ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পপি দেবী থাপা

রমা চৌধুরী ॥ চির উন্নত শির

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮

রমা চৌধুরী ॥ চির উন্নত শির

জীবন যুদ্ধে চিরসংগ্রামী, অকুতোভয়, সাহসী এক সৈনিক রমা চৌধুরী। জীবনের প্রয়োজনে স্কুল শিক্ষিকা থেকে হয়েছিলেন বইয়ের ফেরিওয়ালা। কাছের মানুষ, সমাজ সংসার থেকে নিগৃহীত রমার জীবনে বড় সত্য ছিল- যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে। হ্যাঁ, বুকে সব হারানোর বেদনা আর নিজের লেখা বই হাতে করে রমা একাই পথ চলেছেন সারা জীবন। শত দুঃখ, বিপদে কারও কাছে সাহায্যের হাত পাতেননি কোনদিন। শত কষ্টে মাথা নোয়াননি কখনই। বাংলার এই নির্ভীক মা জন্মেছিলেন ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অর্জন করেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রী। ছিলেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম স্নাতকোত্তর নারী। সেই প্রতিকূল সময়ে একজন বাঙালী নারীর পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করা কোন সাধারণ ঘটনা ছিল না। তখনই ছিলেন নারী স্বাধীনতা ও নারী মুক্তির প্রতীক। পাস করার পর শিক্ষকতাকে বেছে নেন পেশা হিসেবে। ১৯৬২ সালে কক্সবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে নিয়োজিত হন। সেই থেকে ১৬ বছর শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বদলে দেয় তার জীবন। যুদ্ধে পাক বাহিনীর কাছে সম্ভ্রম হারিয়ে হন বীরাঙ্গনা। ’৭১-এর ১৩ মে, পাকহানাদার বাহিনী সর্বস্বান্ত করে তাঁকে। তাঁর স্বামী তখন ভারতে। সেদিন তিন সন্তান নিয়ে তিনি ছিলেন পোপাদিয়ায় তার বাবার বাড়িতে। ওই এলাকার পাকিস্তানী দালালদের সহযোগিতায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর লোকজন তাঁর বাড়িতে হানা দেয়। সে সময় সেখানে ছিল তাঁর মা ও তিন শিশু সন্তান। কোলে দুগ্ধপোষ্য সন্তান থাকা সত্ত্বেও নির্দয় পাকবাহিনী নিস্তার দেয়নি তাঁকে। পাঁচ বছর ৯ মাস বয়সী ছেলে সাগর ও তিন বছর বয়সী টগরের সামনেই তাঁকে ধর্ষণ করে পাকিস্তানী খানসেনা। পরবর্তী ধর্ষণের ভয়ে হানাদারদের কাছ থেকে কোন মতে মুক্ত হয়ে পুকুরপাড়ে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে থাকেন। শুধু নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি নর পিশাচরা। চোখের সামনে গানপাউডার দিয়ে তাঁর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় পাকসেনারা। নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিল পরিবারটিকে। ঘরের মূল্যবান মালামাল আর তাঁর লেখা সাহিত্য কর্মগুলো পুড়ছিল চোখের সামনেই। অথচ নেভানোর জন্য পারছিলেন না এগিয়ে আসতে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন একটি পরিবারের সর্বস্বান্ত হওয়ার চিতা। একপর্যায়ে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে চেষ্টা করেন ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ছিটে ফোঁটা কিছু রক্ষা করার। কিন্তু পোড়ার কিছুই যেন আর বাকি নেই। পরের ইতিহাস আরও করুণ আরও বেদনার। এবার শুরু হলো নিকটজন আর সমাজের কাছে লাঞ্ছিত হওয়ার পালা। সমাজের চোখে তখন তিনি একজন ধর্ষিতা নারী। সামাজিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার রমা তখন সম্ভ্রম হারানোর মর্মান্তিক ঘটনাকে আড়াল করে তিন সন্তান আর মাকে নিয়ে পথে পথে। মেলেনি নিরাপত্তার আশ্রয়। দিনান্তে জোটেনি দু’মুঠো ভাত। সহযোগিতা, সহমর্মিতা আসেনি কারও কাছ থেকেই। সবকিছু হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন রমা চৌধুরী। দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু সে স্বাধীনতার আলোয় অন্ধকার কাটল না রমার জীবনের। মুক্তিযুদ্ধের চরম অসময়ের বলি হলো তাঁর দুই সন্তান। দরজা-জানালাবিহীন পোড়া ঘরে শীতের রাতে শিশুসন্তানদের নিয়ে তাঁকে শুতে হয়েছে মাটিতে। না ছিল পরনের বস্ত্র, না বিছানা। তীব্র শীতে গায়ে ছিল না কোন গরম কাপড়। অনাহারে, অর্ধাহারে, ঠা-ায় সন্তানরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিজয়ের ঠিক আগের রাতে ১৫ ডিসেম্বর থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় বড় ছেলে সাগরের। চিকিৎসার জন্য গ্রামের এক সাধারণ ডাক্তারকে দেখিয়েছিলেন। কাজ হলো না। ২০ ডিসেম্বর রাতে মারা গেল সাগর। সহায়-সম্বল, আর প্রথম সন্তানকে হারিয়ে রমা তখন উন্মাদপ্রায়। একই অসুখে আক্রান্ত হলো তাঁর দ্বিতীয় সন্তান টগর। সন্তান হারা অর্ধউন্মাদীনি মা সন্তানকে ওষুধ খাওয়াতে গেলে অসাবধানতা বসত কখন যে শ্বাসরোধ হয়ে গেল টগরের, মা টের পেলেন না। প্রথম সন্তান হারানোর ঠিক এক মাস ২৮ দিন পর দ্বিতীয় সন্তানকে হারিয়ে রমা তখন দিশেহারা। সর্বগ্রাসী অভাব, তার মাঝে টিকে থাকার লড়াই। সমাজের লাঞ্ছনা-গঞ্জনা আর সন্তান হারা মায়ের বিপর্যয় যেন কিছুতেই কাটে না। দ্বিতীয়বার সংসার বাঁধতে গিয়ে হলেন প্রতারণার শিকার। দ্বিতীয় সংসারের ছেলে টুনু ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ায় সড়ক দুর্ঘটায় মারা যায়। প্রথম দুই সন্তান হারিয়ে খালি পায়ে থাকতেন মা রমা। সকলের কথার চাপে মাঝেমধ্যে পায়ে স্যান্ডেল পরলেও তৃতীয় সন্তানটি হারিয়ে তিনি বাকি জীবন খালি পায়ে থেকেছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখাও করতে গিয়েছেন খালি পায়ে। মৃত্যুর পর তাঁর তিন সন্তানকেই মাটি দেয়া হয়। তিনি বলতেন, ‘যে মাটিতে আমার সন্তানরা ঘুমিয়ে আছে, সে মাটির ওপর দিয়ে আমি জুতা পায়ে হাঁটি কি করে?’ জীবন থেমে থাকেনি। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে শুরু করেন লেখালেখি। ‘একাত্তরের জননীসহ ১৮টি বই লিখেছেন তিনি। জীবিকার প্রয়োজনে সেই বই ফেরি করেছেন পায়ে হেঁটে, চট্টগ্রামের পথে পথে। প্রথমে লিখতেন একটি পাক্ষিক পত্রিকায়। সম্মানীর বদলে পেতেন প্রত্রিকার ৫০টি কপি। পরে নিজের লেখা বই নিজেই প্রকাশ করে ফেরি করেছেন। বই বিক্রি করতে পারলে আহার জুটত, না হলে উপোস। রমা চৌধুরীদের মতো মায়েদের মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে এসেছিল আমাদের এই স্বাধীনতা। অথচ স্বাধীনতার তিন যুগ পরেও এই বাংলা মাকে ঝোলা হাতে ঘুরতে হয়েছে পথে পথে। একাই পাড়ি দিয়েছেন দুর্গম পথ। এর মাঝেও স্বপ্ন দেখেছেন সুন্দর আগামীর। ’৭১-এর পোড়া ভিটাতেই নিজের একক প্রচেষ্টায় ‘দীপঙ্কর স্মৃতি অনাথালয়’ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তাঁর সেই স্বপ্নের কথা প্রধানমন্ত্রীকেও জানিয়েছেন। সেই স্বপ্ন তিনি পূরণ করতে চেয়েছেন তাঁর বই বিক্রির টাকায়। জীবনে গ্রহণ করেননি কারও সাহায্য। দয়া ভিক্ষা করেননি কারও কাছেই। চাননি কোন খেতাব। দেশের জন্য হয়েছেন বীরাঙ্গনা। হয়েছেন রাস্তায় বইয়ের ফেরিওয়ালা। এটাই বড় পাওয়া। এটাই বড় কষ্ট। তিনি নিজেই বলেছেন, তাঁর নিজের কোন চাওয়া পাওয়া নেই। সবাই মিলে যদি দেশটাকে গড়ে তোলা যায় তাহলে তিনি খুশি হবেন। বিলাসিতায় গা ভাসানো বাদ দিয়ে সবাই মিলে দেশটাকে গড়ে তুলতে হবে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ১৬ ডিসেম্বর শেষ হলেও রমা চৌধুরীর জীবনযুদ্ধ চলেছে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। সে যুদ্ধের অবসান হলো ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। জীবনের সমস্ত কিছু দেশকে দিয়ে অবশেষে নিজ দেহকেও মিশিয়ে দিলেন দেশের মাটির সঙ্গে। মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে যে আলোড়ন সৃষ্টি হচ্ছে চারপাশে, তা যদি আর কয়েক বছর আগে থেকে হতো, তাহলে হয়ত বিন্দুমাত্র হলেও জাতি তার লজ্জা ঘোঁচাতে পারত। আত্মপ্রত্যয়ী মুক্তিযোদ্ধা রমা চৌধুরী বাংলার ইতিহাসে আত্মমর্যদাশীল, চির উন্নত শির এক মানবী হিসেবে অম্লান থাকবেন।
×