ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

সাবধান গুজবেরও কান আছে

প্রকাশিত: ০৪:২৫, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

সাবধান গুজবেরও কান আছে

মিথ্যা আর গুজব দুই ভাই বা একই শব্দের এপিঠ-ওপিঠ। সব সময়ের জন্য না হলেও কিছু সময়ের জন্য একজন মানুষ, একটি জনগোষ্ঠী বা একটি জাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই ব্যাপারটা বেশি জানে বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষতিকর রাজনৈতিক দল বিএনপি-জামায়াত। এই দুটি দল নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে যে কোন মিথ্যা বলতে পারে, যে কোন মিথ্যা গুজব ছড়াতে পারে। এতে তাদের কোন অপরাধ বোধ নেই। স্বার্থটাই তাদের কাছে বড়। এরা মিথ্যাকে সত্য এবং সত্যকে মিথ্যা বানানোর জন্য সবচেয়ে নিচে নামতে পারে। মানুষের সত্য বলা বা মিথ্যা বলা নৈতিকতার ব্যাপার এবং এই নৈতিকতার সবচেয়ে মৌলিক ভিত্তি হলো ধর্ম এবং সেই ধর্ম নিয়েও এই দুটি দল সবচে বেশি অপব্যাখ্যা করেছে এবং এখনও করে চলেছে। ১. বিএনপি-দলটির প্রতিষ্ঠাতা মিলিটারি জিয়া ক্ষমতা দখল করে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ...’ সংযোজন করেন। ভাল কথা, মুসলমানদের প্রাণের বাণী সংযোজন করলেন, এতে সবার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু যখন একই সঙ্গে জাতির পিতা কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত মদ-জুয়া-হাউজি পুনরায় চালু করার নির্দেশে স্বাক্ষর করলেন তখন তাকে কী ভাবা যায়? পাঠক, আপনারাই বলুন। ২. জামায়াত-শিবির এই দলটি ইসলামের কথা বলে রাজনীতি করে। অর্থাৎ এর নীতি হলো ইসলামের নির্দেশনায় চলবে। প্রশ্ন হলো, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার মিলিটারি বাহিনী যখন নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছিল এবং মা-বোনদের ধরে ক্যাম্পে নিয়ে, এমনকি মার সামনে মেয়েকে, মেয়ের সামনে মাকে, স্বামীকে বেঁধে তার সামনে স্ত্রীকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে ধর্ষণ করছিল, তখন এই জামায়াত-শিবির তাদের সহযোগী ছিল। এরাই তাদের পথ দেখিয়েছে, নিজেরাও ধর্ষণ করেছে, অথচ তারা ইসলামের কথা বলে। একাত্তরে ৩০ লাখ শহীদ হয়েছিল এবং পাঁচ লক্ষাধিক মা-বোনকে ধর্ষণ এবং তাদের অনেককে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের কী ভাবা যায়? পাঠক, আপনারাই বলুন। ৩. এবার দুটি গুজবের কথা বলি- কিছুদিন আগে একটি গুজব ছড়ানো হয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে একটি ক্যুদেতা গ্রুপ প্লট তৈরি করে এবং তা ব্যর্থ হয়। সরকার পরিচালিত একটি ন্যাশনাল নিউজ মিডিয়া এ খবর পরিবেশন করে। সেই সঙ্গে দুটি প্রাইভেট চ্যানেল, যারা সরকারপন্থী বলে পরিচিত। প্রশ্ন হলো, খবরটি পরিবেশনের আগে ওই সব মিডিয়ার বোঝা উচিত ছিল কে কী উদ্দেশ্যে এটি ক্রিড করে। একটি ক্যুর আগে কিছু গুজব ছড়ানো হয়, এটি মিডিয়া বোঝে না তা মেনে নেয়া যায় না। যে বোঝে না তার মিডিয়া জগত ছেড়ে দেয়া উচিত। কেননা, খবরটি মিথ্যা এবং গুজব। তারপরও যার হাত দিয়ে খবরটি পরিবেশিত হলো পরবর্তীতে তাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে শুনেছি। প্রিয় পাঠক, আপনারাই বলুন, ডাল মে কুচ কালা হায়, না সাদা হায়? ৪. দ্বিতীয় গুজবটি ছিল- বঙ্গবন্ধুর প্রিয় দৌহিত্র এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইটি বিশেষজ্ঞ সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে। বলা হয়েছে জয় আকাশপথে ভ্রমণ করেছিলেন। আকাশে তার প্লেন ক্রাশ করে এবং জয়ের জীবনও বিপন্ন। একটি অনলাইন মিডিয়া এই গুজবটি পরিবেশন করে। অথচ ওই আকাশপথে জয় ভ্রমণই করেননি ওই দিন এবং ওই অনলাইন মিডিয়াকে টেলিফোন করে বলা হলো খবরটি সম্পূর্ণ গুজব এবং জয় সুস্থ আছেন। তারপরও তারা খবরটি প্রত্যাহার না করায় খোদ জয় এবার টেলিফোন করেন। তারপরও তারা প্রত্যাহার না করায় ওই মিডিয়ার বিরুদ্ধে এ্যাকশন নেয়া হয়েছিল। প্রিয় পাঠক, এই এ্যাকশন কি ঠিক হয়নি? ৫. সাম্প্রতিককালেও এমন ঘটনা ঘটেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের আড়ালে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ঢাল বানিয়ে শিবির-ছাত্রদলের ছেলেমেয়েরা ভুয়া আইডি কার্ড ও স্কুল-কলেজের ইউনিফরম বানিয়ে আন্দোলনকারীদের ভেতরে ছদ্মবেশে প্রবেশ করে গুজব ছড়িয়ে ভিসির বাড়ি আক্রমণ ও তাকে সপরিবারে হত্যার চক্রান্ত করে। দোষ দেয়া হয় ছাত্রলীগকে। এটা কি ঠিক হলো? ৬. দু’জন ছাত্রের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে কেন্দ্র করে স্কুল-কলেজের কিশোর-কিশোরী-তরুণ ছাত্রছাত্রীদের মাঠে নামানো হয়। এখানেও পেছনে সেই যুদ্ধাপরাধীর সন্তানরা এবার এমন গুজব ছড়াল যে, আওয়ামী লীগ অফিসে কয়েক আন্দোলনকারীকে হত্যা এবং কয়েক নারীকে গণধর্ষণ করা হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা। বস্তুত এমন কিছুই ঘটেনি; কিন্তু এই গুজবকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ অফিস (ধানমন্ডি ৩নং) আক্রান্ত হয়। এটা কি সঠিক কাজ হয়েছে? এমনি ভূরিভূরি ঘটনা আছে যা মিথ্যা এবং বানোয়াট বা গুজব। কিন্তু মিথ্যা বা গুজব ছড়াবার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এমন কোন সংবাদ দেখিনি বা শুনিনি। বরং তাদের সসম্মানে মায়ের কোলে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ক’দিন আগে দশজন তরুণকে নাশকতামূলক কাজের দায়ে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর জানা গেল তারা শিবির এবং জেএমবির সঙ্গে সম্পৃক্ত। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছে নাশকতার জন্য ব্যবহারের অনেক কিছু পাওয়া গেছে। অথচ একটি দৈনিক পত্রিকায় তাদের বিএনপিপন্থী ছাত্র হিসেবে দেখিয়ে এমন সব সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে যে, ছেলেগুলো ছাত্র এবং বিএনপি সমর্থক বলে তাদের গুম করা হয়েছে। পত্রিকাটি পারে না, নইলে এই মুহূর্তেই সময়ের সবচেয়ে সাহসী, মেধাবী, দূরদর্শী এবং সম্মানীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে দেয়। এই পত্রিকার আরেক ইংরেজী ভাই আছে তাদের কাছে খালেদা জিয়া ও তদীয় পুত্রধন তারেক হাওয়াভবনী বাংলাদেশের জন্য যোগ্য নেতা। তাদের পূর্বসূরি মিলিটারি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষকই শুধু নন, সবচেয়ে বড় দেশপ্রেমিক এবং তাদের সম্পর্কে মিথ্যার পর মিথ্যা দিয়ে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। তার আমি কিছু তথ্য দিতে চাই। জানি এগুলো অনেকেই জানেন। তবু যারা জানেন না তাদের জ্ঞাতার্থে তথ্যাবলী তুলে ধরছি- ৭. মিলিটারি জিয়া- ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চেও এই ভদ্রলোক পাকিস্তানী অস্ত্র বোঝাই জাহাজ সোয়াত থেকে অস্ত্র খালাসে নিয়োজিত ছিলেন। এরই মধ্যে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেন। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তখন মানুষের মধ্যে সাহস যোগানোর জন্য মিলিটারি মেজর জিয়াকে দিয়ে ঘোষণা পাঠ করান। তাও ২৭ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায়। অথচ লক্ষ্য করুন বিএনপি-জামায়াত জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বানিয়ে দেয়। একই সঙ্গে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রবক্তা। মূলত এই ভদ্রলোক যুদ্ধের মাঝে বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে মিলে কলকাতা থেকেই ষড়যন্ত্র শুরু করেন। যে কারণে যুদ্ধের শেষের দিকে তাদের পদচ্যুত করে এক রকম হাউস এরেস্ট করে রাখা হয়েছিল। তাদের চেহারা আরও পরিষ্কার হয় পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও জাতীয় চার নেতার হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং চক্রান্তকারী ছিলেন এরা। যে কারণে শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে খুনীদের বিচার করা যাবে না বলে আইন করেন, বিদেশী দূতাবাসে কূটনৈতিক পদে নিয়োগ দিয়ে পুরস্কৃত করেন এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশকে পাকিস্তানী ভাবধারায় নেয়ার জন্য জামায়াত-শিবির-যুদ্ধাপরাধীসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেন। এই মিলিটারি আজও মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত। ৮. খালেদা জিয়া- লেখাপড়া জানেন না। তাই আগে বলা হতো ডিগ্রী ক্লাস পর্যন্ত পড়েছেন। যখন দেখা গেল এটা খাওয়ানো যাচ্ছে না তখন বলা হলো স্বশিক্ষিত। তা না হয় বলা হলো, কিন্তু যখন দেখা গেল তাতেও কাজ হচ্ছে না তখন নীরব হয়ে গেল। বেরিয়ে এলো আরও মিথ্যা এবং গুজব। বিভিন্ন রেকর্ডে তার জন্মদিন দুইয়ের অধিক। এমনকি এতটা বেয়াদবি করতেও কুণ্ঠাবোধ করলেন না যে, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত দিবসে তার ভুয়া জন্মদিন বানিয়ে ভোমা ভোমা কেক কেটে চলেছেন। তা হলে তার আসল জন্মস্থান যেমন জলপাইগুড়ি বলে জানা যায় তেমনি আসল জন্মদিন কোন্টি? ৯. তারেক হাওয়াভবনী- জিয়া-খালেদা তনয় তারেকও কম জান না। এই অর্বাচীন যুবককে ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনেতা বলাতেও লজ্জা নেই। এই তারেক হাওয়াভবনীও মায়ের মতোই লেখাপড়ার ধার ধারেন না। অথচ ব্যারিস্টার মওদুদ, ড. খন্দকার মোশাররফ, ড. মঈন খানদের মতো সিনিয়র নেতাদেরও তার আসা-যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখাতে হতো। দুর্নীতির মামলায় লন্ডন পলাতক হওয়ায় নেতৃবৃন্দ এক দশক ধরে অপমান থেকে রক্ষা পাচ্ছেন। মূলত বিএনপি নামক দলটি এমনি মিথ্যা ও গুজবের ওপর এখনও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। বেঁচে আছে টুইন-সিস্টার দুই দৈনিক আছে বলে। এই মই সরে গেলে ধপাস করে মাটিতে পড়বে, আর উঠতে পারবে না। দলটি টিকে আছে হিটলারের প্রোপাগা সচিব গোয়েবলসের থিউরি আঁকড়ে ধরে। অর্থাৎ একটি মিথ্যাকে বারবার বলা গেলে তা সত্যে পরিণত হয়। কিন্তু এরই মধ্যে ৭ দশকেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা গোয়েবলসের মিথ্যার বেসাতি শেষ পর্যন্ত কাজ করেনি, হিটলার যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল। ঢাকা ॥ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ লেখক : সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব ও সিনেট সদস্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×