারমাণবিক শক্তিধর (শান্তিপূর্ণ কাজে) দেশ- এটা ভাবতে ভাবতে রূপপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম। লেখক : বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষক
×